সাম্প্রতিক

জার্মান স্ত্রীদের সাহসী পদক্ষেপে ২য় বিশ্বযুদ্ধে প্রাণে বেচে যায় ইহুদী স্বামীরা।

সাম্প্রতিক রবিবার, ২১ জুলাই ২০১৯ ০২:৩১:১২

স্বামীর প্রতি অনন্য ভালোবাসার নিদর্শন শুধুমাত্র মনষামঙ্গল কাব্যে বেহুলা আর লক্ষীন্দরের জীবন কাহিনীতেই নয় বাস্তব ইতিহাসেও বেশ ভালো ভাবে লক্ষণীয়। স্বামীর প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসার অনন্য দৃষ্টান্ত রেখেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান নারীরা। তখনকার সময়ে অনেক সাধারণ মেয়েই ভালোবেসে স্বামী হিসেবে বেচে নিয়েছিলেন ইহুদী পুরুষদের। এবং ইহুদী স্বামীদের রক্ষার জন্য “প্রতিবাদই” অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন জার্মান রমণীরা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বলতেই জার্মান হিটলার বাহিনীর ইহুদী নিধনের কথা মাথায় আসে। বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকেই নৎসি বাহিনী একচেটিয়া ইহুদীদের হত্যা,কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে গিয়ে নির্মম হত্যাকান্ড শুরু করে। যুদ্ধের অনেক আগে থেকেই জার্মানিতে আর্য-জার্মানি ছাড়াও ইহুদীদের বসবাস ছিলো। সে সব ইহুদীদের সাথে জার্মান নারীদের বৈবাহিক সম্পর্ক ঘড়ে উঠতে থাকে দারুণ ভাবে। এই বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে নৎসি বাহিনীরা বিপাকে পড়ে যায় ইহুদী জার্মানদের শাস্তি প্রদানে। কারণ এসব ইহুদীরা আর্য জার্মানি নারীদের সাথেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ।

হিটলারের নাৎসি বাহিনীর আক্রমণে ইউরোপের একের পর এক দেশ বিধ্বস্ত হচ্ছিলো। এরপর শুরু হয় সেখানে অবস্থানরত ইহুদিদের উপর নারকীয় হত্যাকান্ড। কোনো ইহুদী পরিবারকেই রেহাই দেয়া হচ্ছিলো না। এমনি দুর্বিষহ অবস্থায় জার্মানির বিভিন্ন শহরে বসবাসরত ইহুদীদের অবস্থাও যে খুব একটা ভাল ছিল না। তাদেরকেও চেষ্টা করা হয়েছিল কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানোর, যদি না তাদের জার্মান স্ত্রীরা এই বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের দেওয়াল তুলে না দিতেন। যদি জার্মানির সব স্ত্রীরা স্বামীদের প্রান রক্ষার্থে রাস্তায় বেরিয়ে না পড়তো, যদি প্রতিবাদ গড়ে না তুলতো তবে আরো শতশত ইহুদির মৃত্যুপুরি তৈরী হতো।

চারদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দাবালন জ্বলছে। ফেব্রুয়ারি-মার্চে দিকে বার্লিন শহরে তখন বেশ ঠান্ডা। খুব তুষারপাত হচ্ছিলো শহরে। এই সময়টায় বার্লিনের আবহাওয়া সাধারণত এমনই হয়ে থাকে। প্রচন্ড ঠান্ডার কারণে শহর জুড়ে চাঞ্চল্য ছিলো না। সব থমথমে ছিলো। কিন্তু শহরের অস্বাভাবিকতা চোখে পড়ছে শুধুমাত্র ‘রোজেনস্ট্রসে’ থাকা ইহুদীদের এক কমিউনিটি সেন্টারে। সেখানে প্রায় দুই হাজার ইহুদী পুরুষকে ধরে আনা হয়েছে। এদের মধ্যে কাউকে বাড়ি থেকে, রাস্তাঘাট থেকে, অফিস থেকে ধরে আনা হয়েছিলো। এরপর তাদের একটি কমিউনিটি সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয় ট্রাকে করে। যেটি বার্লিন শহর থেকে খানিকটা দূরে অবস্থিত।

রোজেনস্ট্রসে এসব ইহুদীদের ভয়াবহ কড়াকড়ির মধ্যে দিয়ে রাখে গেস্টাপো বাহিনী। ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় তাদের প্রাণ যায় যায় অবস্থা। হিটলারের ‘থার্ড রাইখ’ এসব ইহুদীদের মানুষই ভাবতেই রাজি না। কিন্তু বিপত্তি হচ্ছে এদের স্ত্রীরা আর্য জার্মান। তাই গেস্টাপো বাহিনী অন্যান্য সাধারণ ইহুদীদের মত করে এদের ব্যবহার করতে পারছে না। এদের কি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হবে, নাকি কোনো লেবার ক্যাম্পে পাঠানো হবে প্রাণঘাতী পরিশ্রমের জন্য? গেস্টাপোর সদস্যরা অস্থির হয়ে উঠেছিল এদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য।এসব জার্মান ইহুদীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে তাই জন্যে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় জার্মান সৈন্যরা।

এসব ইহুদীদের ভাগ্যটা অন্যদের চেয়ে একটু ভালোই বলা যায়। কারণ তারা ‘আর্য’ জার্মান মহিলাদের বিয়ে করেছেন। আবার কারও মা ‘আর্য’ জার্মান। এই ‘আর্য’ মহিলাদের সাথে সম্পর্ক থাকার কারণেই এসব ইহুদীদের এতদিন বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। হিটলারের গেস্টাপো বাহিনী অপেক্ষা করেই যাচ্ছে উর্ধ্বতন কর্তপক্ষ থেকে পরবর্তী নির্দেশের জন্য।


এর পরেই আসে সেই মহেন্দ্রক্ষণ। এর মধ্যেই রোজেনস্ট্রসের সেই কমিউনিটি সেন্টারে ভিড় করতে থাকে সেসব জার্মান গৃহবধূরা। প্রথমদিকে অল্প কয়েকজন এসেছিল শুধুমাত্র তাদের স্বামী, সন্তানদের অবস্থা জানার জন্য। পরে ভিড় বাড়তে থাকে। সঙ্গে তাদের পরিবার-পরিজন। একশো, দেড়শো, দু'শো, পরে একসময় হাজার ছাড়িয়ে গেল রোজেনস্ট্রসের রাস্তায়। স্বামী-সন্তানদের ফিরিয়ে দেয়ার জন্য আকুতি জানাতে লাগলো তারা। কোনো সংবাদ না পেয়ে নানা আশঙ্কায় ভুগছিলো পরিবারগুলো। প্রশাসন থেকে কোনো তথ্য না পাওয়ায় তাদের উদ্বেগ দিন দিন বাড়তে থাকে। তাই নিশ্চিত হওয়ার জন্য একজন, দুজন করে সেই জার্মান গৃহবধূ এবং তাদের পরিবাররা ভিড় জমাতে থাকলেন সেন্টারের সামনে।


প্রথমদিকে জার্মান নারীরা কোনো প্রতিবাদের ভাবনা থেকে রোজেনস্ট্রসের সেই কমিউনিটি সেন্টারে জমায়েত হননি। উদ্দেশ্য ছিল তাদের ইহুদী স্বামী-সন্তানরা কেমন আছে তা জানা, আর পারলে তাদেরকে সেখান থেকে মুক্ত করে বাড়ি নিয়ে যাওয়া। শীতের প্রকোপ উপেক্ষা করে দিন-রাত সেই কমিউনিটি সেন্টারের রাস্তায় পড়ে থাকতে শুরু করেন সেই জার্মান বধূরা।


ফলে ধীরে ধীরে ক্ষোভ বাড়তে থাকে জার্মান নারীদের এই জমায়েতের খবর তখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে। জার্মান সমাজে এর প্রভাবও পড়তে থাকে। ফলে কমিউনিটি সেন্টারের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া বসানো হলো। সশস্ত্র সেনাদের টহলও বাড়ানো হতে থাকে। সাথে সাথে প্রতিবাদকারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে।

জার্মান সেনারাও বসে নেই। তারা ভয় দেখানোর জন্যে নিরস্ত্র মহিলাদের দিকে সরাসরি মেশিনগান তাক করলো। মাইকে ঘোষণা করা হলো রাস্তা খালি করে দেওয়ার জন্য। সবাইকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য বলা হলো, -না হলে গুলি চালানো হবে বলে ভয় দেখানোর চেষ্টা করা হলো।
কিন্তু এই ঘোষণায় ফল হলো উল্টো। হাজারো নারী কন্ঠে আওয়াজ উঠলো, "খুনি, খুনি..."।

এদিকে বিভিন্ন জায়গায় মিত্রবাহিনীর কাছে জার্মান সেনাদের পরাজিত হওয়ার খবর আসছে। এরই মধ্যে প্রায় ১০ লক্ষ জার্মান সেনার মৃত্যু হয়েছে। এ মুহূর্তে নিজ দেশের খাঁটি জার্মানদের ওপর গুলি চালালে এর ফল যে ভয়াবহ হবে তা বেশ বুঝতে পেরেছিলেন গোয়েব্‌লস। তাই তিনি কোনো ঝুঁকি নিতে চাইলেন না।

বন্দিদের মুক্তি দেয়ার নির্দেশ দিলেন গোয়েব্‌লস। তবে পরে সুযোগ মতো এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মুক্তি দেয়ার পূর্বে এই ইহুদীদের পরিচয় খাতায় লিখে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। ১২ মার্চের মধ্যে ২৫ জনকে বাদ দিয়ে বাকি সব বন্দীকে মুক্তি দেয়া হয়। ঐ ২৫ জনকে পাঠিয়ে দেয়া হয় অসউইৎজ ক্যাম্পে। মুক্তি পাওয়ার পর ইহুদি স্বামী-সন্তানদের নিয়ে বাড়ি ফিরলেন জার্মান মহিলারা। প্রতিবাদের এক অসাধারণ নজির স্থাপন করলেন তারা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ কথা জানা যায় যে, জার্মানির অভ্যন্তরে যে ইহুদীরা বেচে গিয়েছিলো তাদের মধ্যে বেশিরভাগ ইহুদীই প্রাণে বেচে গিয়েছিলো তাদের জার্মানি স্ত্রীদের কারণে। জার্মান গৃহবধূদের প্রতিবাদ আর সাহসের ফলেই তাদের ইহুদী স্বামী-সন্তানেরা রক্ষা পেয়েছিলেন। জার্মানিতে প্রায় ৭৭,০০০ জার্মান নাগরিক বিভিন্ন সময়ে হিটলারের বাহিনীর হাতে নিহত হয়। নাগরিক সমাজের মধ্যে কোনো প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ না হওয়ার কারণে হিটলার এতটা নির্মম হতে পেরেছিলেন বলে তারা মনে করেন।

বর্তমানে রোসেনস্ট্রসের সেই কমিউনিটি সেন্টার কোনো অস্তিত্ব আর নেই। তবে সেই ঐতিহাসিক ঘটনাকে ইতিহাসের পাতায় ধরে রাখার জন্যে, জার্মানি নারীদের অপার ভালোবাসার স্মৃতিকে ধরে রাখতে ১৯৯৫ সালের সেই রোসেনস্ট্রেসের কমিউনিটি সেন্টারের খানিকটা দূরেই নির্মিত হয় একটি স্মৃতিস্তম্ভ। জার্মান ভাষায় এই নাম দেওয়া হয় “ block der frauen”. বাংলায় অনুবাদ করলে যার অর্থ হয় নারীদের প্রতিরোধ।
এভাবেই ইতিহাস হয়ে আছে জার্মান নারীদের প্রতিরোধের গল্প। নারীদের সাহসিকতার গল্প। স্বামীদের রক্ষা করার জন্যে অভাবনীয় পদক্ষেপের গল্প।

রেফারেন্সঃ https://timeline.com/rosenstrasse-protest-world-war-2-ce3c2bfb3033  

লেখকঃ এস এম সজীব