
জনস্টাউন ম্যাসাকারঃ একদিনে প্রায় এক হাজার মানূষের আত্মহত্যা।
জনস্টাউন ম্যাসাকারঃ একদিনে প্রায় এক হাজার মানূষের আত্মহত্যা।
ভাবা যায়! প্রায় এক হাজার মানুষ একদিনে একসাথে সামান্য ঘটনার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলো। এ ঘটনা যেনো একটা দূর্দান্ত সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। ১৯৭৮ সালের ১৮ নভেম্বর দিনটিকে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের একটি ভয়াবহ কালো দিন হিসেবে ধরা হয়। দক্ষিন আমেরিকার গায়ানার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে একজন গির্জার প্রতিষ্ঠাতা জিম জন্স তার অনুসারীদের বাধ্য করে সায়ানাইডের মাধ্যমে আত্মহত্যা করতে। এদের মধ্যে অনেকে স্বেচ্ছায় আত্মহত্যা করে, অনেককে জোর পুর্বক আত্মহত্যা করানো হয়। সেই দিনেই ৯০৯ জন মানুষ মারা যায়, যার এক তৃতীয়াংশই শিশু।
যুক্তরাষ্ট্রে তখনো বর্নবাদ প্রথা চরমে। জিম জন্স ইন্ডিয়ানাপোলিতে একটি গির্জা প্রতিষ্ঠা করেন। জিম জন্স তার সহজাত আচরণে সাধারণ মানুষদের মুগ্ধ করে নিতেন খুব সহজেই। তার উওর তিনি তার প্রতিষ্ঠিত গির্জায় সাদা কালো বর্ণের সকলের জন্য সমান সুযোগ করে দেন। বর্ণবাদমুক্ত একটি সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখান সকলকে। তার এ ধারণা সবাইকে খুব বেশি আগ্রহান্বিত করে তোলে। সকলে নির্দ্বিধায় গির্জায় আসতে পেরে জন্স এর সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, এবং জন্স ক্রমেই ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। এই সুযোগে জন্স সবাইকে নিয়ে আলাদা একটি সমাজ গড়ার কথা ভাবেন, যেখানে সাদা কালো কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। এতে সাধারণ মানুষের ব্যাপক সাড়া পেতে শুরু করেন তিনি।
তার চিন্তামতো ১৯৭৩ সালে জন্স গায়ানার কিছু খাস জমি ইজারা নিয়ে সেখানে তার পরিকল্পিত সমাজ গড়েন। ইজারা নেয়া জায়গার জংগল কেটে পরিষ্কার করে সেখানে নতুন সমাজ গড়েন। কিন্তু সেখানে প্রাণের চাঞ্চল্য আর সুযোগ সুবিধা বলতে তেমন কিছুই ছিলোনা।
জোন্সের সমাজে এক সময় কিছু লোকজন পরিশ্রম করতে করতে ক্লান্ত হয়ে তার সমাজ থেকে বের হয়ে যেতে চাইছিলেন। কিন্তু স্বভাবতই তিনি সেখান থেকে কাউকে বের হতে দিতে চাইতেন না। গ্রামের বাইরে সশস্ত্র রক্ষীবাহিনী থাকায় সাধারণের পক্ষে তা সম্ভবও ছিলোনা। বাইরের দুনিয়াকে দেখানোর জন্য যাজক সব করতে রাজি ছিলেন। বিপত্তি বাঁধে তখনই, যখন পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে দেশটির কংগ্রেস ম্যান লিও রায়ানসহ কয়েকজনের প্রতিনিধি দল জন্স টাউনে এলে। তখন প্রথম অবস্থায় সব স্বাভাবিক দেখালেও রাতে একটি চিরকুটে পাওয়া গেলো তাদের নামে, যারা এই সমাজ থেকে বের হতে চায়।
পরদিন লিও রায়ান ফিরে যাওয়ার সময় যারা এখান থেকে চলে যেতে চায় তাদের সাথে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন প্রতিনিধি দলের মনে হতে থাকে নিশ্চয়ই আরো কেউ ফিরে যেতে চায়। জানতে চাওয়া মাত্রই আরো কিছু মানুষ তাদের সঙ্গী হয়। তা দেখে পেছন থেকে সশস্ত্র গার্ডরা আক্রমণ করে বসে। ভয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে প্রতিনিধিদল। আর পেছনে পড়ে থাকে হতভাগ্য মানুষের দল। এয়ারপোর্টে এসেও রক্ষা পায়নি কেউ কেউ। সশস্ত্র গার্ডরা সেখানেও তাদের উপর হামলা চালায়। এতে সেখানে হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় যাজক বুঝতে পারেন এর জন্য তাকে খেসারত দিতে হবে। তাই তিনি সকল গ্রামবাসীকে বোঝান সেনাবাহিনী এসে তাদের ও তাদের সন্তানদের উপর নির্যাতন করবে।
সেনাবাহিনীর নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে এই গ্রামের সকলকে জড়ো করে তিনি তাদের আত্মহত্যা করতে উৎসাহিত করেন। আত্মহত্যার জন্য তাদের সকলের সামনে সায়ানাইড রাখেন।
সবাই আত্মহত্যা করতে সম্মতি প্রকাশ না করলেও সেখানকার যারা আত্মহত্যা করতে ইচ্ছুক তারা সকলে প্রথমে শিশুদের শরীরে সিরিঞ্জের মাধ্যমে সায়ানাইড দেয়, সাথে সাথেই মুত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সকল শিশু। বড়দের মধ্যে যারা আত্মহত্যা করতে আগ্রহী না তাদের বাধ্য করা হয় বিষ পান করতে। সবমিলিয়ে ২৭৬ জন শিশুসহ মোট ৯১৪ জন লোকের মৃত্যু হয় এই বিষপান ও সায়ানাইডে। তবে যাজক জন্স নিজে বিষ পান করেননি, তার মাথায় গুলি পাওয়া গিয়েছিল। এই গুলিটি তিনি আত্মহত্যার জন্য করেছিলেন নাকি অন্য কারোর দ্বারা ঘটেছিলো তা জানা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের মর্মান্তিক এই ঘটনাটি আজো মানুষের উপর মানুষের বিশ্বাস নিয়ে ব্যবসা করার কথা মনে করিয়ে দেয়। যারা ক্ষমতার লোভে অন্যের জীবন কেড়ে নিতে দ্বিধাবোধ করেনা।
পরদিন গায়ানিজ প্রশাসন জন্সটাউনে প্রবেশ করার পূর্বেই সকলে আত্মহত্যা করে নেয়। প্রশাসন এখানে এসে খুঁজে পান শত শত মৃতদেহ। যদিও পরবর্তীতে যানা যায় এই মৃত্যুকূপ থেকে অল্প সংখ্যক কিছু মানুষ পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে জোন্সের সন্তানও ছিলো। যদিও জোন্সের সন্তান এই ভয়াবহতার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। জন্সটাউনে বেঁচে যাওয়া তিনজন এর স্বাক্ষ এবং উদ্ধারকৃত টেপ থেকে জানা যায় জন্সটাউনে গনআত্নহত্যার উদ্দেশ্য ছিল তাদের মৃত্যুর মাধ্যমে নিজেদের নির্দোষ প্রমান করা ও পিপল টেম্পলের আদর্শকে বাচিয়ে রাখা ।
তথ্যসূত্রঃ https://www.history.com/this-day-in-history/mass-suicide-at-jonestown
লেখকঃ এস এম সজীব