
কাশ্মীর : স্বাধীনতা লাভের পথ থেকে সরে যেভাবে ভাগ হয়ে গিয়েছিল
বর্তমান বিশ্বের যে সকল অঞ্চল বিতর্কিত অঞ্চল হিসেবে বার বার আলোচিত হচ্ছে এবং বিচ্ছিন্নতাবাদ বিদ্যমান সেসব অঞ্চলের মধ্যে কাশ্মীর অন্যতম। সম্প্রতি সময়ে কাশ্মীরের অবস্থা সমগ্র বিশ্বের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। তবে এই কাশ্মীর ইস্যু সামনে আসার পর অনেকের মনেই নানা প্রশ্নের উদ্রেক হয় যে কেন কাশ্মীরের এই অবস্থা? কেনই বা তারা মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ হয়েও ভারতের অন্তর্ভূত হলো? কেন কাশ্মীর দুইভাগে বিভক্ত হলো? তো চলুন জেনে আসা যাক কাশ্মীর ভাগের ইতিহাস।
কাশ্মীর এশিয়ার উত্তর -পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত। পূর্বের কাশ্মীর অঞ্চলটি বর্তমানে তিনটি ভাগ হয়ে তিন দেশের অধিন হয়ে গেছে। একটি অঞ্চল ভারতের ভিতরে অবস্থিত, বাকি দুটির একটি পাকিস্থানে যেটি আজাদ কাশ্মীর হিসেবে পরিচিত, অপরটি চীনের ভিতরে যেটি আকসাই চীন হিসেবে পরিচিত। কিন্তু বর্তমানে যেটি নিয়ে বিতর্ক সেটি হলো ভারত অধ্যুষিত কাশ্মীর। পূর্বে কিন্তু এই তিনটি অঞ্চল এভাবে বিভক্ত ছিল না। মুলত ভারত -পাকিস্তানের বিভক্তির পরই কাশ্মীর বিভক্ত হয়।
পঞ্চম শতক পর্যন্ত সময়ে কাশ্মীরী আদিবাসীদের দ্বারা এই অঞ্চল পরিচালিত হতো। ৫শতকে এই অঞ্চলটি বৌদ্ধরা দখল করে নেয়। তারা বেশ কিছুদিন শাসন করার পর ১৩৩৯ সালে শাহ মীর নামক একজন মুসলিম শাসক এই অঞ্চলটি দখল করে নেয় এবং এই অঞ্চলে মুসলিমদের শাসন চলতে থাকে। তারপর মুঘল আমলে এটি মুঘলদের করদ রাজ্য হিসেবে শাসিত হতে থাকে। ফলে এঅঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে মুসলিম শাসন বজায় থাকার দরুন এখানে মুসলিমরা সংখ্যা গরিষ্ঠ হিসেবে আবির্ভূত হয়। একই সাথে এখানে মুসলিম সুফিবাদের বিকাশ হয়। প্রায় পাঁচশত বছর এখানে মুসলমানরা শাসন করার পর ১৮১৯ সালে তাদের পতন হয়। মুলত শিখরা মুসলমান্দের পরাজিত করে ক্ষমতা দখল করেন। শিখদের কাশ্মীর জয়ের নেতা ছিলেন রঞ্জিত সিং। ১৮১৯ সালে কাশ্মীর জয় করে তিনি শাসন কার্য পরিচালনা করতে থাকেন। তবে তিনি এই শাসনকাল কে দীর্ঘস্থায়ী করতে পারেন নি। কিছুদিন শাসন পরিচালনার পরই তার ইংরেজদের কে মোকাবিলা করতে হয়। ১৮৪৬ সালে ইংরেজরা কাশ্মীর আক্রমণ করলে শিখরা তাদের হাতে পরাজিত হয় এবং কাশ্মীর ইংরেজদের হাতে চলে যায়। তবে ইংরেজরা এখানকার ভৌগোলিক অবস্থার জন্য এটি সরাসরি শাসন না করে, করের বিনিময়ে অন্যের হাতে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেই মোতাবেক বার্ষিক ৭৫ লক্ষ্য রূপি চাদার বিনিময়ে গোলাব সিং নামক একজন শিখ নেতার কাছে কাশ্মীরের শাসন ক্ষমতা ছেড়ে দেন। ১৯৪৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত গোলাব সিং এর বংশধরদের হাতেই কাশ্মরের শাসন ক্ষমতা ছিল।
গোলাব সিং এর পর ১৯২৫ সালে কাশ্মীরের ক্ষমতায় আসেন তারই বংশধর হরি সিং। কাশ্মীরে তিনি শাসন ক্ষমতা পরিচালনা করতে থাকেন। তবে এর মধ্যেই ভারতীয় উপমহাদেশে স্বাধীনতার দাবি আরও জোড়ালো হয়ে পড়ে। ফলে ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশ কে যখন দুটিভাগে বিভক্ত করে স্বাধীনতা দানের সিদ্ধান্ত হয়। তখন কাশ্মীরের মত স্বায়েত্ত্বশাসিত অঞ্চল সমুহের কি হবে। সে ব্যাপের স্পষ্ট কোন নির্দেশনা ছিল না। শুধু বলা হয়েছিল ভারত-পাকিস্তানের বাহিরে যেসন স্বায়েত্ত্বশাসিত অঞ্চল আছে তারা ইচ্ছা করলে এই দুই দেশের কোন একটি তে যোগ দান করতে পারবে বা নিজেরা স্বাধীন হিসেবে থাকতে পারবে। তবে এইসব স্বাধীন হওয়ার রূপরেখা কি হবে তা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। ফলে এই দেশের নাগরিকরা তাদের ভবিষ্যৎ এর ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল না। তাদের এই অনিশ্চয়তার মধ্যেই কাশ্মীরের তৎকালীন রাজা হরি সিং ভারতের সাথে যোগ দানের জন্য মনস্থির করেন। তবে কাশ্মীরের অধিকাংশ জনগণ মুসলিম হওয়ার জন্য প্রায় ৮৫ ভাগ মানুষের ইচ্ছাই ছিল পাকিস্তানে যোগদান করা। তবে যোগ দানের পূর্বেই রাজা ও জনগণের সিদ্ধান্তের এমন দোলাচলের মধ্যেই পাকিস্তানের সমর্থনপুষ্ট পুশতুন জাতিরা কাশ্মীরে বিদ্রোহ করে রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এঅবস্থায় রাজা হরি সিং লর্ড মাউন্ট ব্যাটনের সাহায্য কামনা করেন। এর বিনিময়ে তিনি ২৬ অক্টোবর ১৯৪৭ সালে ভারতের সাথে যোগ দেয়ার ব্যাপারে একটি চুক্তি সাক্ষর করেন।
এই চুক্তির হাত ধরেই ভারত সরকার কাশ্মীরের ভেতর তাদের সেনাবাহিনী প্রেরন করেন। এর জবাব হিসেব পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে কাশ্মীরে পাকিস্থানী সেনাবাহিনীও প্রবেশ করে।ফলে কাশ্মীর দখল নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধের সূচনা হয়ে যায়। এই যুদ্ধ দীর্ঘ চার বছর চলার পর ১৯৫২ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় শান্তি চুক্তি হয়। তখন জাতিসংঘের পক্ষ থেকে গণভোটের আহ্বান জানানো হয়। তবে ভারত এতে বিরোধীতা করে। কারণ ভারত জানত যে গণভোট দিলে পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন যাবে তাই ভারত এটার বিরোধীতা করে। অপরদিকে পাকিস্থানও ভারতের এমন অবস্থানের কারণে কাশ্মীর থেকে সৈন্য উঠিয়ে নেয়নি। ফলে পাকিস্থানী সৈন্যরা যে অংশে ছিল সে অংশে পাকিস্তানের আদিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়। আর এভাবেই কাশ্মীর দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। পাকিস্তানরা যে অংশে অবস্থান নিয়েছিল সে অংশে পাকিস্তানের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। আর বাকি অংশে ভারতের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়।
কাশ্মীর ভাগ হয়ে গেলেও ভারত-পাকিস্তান উভয়েই সম্পুর্ন কাশ্মীর কে নিজেদের বলে দাবী করে। এ নিয়ে ১৯৬৫ এবং ১৯৯৯ সালে দুইবার ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। তাছাড়া ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের সময় ভারত অধ্যুষিত কাশ্মীরের একটি অংশ চীন দখল করে নেয়। যেটি আকসাই চীন হিসেবে পরিচিত। তাই বলা যায় যে এখন পর্যন্ত কাশ্মীর তিনটি অংশে বিভক্ত হয়ে যায়। তবে ভারত -পাকিস্তান অংশে বিভক্ত হওয়া কাশ্মীর ই মুলত আলোচিত কাশ্মীর। কেননা আকসাই চীন(কাশ্মীর) বৌদ্ধ অধ্যুষিত অঞ্চল হওয়ার কারণে তারাও চীনের সাথে থাকতে চায়। তাই সেখানে কোন উত্তেজনা বিদ্যমান নাই। তবে ভারত অধ্যুষিত কাশ্মীর অঞ্চলে তাদের স্বায়েত্ত্বশাসন বাতিল করে দিয়ে কাশ্মীরের উত্তেজনা কে আরও উস্কে দিল ভারত। তবে কাশ্মীরসহ সকল শান্তিপ্রিয় বিশ্ববাসী এই উত্তেজনার একটি স্থিতিশীল সমাধান চায়।
তথ্যসূত্র
১.https://www.britannica.com/place/Kashmir-region-Indian-subcontinent
২.https://www.telegraph.co.uk/news/1399992/A-brief-history-of-the-Kashmir-conflict.html
৩.https://www.thoughtco.com/kashmir-history-and-background-2353435
৪.https://bangla.dhakatribune.com/international
লেখকঃ ফরিদ মোল্লা