সাম্প্রতিক

যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান দ্বন্দ্বের ইতিহাস

সাম্প্রতিক শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০১৯ ১২:১৭:৪৯

বেশ অনেকদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের সম্পর্ক নিয়ে দুদেশে এমনকি পুরো বিশ্বে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে আবার এ বিষয়টা যুদ্ধে পরিণত হতে পারে বলেও ধারণা করছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান দুই দেশই স্বার্থ রক্ষার বেলায় কোন আপস করতে প্রস্তুত নয়। মধ্যপ্রাচ্যে যেভাবে উত্তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে যে কোন সময় যে কোন কিছু ঘটে যাওয়ার শংকাকেও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের এই বিপরীতমুখীতা বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। কালের পরিক্রমায় বহু ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে আজকে তাদের এই মুখোমুখি অবস্থান।


সময়ের সাথে এই দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক নানাভাবে এগিয়ে চলেছে। কয়েক দশকের বিরোধীতায় আজকের যে রূপ দাড়িয়েছে তার অতীত ইতিহাস থেকে একটু ঘুরে আসা যাক।

ইরানী তেল ও শাহ পাহলভীঃ  ১৯৫০ এর দশক থেকে দুই দেশের মধ্যে জটিল সম্পর্কের সূত্রপাত। তার পুরোটাই ইরানের তেল সম্পদ নিয়ে। ইরানের তেল সম্পদের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করতো বৃটিশরা। তখন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ইরানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন মোহাম্মদ মোসাদ্দেক। মোসাদ্দেক তার ক্ষমতারোহনের পরপর ইরানের তেল সম্পদকে সরকারি আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। তখন বিপত্তি বাঁধে মার্কিন ও বৃটিশদের। সরকারি আওতায় চলে এলে এর থেকে মার্কিন ও বৃটিশদের আর সুবিধা নেয়া সম্ভব হবে না। তাই মার্কিন ও বৃটিশদের ইন্ধনে ১৯৫৩ সালে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রেজা শাহ পাহলভী পুনরায় পুর্ণ ক্ষমতা লাভ করেন। পাহলভী ক্ষমতা গ্রহণ করেই ‘সাভাহ’ নামক গোয়েন্দা পুলিশ দিয়ে বিরোধীদের দমন করেন।

এদিকে তখন রেজা শাহ পাহলভীর প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেন ইসলামপন্থী নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনী। শাহ তার ক্ষমতা দিয়ে খোমেনীকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেন, যাতে কেউ তার বিরোধীতা করতে সাহস না পায়।

পারমাণবিক কর্মসূচীতে ইরানঃ ১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে তেহরান রিসার্চ রিয়্যাকটর (TRR) সরবরাহ করে যা ৫ মেগাওয়াট পারমাণবিক চুল্লীর একটি আগ্নেয়াস্ত্র। এর জ্বালানির ৯৩ শতাংশই ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ। এরপর ১৯৬৮ সালে ইরান পারমাণবিক শক্তির বিস্তার নিয়ন্ত্রণ (NPT) শীর্ষক একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। স্বাক্ষরের দুই বছর পর আবার চুক্তি অনুযায়ী তাকে পারমাণবিক কর্মসূচী গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয় তবে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের উপর জারিকৃত নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকে।

ইরানের ইসলামি বিপ্লব -১৯৭৯ঃ ১৯৭৯ সালের শুরুতে ইরানে গন অভ্যুত্থান শুরু হয়, ১৬ জানুয়ারি শাহ মিশরে পলায়ন করলে প্যারিস থেকে আয়াতুল্লাহ খোমেনী ফিরে আসেন ইরানে, ফিরে তিনি একটি সরকার গঠন করে ইরানকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। খোমেনী হয়ে উঠেন ইরানের প্রথম মুসলিম নেতা। তখন শাহকে মদদ দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র বিরোধীতা ইরানে চরম মাত্রায় দেখা দেয়। তারউপর শাহ নিজের চিকিৎসার নাম করে যুক্তরাষ্ট্রে উপস্থিত হলে ইরানবাসী যুক্তরাষ্ট্রের উপর আরো ক্ষেপে উঠে।

জিম্মি সংকট -১৯৭৯-৮১ঃ  খোমেনী পন্থী ইরানের সমর্থকরা আমেরিকার উপর ক্ষুব্ধ হয়ে আমেরিকান এম্বাসি ঘেরাও করে ফেলে। এম্বাসিতে আটকে পড়া ৫৫ জন আমেরিকান নাগরিককে ৪৪৪ দিন জিম্মি করে রাখে ইরান। সেই প্রথম যুক্তরাষ্ট্র ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

ইরান-ইরাক যুদ্ধ -১৯৮০ঃ  ইরানে হঠাৎ হামলা করে তিক্ত এক যুদ্ধ শুরু করে ইরাক। আর সেই যুদ্ধে ইরাককে নানানভাবে সহযোগীতা করতে শুরু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ৮ বছর চলা দীর্ঘ এ যুদ্ধে ধারণা করা হয় প্রায় দশ লক্ষ মানুষ মারা যায়। ৮  বছর পর এক চুক্তির মাধ্যমে ইরাকের সাথে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হন আয়াতুল্লাহ খোমেনী।

যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত -১৯৮৮ঃ আমেরিকা আর ইরানের সম্পর্ক তিক্ত হতেই থাকে। ইরানের ইঙ্গিত এমন যে যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরায়েল তাদের প্রধান শত্রু। এমন সময়ে ইরানের একটি যাত্রীবাহী বিমান গুলি করে ভুপাতিত করে আমেরিকান যুদ্ধ জাহাজ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই ভুল স্বীকার করলেও তার জন্য ক্ষমা চায়নি।

সৌদি আরবে বোমা হামলা -২০০১ঃ এই বছরের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করে, সৌদি আরবে অবস্থানরত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর উপর বোমা হামলায় ইরান প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। সেপ্টেম্বর মাসে সিআইএ’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারে শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে এবং চীন ও রাশিয়া থেকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি আমদানি করছে।

Axis off evil/ শয়তানের চক্র -২০০২ঃ ২০০২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ইরান ইরাক এবং উত্তর কোরিয়াকে ‘শয়তানের চক্র’ বলে ঘোষণা করে। সেপ্টেম্বর মাসে ইরানের বুশেহর নামক স্থানে প্রথমবারের মতো রাশিয়ান প্রযুক্তির সহায়তায় নির্মিত হয় পারমাণবিক চুল্লী। ইরান সরকার বিরোধী একটি গ্রুপ সিআইএকে জানায়, ইরান আরো আগে থেকেই অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে দুটি জায়গায় পারমাণবিক চুল্লী নির্মাণ করে। যার একটি হলো নাতানজে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ প্ল্যান্ট, আর অন্যটি আরাক নামক স্থানে হ্যাভি ওয়াটার-মডারেটেড পারমাণবিক চুল্লী।

ইরানের উপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা -২০১২ঃ এরপর যুক্তরাষ্ট্রের মূল নজর পড়ে ইরানের পারমাণবিক কর্মসুচীর উপর। ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইউএস ঘোষণা করে, ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ প্রকল্প নির্মাণ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ইরানের উপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী। ফলে মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে যায় ইরানের তেল রপ্তানি ও অর্থনীতি।

পারমাণবিক চুক্তি - ২০১৫ঃ  ইরানের দাবি পারমাণবিক কর্মসূচি চলছে শান্তিপুর্ণ উদ্দেশ্যে। এদিকে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর চাপ ও ইরানের অর্থনীতিতে ধস নেমে আসতে শুরু করলে ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (JCPOA) নামে একটি চুক্তিতে ইরান পারমাণবিক কর্মসূচী সীমিত মাত্রায় নিয়ে আসবে বলে সম্মত হয়। তার পরিবর্তে ইরানের উপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হবে বলেও সম্মত হয়।

ইরানের উপর আবারো নিষেধাজ্ঞা - ২০১৮ঃ ইরানের উপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেও ৩ বছর পরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঐ চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসেন, এবং ইরানের 'রেভ্যুলেশনারী গার্ড' কে একটি 'সন্ত্রাসী' সংগঠন বলে ঘোষণা করে ট্রাম্প। যার ফলে ইরানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

ইরান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ বিরোধ এখন চলছে মূলত ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইরানের বর্তমান সুপ্রিম লিডার আলী খোমেনীর সাথে। ইরানের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বে যে নিষেধাজ্ঞা জারি ছিলো ট্রাম্প তার সাথে আরো নতুন করে কিছু নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ইরানের উপর। এমনকি অনেক সময় ট্রাম্প ইরানের উপর সামরিক প্রদক্ষেপ নিতে পারে বলেও বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। অন্যদিকে ইরানও বলছে তাহলে তাদের ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তিতে বহাল থাকার আর যৌক্তিকতা নেই। এভাবেই ক্রমাগত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর ইরানের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমাগত বেড়েই চলছে।

তথ্যসূত্রঃ

https://www.bbc.com/news/world-middle-east-24316661

https://www.bbc.com/bengali/news-48932873
লেখকঃ এস এম সজীব