
তালেবান : একটি রাজনৈতিক সংগঠন থেকে জঙ্গিগোষ্ঠী হয়ে উঠার গল্প
আজ সমগ্র বিশ্বে জঙ্গিবাদ ও মুসলিম সমাজ ওতপ্রোতভাবে ড়িত হয়ে গেছে। পশ্চিমা বিশ্বের অনেক সাধারণ নাগরীকই মনে করেন যে মুসলিম ও জঙ্গিবাদ একই। তারা কল্পনা করতে পারে না যে ইসলাম একটি শান্তির ধর্ম। সমগ্র বিশ্বে জঙ্গিবাদ শব্দটি ছড়িয়ে পড়ার পেছনে যেসব জঙ্গি সংগঠন সমুহ প্রধান ভূমিকা পালন করেছে তাদের মধ্যে অন্যতম হল তালেবান জঙ্গিগোষ্ঠী। তাদের সামগ্রিক উত্থান পর্ব ও তাদের ইতিহাসের গতিধারা সম্পর্কে জানলেই মুসলিক ও আধুনিক জঙ্গিবাদের অনেক নিহিত ইতিহাস বেরিয়ে আসবে বলে বিশ্বাস করি। তাই এই প্রবন্ধে তালেবানদের জন্ম ও তাদের আজকের অবস্থায় আসার সামগ্রিক ইতিহাস সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো।
তালেবান শব্দটি আরবি শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ শিক্ষার্থী। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের(মাদ্রাসা) এর শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে এই সংগঠন গড়ে উঠে বলে তার নাম দেয়া হয় তালেবান। আফগানিস্তানে এই সংগঠনের সূত্রপাত হলেও পরবর্তীতে এটি পাকিস্তানেও ঘাটি গাড়ে। তবে তারা শুরুতে জঙ্গিগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত ছিল না। একটা সময় তাদের বর্তমান প্রধান শত্রু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও তাদের অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক ছিল। তবে হুট করে কেন তারা জঙ্গি হয়ে গেল?
কেনইবা মার্কিনীদের সাথে তাদের এই বৈরী সম্পর্ক গড়ে উঠলো? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আমাদের একটু পিছনের ইতিহাস জেনে আসতে হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সমগ্র বিশ্ব কার্যত দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক জোট অপরদিকে সোভিয়েত (রাশিয়া) নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক জোট। এর ধারাবাহিকতায় ৭০ এর দশকে মধ্যএশিয়ার দেশ সমুহ দখল করে তৎকালিন সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠন করে। মধ্য এশিয়ার দেশ সমুহের পার্শ্ববর্তী দেশ হওয়ার সুবাদে তাদের নজর পড়ে আফগানিস্তানের দিকে।
তাছাড়া আফগানিস্তানকে নিয়ে রাশিয়ার আর একটি শংকা ছিল যে মার্কিনীরা আফগানদের ভূমিকে ব্যবহার করে আফগান সীমান্তবর্তী সোভিয়েত অঞ্চল সমুহে আক্রমন করতে পারে। তাই তারা (রাশিয়া) আগে থেকেই আফগানিস্তানকে কব্জায় নেয়ার চেষ্টায় রত হয়। ফলে ১৯৭৯ সোভিয়েত বাহিনী সরাসরি আফগান মাটিতে সৈন্যবাহিনী নামিয়ে দেয় এবং স্থায়ীভাবে দখল করে নেয়ার জন্য চেষ্টা চালাতে থাকে। সোভিয়েত খুবই আত্মবিশ্বাসী ছিল যে তারা সহজে আফগানিস্তান দখল করে নিতে সক্ষম হবে। কেননা তারা ধারনা করেছিল যে আফগানদের হাতে যুদ্ধ করার জন্য তেমন কোন অস্ত্র এবং সৈন্যবাহিনী কোনটাই নেই যা দিয়ে সোভিয়েত বাহিনী কে পরাস্ত করা যায়। তবে বাস্তবতা দেখা গেল ভিন্ন। যুদ্ধ যখন শুরু হয়ে গেল তখন দেখা গেল আফগানিস্তানের সাধারণ জনগণই তীব্র দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে যুদ্ধের ময়দানে নেমে পড়ে। তারা হালকা অস্ত্রশস্ত্র নিয়েই আধুনিক অস্ত্র ও প্রশিক্ষিত সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে দাড়িয়ে যায়। আফগানরা সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে জিহাদ হিসেবে ঘোষণা করে। অর্থাৎ তারা বলে কাফেরদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য তারা জিহাদ করছে। ফলে বিশেষ করে ধর্মীয় দলগুলো ও ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষকরাই এখানে অধিক মাত্রায় যোগদান করে।
এভাবে কিছুদিন যুদ্ধ চলার পর যুদ্ধের দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়ে যায়। মার্কিনীরা দেখলো যে তাদের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েত যদি আফগানিস্তানে তাদের অবস্থান শক্তিশালী করে ফেলতে পারে তাহলে ধীরে ধীরে সমগ্র এশিয়াকে কব্জায় নিয়ে নিতে সক্ষম হবে। তাই তাদেরকে এখানে আটকাতে না পারলে মার্কিনীদের জন্য স্নায়ুযুদ্ধে পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে এটি দেখা দিবে । কেননা ইতোমধ্যে মার্কিনীরা ভিয়েতনাম যুদ্ধে পরাজিত হয়ে এশিয়ায় তাদের আধিপত্যকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরনের জন্য তারা তাদের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ কে নিয়োগ করে। সি আই এ পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থাদের দ্বারা আফগান যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। একই সাথে আফগান যুদ্ধে সকল মুসলিম বিশ্বকে যুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম সমাজে প্রচার করতে থাকে যে আফগানিস্তানে যুদ্ধ মুলত মুসলিম ও ইশ্বরবিহীন সমাজতন্ত্রীদের যুদ্ধ এবং এটি মুসলিমদের জিহাদের সমতুল্য। ফলে তাদের পরিকল্পনামতো পশ্চিমা মিডিয়াসমুহ আফগানদের আন্দোলনকে স্বাধিকার আন্দোলন ও ধর্মীয় যুদ্ধ হিসেবে প্রচার করতে থাকে। ফলে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশ হতে আফগানিস্তানের পক্ষে সাহায্য আসতে থাকে। অপরদিকে মার্কিনীরা পাকিস্তানী গোয়েন্দাদের মাধ্যমে নগদ অর্থ সহায়তা দিয়ে আফগানিস্তানের যোদ্ধাদের প্রশিক্ষন দিতে থাকে এবং মার্কিন অস্ত্র তাদের হাতে তুলে দিতে থাকে। এসব যোদ্ধাদের অধিকাংশই তখন ধর্মীয় চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে পাকিস্তান থেকে প্রশিক্ষন ও অস্ত্র নিয়ে নিজ ভুমিতে যুদ্ধ করতে নেমে পড়ে।
ফলে আফগানদের শক্তিশালী, সাহসী ও আগ্রাসী যুদ্ধ নীতির জন্য সোভিয়েত বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নও দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন চুড়ান্তভাবে আফগানিস্তানে পরাজিত হয় এবং তাদের সৈন্যবাহিনী আফগানিস্তানের মাটি ছেড়ে চলে যায়। পেছনে ফেলে রেখে যায় যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রের ধ্বংসস্তুপ। এর কিছুদিন পরেই সোভিয়েত ইউনিয়নও ভেঙ্গে যায়। এতে করে মার্কিনীদের চুড়ান্ত বিজয় সূচিত হয়। তবে আফগানিস্তান আকাশে ঘন মেঘের সূতা কেটে সুখের সূর্য দেখা দেয়নি। মুজাহিদরা সোভিয়েত যুদ্ধের সময় ঐক্যবদ্ধ থাকলেও রেড আর্মি চলে যাওয়ার পর দেখা গেলো এরা প্রতিটা প্রদেশে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধ করা শুরু করলো। এই সময়ে মুজাহিদ নেতারা নিজেরাই নিজেদের মত করে প্রদেশ শাসন করা শুরু করলো বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আর এই সময়ে মোল্লা ওমরের উত্থান ঘটে সাথে তালেবানের উত্থানও শুরু! কান্দাহারের মোল্লা ওমর নামে একজন সাধারণ যোদ্ধা ঘোষণা করল যে-, সে একটা খাঁটি ইসলামিক স্টেট হিসেবে আফগানিস্তানকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
১৯৯৪ সালে মোল্লা ওমর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে তালেবানকে একটি সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। একই সময়ে কান্দাহার দখল করে নিয়ে সেখানে ইসলামী শাসন কায়েমের ঘোষণা দেয়। এর পরবর্তীতে তারা কাবুল দখল করে নেয়। তারা একটি শান্তিপূর্ণ ও ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য অগ্রসর হতে থাকে। তবে এতে আফগানিস্তানের সাধারণ নাগরীকদেরও সমর্থন ছিল। ১৯৯৬ সালের মধ্যে প্রায় সমগ্র আফগানিস্তানেই তালেবানদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। অনেকে ধারনা করেন যে তাদের এই রাতারাতি সমগ্র আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখলের ব্যাপারে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ বেশ অবদান রয়েছে। তারা কাবুল দখল করে কাবুল রেডিওর নাম পরিবর্তন করে শরিয়াহ রেডিও করে। সকল স্তরে শরিয়াহ ভিত্তিক আইন প্রনয়ন করে। নারী শিক্ষা নিষিদ্ধ করে। নারীদের বাহিরে চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। আফগান তালেবানরা সরল মনে মার্কিনীদের বিশ্বাস করতে থাকে। তারা ভাবতে থাকে যে মার্কিনরা তাদের বিশ্বস্ত বন্ধু তাই তাদের এই ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমে মার্কিনী সর্বদা তাদের পাশে থাকবে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন হয়ে দেখা দিলো। মার্কিনীরা আস্তে আস্তে তাদের পাশ থেকে সরে যেতে থাকলো। এভাবে তারা ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতা চালাতে থাকে।
২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলা হলে। আল কায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেন কে এই হামলার মুল হোতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিন লাদেনের সাথে তালেবানদের সুসম্পর্ক ছিল। কেননা সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে আফগান মুজাহিদরা যখন যুদ্ধ করছিলেন তখন বিন লাদেন সাহায্যের হাত নিয়ে আফগানের পাশে এসে দাড়ায়।
ফলে ৯/১১ এর হামলার পর পরই তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ "সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ" নামে এক পরিকল্পনার ঘোষণা দেন। প্রথমেই তারা কয়েকটি সংগঠনকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেন এবং তাদের বিরুদ্ধে অপারেশন পরিচালনা করতে থাকে। তাদের চিহ্নিত সন্ত্রাসী সংগঠনের প্রায় সবগুলোই ছিল মুসলিম সংগঠন। ফলে মার্কিনীরা প্রথমে আল কায়দার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে। পরবর্তীতে আল কায়দা ও বিন লাদেনের সাথে সম্পর্ক থাকার অভিযোগ এনে তালেবানদেরকেও সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যা দেয় এবং তাদেরকে আফগান রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। পাশাপাশি আফগানিস্তানেও মার্কিন সৈন্যবাহিনী নামিয়ে দেয়া হয়। ফলে যে তালেবানরা একসময় নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য মার্কিনীদের সহায়তায় অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছিল তারা এবার খোদ মার্কিনীদের বিরুদ্ধেই অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয় এবং তুমুল বেগে আফগান মুজাহিদ ও মার্কিন সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধ হতে থাকে।
২০০৬ সালের মধ্যে তালেবান মুজাহিদদের পিছু হটতে বাধ্য করা হয়। ফলে তারা দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ চালাতে থাকে। এদিকে মিডিয়ার কল্যাণে সমগ্র বিশ্বে তালেবান বিরোধী মনোভাব তৈরি হয়। একই সাথে আত্মঘাতী হামলার জন্য দ্রুতই সকলের নিকট জঙ্গি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। মার্কিন সৈন্যরা এখন পর্যন্ত আফগানিস্থানে তাদের কে চুড়ান্তভাবে পরাজিত করতে পারে নি। তাদের কোন অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হলেও অচিরেই তারা অপর একটি অঞ্চল দখল করে নিতে সক্ষম হয়। বর্তমানে আফগানিস্তানের হেলমান্দ ও কান্দাহারের অধিকাংশ অঞ্চল তালেবানদের অধীনে রয়েছে। ২০০৬/৭ সালের দিকে তালেবানদের সদস্য যেখানে ১৫ হাজার ছিল বর্তমানে তা এসে ৬০ হাজারে দাড়িয়েছে। তাই এই ১৮ বছর ব্যাপী যুদ্ধে তালেবানদের দমন করা সম্ভব হয় নি। তাই বর্তমানে শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেয়ার জন্য তালেবানদের সাথে মার্কিনীদের আলোচনা চলছে। একই সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্টও ঘোষণা করেছেন যে অচিরেই আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে সৈন্য বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়া হবে।
পরিশেষে বলা যায় যে তালেবান মুজাহিদরা যে স্বাধিকার আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে মার্কিনীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। এই যুদ্ধে তাদের অপারেশন প্রক্রিয়া, আত্মঘাতী হামলা ও নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করার প্রক্রিয়া কে কোনভাবেই সমর্থন করা যায় না। তাছাড়া তারা ধর্মের নামে যে অধর্মের চর্চা করছে তা দেখলে স্পষ্টতই বুঝা যায় তাদের ধর্মীয় উদ্দেশ্য থেকে এখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই মুখ্য। অপরদিকে মার্কিন যোদ্ধাদেরও অস্ত্র বাণিজ্য ও অপর রাজ্যে হস্তক্ষেপ করার হীন চরিত্র এখানে ফুটে উঠেছে। একটি শান্তি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তালেবান সুষ্ঠু ধারায় ফিরে আসবে এবং মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করে আফগানিস্তানে একটি স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে এটাই এখন বিশ্ববাসীর চাওয়া।
তথ্য সূত্র
১.https://www.britannica.com/topic/Taliban
২.https://www.c-r.org/accord/afghanistan/taliban-history-war-and-peace-afghanistan
৩.https://www.google.com/amp/s/www.bbc.com/bengali/amp/news-45532165
৪.http://www.sachalayatan.com/guest_writer/34315
লেখকঃ ফরিদ মোল্লা