সাম্প্রতিক

অভিশপ্ত কারাগার আবু গারিব

সাম্প্রতিক বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৪:৪৮:২২

অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার জন্যে কারাগারের জুড়ি নেই। নিজের কৃতকর্মের শাস্তি ও অপরাধীর চরিত্রকে ধুয়ে মুছে পবিত্র করে দেয়ার চেষ্টায় মূলত কারাগার। অথচ বন্দিদের তার কৃত অপরাধ থেকে শুধরে বের করে আনার পরিবর্তে কারাগারেই যদি বন্দিদের উপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালু হয়ে যায়, তাহলে সেটা আর কারাগার থাকে না, অভিশপ্ত এক বন্দিশালাতে পরিণত হয় । তেমন একটি কারাগার ছিল ইরাকে অবস্থিত ‘আবু গারিব’।

আবু গারিব ইরাকের একটি কুখ্যাত কারাগার। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসাইনের আমলে সেখানে ৫০ হাজার বন্দী ছিল বলেই জানা যায়। বন্দীদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হতো এখানে। এরপর ২০০৩ তিন সালে আমেরিকার আক্রমণে সাদ্দাম হোসাইনের পতন ঘটে। আমেরিকা ইরাকের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা লুটপাট করতে শুরু করে। তন্মধ্যে আবু গারিব কারাগারটিও ছিল। কারাগারটি দখলে নেওয়ার পরে নানা ছলচাতুরী করে কারাগারের রুপ বদলে দেন তারা। প্রবেশদ্বার থেকে সাদ্দাম হোসাইনের ছবি সরিয়ে সেখানে ভিন্ন একটি সাইনবোর্ড স্থাপন করা হয়। তাতে লেখা ছিল, America is the friend of all Iraqi people. কিন্তু বাস্তবে আমেরিকানরা ইরাকের কতোটা বন্ধু ছিলো তার প্রমাণ পাওয়া যায় কিছুদিন পরেই।

ইরাক আমেরিকান সৈন্যদের দখলের আসার পর পরই আমেরিকা ইরাকে তাদের প্রশাসনিক শক্তি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই পরিকল্পনার একটি বিশেষ উদ্দেশ্য ছিলো ইরাকের কারাগারগুলোতে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ধরে ধরে নিয়ে আসা। যেমন ভাবনা তেমনই কাজ। ধীরে ধীরে হাজার হাজার নারী পুরুষকেকে ধরে আনা হলো। দিনের পর দিন তাদের উপর চালানো হলো অমানবিক অত্যাচার।

আবু গারিব ইরাকের রাজধানী বাগদাদ থেকে ২০ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত। মার্কিন অগ্রাসনের সময় এটিকে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে নতুন করে তৈরি করা হয়।

২০০৪ সালের এপ্রিল মাসের দিককার ঘটনা।
বিখ্যাত টিভি চ্যানেল সিবিএস এর প্রতিবেদনে প্রকাশ পায় কিছু ভিডিও ও স্থিরচিত্র। মুহুর্তেই তোলপাড় শুরু হয়। কারণ এই স্থিরচিত্র গুলো ছিলো আবু গারিব কারাগারের নির্মম, অবর্ণনীয় অত্যাচারের নিদর্শন। ছবি আর ভিডিওগুলোতে স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে মার্কিন সৈন্যদের দ্বারা বন্দীদের সাথে করা অমানবিক অত্যাচারের চিত্র।  যদিও বেশ কিছু মাস আগে থেকেই মানবাধিকার সংগঠন "এমনেস্টি" আবু গারিবের বিষয়ে বেশ কিছু ক্যাম্পেইন করছে কিন্তু তা যে এত ভয়াবহ ছিল, তা ধারণাও করতে পারেনি।

যদিও ২০০৪ এর জানুয়ারিতে যখন মেজর জেনারেল এন্টোনিও এম টাগুবা আবুগারিবের  তদন্ত করতে আসেন, তখন পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হয়৷ মার্চের শুরুতে যখন টাগুবার তদন্ত শেষ হয়, তখন সকল অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হয় এবং ছয়জন সৈন্যের বিরুদ্ধে কারাবন্দীদের সাথে অন্যায় আচরণ করার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়। কিন্তু নির্যাতনের আসল ছবি ও তথ্য জনগনের কাছ তখনো গোপন রাখা হয়। তা অবশ্য ২৮ এপ্রিল ২০০৪ পর্যন্তই।

 এরপর ইউএস প্রতিরক্ষা সেক্রেটারি কংগ্রেসে এই রিপোর্ট এর বিস্তারিত তুলে ধরেন। সেই সাথে সিবিএসও তাদের ডকুমেন্টারি প্রকাশ করে। সাথে সাথেই প্রকাশ হয়ে যায় আমেরিকান সৈন্যরা ঠিক কতটা নিষ্ঠুরতর আচরণ করতো কারা বন্দীদের সাথে।  আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে বন্দীদের বেশিরভাগই, প্রায় ৭০-৯০% ছিল নিরপরাধ ইরাকের নাগরিক যারা ভুলক্রমে বা শুধুমাত্র সন্দেহের বশেই তাদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে।

আবু গারিব কারাগারে তিন ধরনের বন্দীদের আটক রাখা হয়।
১। সাধারণ চোর-ডাকাত।
২। বিভিন্ন বিদ্রোহী গ্রুপের নেতা এবং
৩। মার্কিন বাহিনীর ওপর হামলাকারী বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য।

এই তিন শ্রেণীর অন্তর্গত লোকেদের জন্যে যদিও এটি ব্যবহার করা হয় বলেই মার্কিন সেনারা প্রচার করে কিন্তু বাস্তবে বন্দীদের মধ্যে ৭০-৮০ শতাংশই ছিল নিষ্পাপ এবং সন্দেহের বশে আটককৃত। বন্দীদের মার্কিন আর্মি এবং সিআইএ’র সদস্যরা বিভিন্নভাবে শারীরিক নির্যাতন, যৌন হয়রানি, অত্যাচার, ধর্ষণ এবং হত্যা করতো। এই কারাগারের প্রধান কমান্ডার ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কারপিনস্কি। যিনি পূর্বে কখনো কোনো কারাগারের দায়িত্বে ছিলেন না।

এরই মধ্য সিবিএস ভাবলো এই অন্যায় আর গোপন রাখার মত নয়। পৃথিবীর মানুষকে এটি জানানোর সময় এসেছে। আর তাই তৈরি হল বিখ্যাত ডকুমেন্টারি – "সিক্সটি মিনিটস" (sixty miutes)। এই বিখ্যাত ডকুমেন্টারির মাধ্যমেই সমগ্র দুনিয়া জানতে পারলো আসলে কি হয়েছে সেই কারাগার নামের মরণ কূপের মাঝে। দৃশ্যগুলি এতটাই ভয়াবহ ও বিভৎস ছিল যে বিশ্বের সকল বিবেকবান মানুষের আত্মাকে তা নাড়িয়ে দেয়। এত নিষ্ঠুরভাবেও যে মানুষ মানুষকে নির্যাতন করতে পারে তা বিশ্ববাসীর জানা ছিল না। কেউই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। ছবিগুলো আমেরিকা এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আলোচনার ঝড় তোলে। চারদিক থেকে সমালোচনা ধেয়ে আসতে থাকে নির্যাতনকারী সৈন্যদের দিকে। একে একে বেরিয়ে আসে কারাগারে ইরাকি বন্দিদের সাথে ঘটে যাওয়া নৃশংস অনেক ঘটনা।

কিন্তু এতো নির্মম হত্যাকান্ডের পরও আমেরিকার বেশ কিছু গণমাধ্যম নির্যাতনকারী সৈন্যদের পক্ষেই কথা বলে যায়। বেশ কিছু মিডিয়া সেনাদের যাবতীয় কার্যাবলীর পক্ষে সমর্থন দেন। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ এসব নির্যাতনের ছবিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দেন এবং এগুলো আমেরিকান বাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের নিছক ভুলের ফসল বলে দাবি করেন।

এই ঘটনার জের ধরে আমেরিকান প্রতিরক্ষা দপ্তর ১৭ জন সৈন্য এবং অফিসারকে বাহিনী থেকে অপসারণ করে। কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। কিন্তু এসব কিছুই যেন শুভঙ্করের ফাঁকি। অনেকটা লোক-দেখানো। কারণ বন্দী-নির্যাতনের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠা উচ্চপদস্থ অনেক কর্মকর্তাই থেকে যায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

কারাবন্দীদের উপর চালানো কিছু কিছু নির্যাতনের উদাহরণ হলঃ

বন্দীর শরীরে এক টুকরা কাপড় জড়িয়ে মাথায় কালো হুড পরিয়ে দিয়ে হাত-পায়ের আঙুল ও পুরুষাঙ্গে ইলেক্ট্রিক তার লাগিয়ে একটি সরু বক্সের উপর অনির্ধারিত সময়ের জন্য দাঁড় করিয়ে রাখা। বক্স থেকে পা ফঁসকে পড়ে গেলেই ইলেক্ট্রিক শকে মৃত্যু হবে হতভাগ্য বন্দীর।

বন্দীদের উপর রাসায়নিক বাতি ভেঙ্গে ফসফরাস জাতীয় তরল তাদের গায়ে ঢেলে দিয়ে বন্দীদের নগ্ন করে ঠান্ডা পানি ঢেলে দিয়ে চেয়ার, বা কাঠের হাতল দিয়ে মারপিট করা পুরুষ বন্দীদের ধর্ষণের হুমকি দেয়া হতো।

অনেক পাশবিক উপায়ে যৌন নির্যাতন করা হয় বন্দীদের। কমবয়সী কিশোরদের আমেরিকান সৈন্যরা সবার সামনে নির্মমভাবে ধর্ষণ করত। এছাড়াও পুরুষদের পুরুষাঙ্গে ভারী বস্তু ঝুলিয়ে দিতো। এবং টিউব লাইট ও পাইপজাতীয় বস্তু পশ্চাদ্দেশে প্রবেশ করানো হতো।

সাইদ আল-শেইখ নামক এক ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে নগ্ন করে তাঁর শরীরের পেছনের অংশে একটি মেয়ের প্রতিকৃতি এঁকে তাঁকে সকলের সামনে বাধ্যতামূলক দাঁড় করিয়ে রাখা হয় বলে তিনি জানিয়েছিলেন।

যে নারী বন্দিদের ধর্ষণ করা হতো এদের মধ্যে যারা পরবর্তীতে গর্ভবতী হয়ে পড়তো তাদের "অনার কিলিং" এর নামে হত্যা করা হতো।

 একজন বন্দীকে দেয়ালের সাথে ধাক্কা দিয়ে আহত করে পরে আবার তাদেরই পাহারাদার দিয়ে ক্ষত সেলাই করানো হয়েছিল বলেও জানা যায়।

অনেক সময় বন্দীদের কুকুর লেলিয়ে দিয়েও ভয় দেখানো হতো।

২০০৩ সালের ৪ নভেম্বর মানাদিল আল জামাদির নামে এক বন্ধীর মৃত্যু ঘটে আবু গারিব কারাগারে। আবু গারিব কারাগারে ঘটে যাওয়া নির্যাতন সম্পর্কে তদন্ত করতে গিয়ে জানা যায়, নেভি সিলের একটি দল মানাদিলকে আবু গারিব কারাগারে ধরে আনে। এ সময় তাঁর মুখ একটি বালুর বস্তা দ্বারা ঢাকা ছিল। কারাগারে আনার পরপরই শুরু হয় নির্যাতন। নেভি সিলের সদস্যরা অনবরত তাঁকে ঘুষি মারছিল, কেউ একজন তাঁর গলা টিপে ধরে এবং তাঁর চোখে আঙুল ঢুকিয়ে দেয়। নির্যাতনের প্রতিবাদ করতে গেলে একজন তাঁর মাথায় বন্দুকের বাট দিয়ে সজোরে আঘাত করে।

প্রথম দফা নির্যাতনের পর মানাদিলকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি গোসল খানায়। সেখানে সিআইএ এবং আর্মি ইন্টিলিজেন্সের কয়েকজন সদস্য তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। জিজ্ঞাসাবাদ শুরুর অল্প সময়ের মধ্যেই মানাদিল আল-জামাদির মৃত্যূবরণ করেন।

মৃত্যুর পরে অন্যতম নৃশংসতার পরিচয় দিয়ে মানাদিলের লাশের পাশে মার্কিন সার্জেন্ট চার্লস গ্র‍্যানার হাসিমুখে ভিক্টরি সাইন দেখিয়ে ছবি তুলেন। সার্জেন্টের এই উল্লাস তাঁর বুদ্ধি, বিবেক, তার কর্তব্য ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করে। কি করে মানুক এতোটা বর্বর পৈচাশিক হতে পারে তা কল্পনাতেও আনা যায়না। জেলে থাকাকালীন কোনো কয়েদীকেই এমন বর্বর শাস্তি প্রদান করা যায় না। কোনো কিছুতেই মার্কিন সেনাদের এমন কর্মকাণ্ড সামরিক হতে পারে না। রুচিবিকৃত, অসভ্য মানুষ ছাড়া আর কেউ এমন অমানবিকতার পরিচয় দিতে পারে না।

অবশেষে ২০০৬ সালে ইরাকি কর্তৃপক্ষের হাতে হস্তান্তর করা হয় আবু গারিব কারাগার। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দায়িত্ব গ্রহণের কিছুদিন পর ২০০৯ সালে নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হয় সেখানে। এই অভিশপ্ত কারাগারটি ২০১৩ সালে পুরোপুরি বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

 

https://en.wikipedia.org/wiki/Abu_Ghraib_torture_and_prisoner_abuse#Prisoner_abuse

https://www.youtube.com/watch?v=MQ0x5ZLbeqQ

https://web.archive.org/web/20040512063302/http://www.rotten.com/library/crime/prison/abu-ghraib/

লেখকঃ এস এম সজীব