সাম্প্রতিক

ইরাক যুদ্ধের কান্না ও একটি চিলকট রিপোর্ট

সাম্প্রতিক সোমবার, ২৪ জুন ২০১৯ ০৮:৪৭:৩৩

উপসাগরীয় যুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়ে ইরাকের সামরিক শক্তি তখন নাজুক হয়ে পড়েছিল৷ এমন অবস্থায় সাদ্দাম হোসেনের ইরাক বাহিনীর কোন সামর্থ্য ছিল না অন্য কোন রাষ্ট্রের উপর সামরিক পদক্ষেপ নেয়ার। তাছাড়া ইরাকের কুয়েত আগ্রাসন বিশ্বজুড়ে সমালোচনা আর নিন্দার ঢেউ বইয়ে দিয়েছিল। সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে প্রভাবশালী সব দেশ কুয়েতকে মুক্ত করেছিল৷ এমন অবস্থায় নতুন করে সামরিক আক্রমণ কিংবা গণবিধ্বংসী অস্ত্র উৎপাদনের মত অবস্থায় ছিল না ইরাক। তার পরেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ এবং ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার দাবি করে বসেন ইরাকের কাছে গণবিধ্বংসী রাসায়নিক অস্ত্র আছে এবং তারা তা উৎপাদন করছে।  শুধু উৎপাদন নয় তারা এই অস্ত্র দিয়ে যেকোন সময় মধ্যপ্রাচ্য কিংবা ইউরোপে হামলা চালাতে পারে। আর তার জন্য সবচেয়ে হম্বিতম্বি করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। ইরাকের উপর হামলা চালানোর নানান বাহানা খুঁজতে থাকেন তিনি। আর এ কাজে তাকে যথাযথ সাহায্য করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার।  ব্লেয়ার তাকে এও নিশ্চিত করেন যেকোন কিছু হলেও তিনি বুশের পাশে থাকবেন।
ইরাকে হামলা চালানোর বৈধতা আদায় করতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দেন বুশ। আর এজন্য তিনি  কোয়ালিশন অফ ন্যাশনস নামের বহুজাতিক সামরিক জোট। কিন্তু ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর 'না' এবং জাতিসংঘের অনুমোদনের অভাবে এই যুদ্ধ হয়ে উঠে একান্ত যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান যুক্তি ছিল তাদের গোয়েন্দা বিভাগ জানতে পেরেছে যে ইরাকের কাছে সভ্যতা বিনাশী মারণাস্ত্র আছে এবং যেকোন সময় এই অস্ত্র প্রয়োগ করে ইউরোপে হামলা চালানো হতে পারে। মৃত্যু হতে পারে অসংখ্য মানুষের। তাই আগেভাগেই সামরিক আক্রমণ করে ইরাককে তার কথিত দুরভিসন্ধি থেকে নিবৃত্ত করতে হবে। আমেরিকার দেখাদেখি ব্রিটেনও একই মত প্রকাশ করে।  প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে নিজ দেশের গোয়েন্দা তথ্যের বরাত দিয়ে দাবি করেন ইরাকের কাছে যেসব মারণাস্ত্র আছে তা দিয়ে দেড় ঘন্টার মধ্যে ইউরোপে হামলা করা যাবে। সংসদে কেউ কেউ ভিন্নমত পোষণ করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন নিয়ে ইরাকে হামলার বৈধতা দেয়া হয়। জাতিসংঘের নিষেধ এবং অপরাপর ইউরোপীয় দেশের অস্বীকৃতিকে পাশ কাটিয়ে ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে ইরাকে হামলা করে। পরবর্তীতে এ যুদ্ধে অস্ট্রেলিয়াও যোগ দেয়। ২০০৩ সালের এ অসম যুদ্ধে প্রায় দেড় লাখ ইরাকি নিহত হয়, দশ লাখ হয়ে পড়ে বাস্তুহারা। বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা এবং অবকাঠামো ধ্বংস করে দেয়া হয়।

চিলকট কমিশন এবং একটি অন্যায় যুদ্ধ!

২০০৩ সালের এ যুদ্ধ নিয়ে সে সময়েই সন্দেহ এবং বৈধতার প্রশ্নে শক্ত সন্দেহ জারি ছিল। ইরাকি জনগণ ছাড়াও অনেক ব্রিটিশ সৈন্যও সে যুদ্ধে নিহত হয়েছিল। অসম এ যুদ্ধের ছয় বছর পর ২০০৯ সালে ব্লেয়ারের উত্তরসূরি গর্ডন ব্রাউন এ যুদ্ধের তদন্তে হাত দেন৷ এজন্য তিনি সাবেক এক সরকারি কর্মকর্তাকে প্রধান করে একটা কমিশন গঠন করেন। স্যার জন চিলকট এর নামানুসারে এই কমিশন পরিচিতি পায় চিলকট কমিশন নামে। প্রায় সাত বছরের দীর্ঘ তদন্তে এ কমিশনকে নানাভাবে বাধা দেয়া হয় প্রকৃত তথ্য যাতে উন্মোচন না করা হয়। শেষ পর্যন্ত ২০১৬ সালের ৬ জুলাই প্রায় ১০০ জনের সাক্ষ্য, প্রমাণ এবং শুনানি শেষে The iraq inquiry  নামের আট হাজার পৃষ্ঠার রাষ্ট্রীয় গোপন নথিপত্র সম্বলিত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এই প্রতিবেদন প্রকাশের পরই বিশ্বজুড়ে সাড়া পড়ে যায়। ২০০৩ সালের ইরাক আক্রমণকে সরাসরি অবৈধ না বললেও এ কমিশন চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এ হামলার আইনগত কোন ভিত্তি ছিল না। যেসব গোয়েন্দা তথ্যকে সূত্র হিসেবে ধরা হয়েছিল তা ছিল যথেষ্ট দুর্বল। প্রতিবেদনে বলা হয় সাদ্দাম হোসেন তখন এমন কোন হুমকি ছিলেন না যে সামরিক পদক্ষেপ অবশ্যম্ভাবী ছিল। চিলকট রিপোর্টে বলা হয়েছে শান্তিপূর্ণ সব উপায়কেই উপেক্ষা করে সামরিক পদক্ষেপ নেয়ার তোড়জোড় করা হয়েছিল। যেটি ছিল অপ্রয়োজনীয়। ইরাকের কাছে থাকা সমরাস্ত্র বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকি এমন দাবিকেও ভিত্তিহীন হিসেবে প্রমাণ করা হয় ঐতিহাসিক এ রিপোর্টে। ইরাক ইনকোয়ারি প্রকাশের অব্যবহিত পরেই তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী নিজের ভুল স্বীকার করে বলেন, তার উচিত ছিল গোয়েন্দা তথ্যের সঠিকতা যথাযথভাবে নিরূপণ করা

ব্রিটেন ও আমেরিকার ভুল কিংবা ইচ্ছাকৃত আগ্রাসন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিকে পালটে দিয়েছিল। বিশ্বব্যাপী অশান্তি আর যুদ্ধের পেছনে ২০০৩ সালের ইরাক আক্রমণ পরোক্ষভাবে দায়ী। আর এজন্য হামলার দুই হোতা ব্লেয়ার এবং বুশের বিচার দাবিতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শ্লোগান তুলা হচ্ছে। হয়তো এদের বিচার হবে কিন্তু ইরাকের নিরাপদ লাখ লাখ নাগরিক আর তাদের সুখী দেশ, রাজনীতি, স্থিতিশীল মধ্যপ্রাচ্য কি ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব? প্রশ্ন রইল।

লেখকঃ উবায়দুর রহমান রাজু