সাম্প্রতিক

উইঘুর: চীনে নির্যাতিত মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাহিনী।

সাম্প্রতিক শনিবার, ১৮ মে ২০১৯ ০৭:৪৮:৪০

পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই নানা ধরনের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে এইসব সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রাষ্ট্রের মুলধারার নাগরিক ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নানা শোষন বঞ্চনার শিকার হন। তবে এই শোষন বঞ্চণা সব ক্ষেত্রে এক রকম না। কখনো কখনো দেখা যায় যে তারা এতোটাই শোষন বঞ্চনার শিকার হন যে খোদ তাদের নিজস্ব যে একটা পরিচয় আছে সেটাই বাড়ানো উপক্রম হয়। এমনই একটি সম্প্রদায় হল চীনের উইঘুর মুসলিম জাতিগোষ্ঠী। তাদের যে অন্যায় অবিচার করা হয় মিডিয়ার সুদৃষ্টির অভাবে তার অনেক কিছুই আমাদের সামনে আসে না। তবে বর্তমানে কিছু সাহসী অনুসন্ধানী সংবাদ কর্মীর কল্যাণে আমরা তাদের সম্পর্কে অল্পবিস্তর কিছু ধারণা লাভ করতে সক্ষম হচ্ছি।


উইঘুর মুসলিমরা জিনজিয়াং এর আদি অধিবাসী। কিন্তু চীনারা তাদের কে নিজেদের আদিবাসী বলে স্বীকৃতি দিতে নারাজ তাদের মতে এই উইঘুররা টিয়েল বংশোদ্ভূত এবং তারা মঙ্গোলিয়া থেকে জিনজিয়াং এ আসেন। এই উইঘুররা ইসলাম ধর্মের সুন্নি মতাবলম্বী। তবে তাদের মধ্যে কেউ কেউ সুফিবাদেও বিশ্বাসী। তাদের পূর্ব পুরুষদের অনেকে মঙ্গোলিয়া থেকে এখানে আসেন। এসব পুর্ব পুরুষদের মধ্যে অনেকে আবার তুর্কী ভাষাভাষী মঙ্গোল ছিলেন। তারা মুলত বর্তমান চীন, মঙ্গোলিয়া ও তুর্কিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। কিন্তু নবম শতকের দিকে তারা দুটি স্বাধীন অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। একটি হল গানঝউ রাজ্য অপরটি হল ক্বচো। তবে ক্বচো রাজ্যটি পরবর্তীতে উইঘুরস্তান হিসেবে পরিচিতি পায়। এই রাজ্যটি নবম থেকে চতুর্দশ শতক পর্যন্ত টিকে ছিল।

আদিতে উইঘুররা ম্যানিচিয়েন ধর্মাবলম্বী হলেও পরবর্তীতে তারা বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। পনের শতক পর্যন্ত তারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হিসেবেই থাকে। এর পুর্বে তারা মঙ্গোলদের অধীনে চলে আসে। এরপর ১৩৯০ সালে তাদের সাম্রাজ্য তৈমুর পুত্র খিজিরের হাতে চলে যায়। এরপর ষোল শতকের দিকে তারা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। সতের শতকের দিকে খোজা মুসলিমদের দ্বারা চাগতাই মোঙ্গলদের  হাত থেকে উইঘুরদের হারানো কয়েকটি অঞ্চল জয় করে। এসব অঞ্চলে তারা নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে শাসন কার্য পরিচালনা করতে থাকে। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই পার্শ্ববর্তী বৌদ্ধরা শক্তিশালী হয়ে উঠে। ফলে এই অঞ্চলের মুসলিমরা বৌদ্ধদের করদ রাজ্যে পরিণত হয়। তবে তারা দ্রুত সময়ের মধ্যেই চীনাদের সাথে যোগদান করে। ফলে এ অঞ্চলে যখন হানরা ক্ষমতায় আসে তখন শুরুতে তাদের সাথে সম্পর্ক ভাল থাকলেও পরে তা ক্রমে খারাপ হতে থাকে। ফলে এই অঞ্চলের উইঘুরদের সাথে চীনের ক্ষমতাসীন হান শাসকগোষ্ঠীর সম্পর্ক খারাপ হওয়ার দরুন। তারা সর্বদা এই হানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী মনোভাব পোষন করত। একই সাথে হানরাও অন্যায়ভাবে উইঘুর মুসলমানদের ধর্ম ও সংস্কৃতির উপর হস্তক্ষেপ করতো। এই অবস্থা চলতে থাকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ হানদের পতন হওয়া পর্যন্ত। ১৯১১ সালের পর থেকেই উইঘুররা নিজেদের ভূমিকে স্বাধীন করে সেখানে উইঘুরিস্তান হিসেবে আলাদা একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য লড়াই সংগ্রাম চালাতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৩৩ সালে তাদের নিজ অঞ্চলকে স্বাধীন হিসেবে ঘোষণা করে এবং এর নামকরণ করেন পুর্ব তুর্কিস্তান। ফলে সেখানে তারা নিজেদের পতাকা উড়িয়ে নিজেদের শাসন পরিচালনা করতে থাকেন। ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তাদের এই শাসন অক্ষুন্ন থাকে। ১৯৪৯ সালে চীনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে সেখানে সমাজতান্ত্রিক ধারায় নতুন করে শাসন কার্য পরিচালিত হতে থাকে। এ সময় চীনের কমিউনিস্ট সরকার উইঘুরদের বৃহত্তর চীনের সাথে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব জানায়। পাশাপাশি উইঘুরদের সকল ধরনের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। ফলে তাদের একটি অংশ চীনের সাথে মিলিত হওয়ার পক্ষে মত দেন তাদের যুক্তি ছিল -উইঘুররা দীর্ঘদিন এখানে স্বাধীনতা বজায় রাখতে পারবে না। কারণ একদিকে চীন অপরদিকে রাশিয়া তারা যদি এই অঞ্চলকে নিজেদের দখলে নিতে চায় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে উইঘুরদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার শক্তি /সামর্থ থাকবে না। তার চেয়ে ভাল কিছু শর্ত সাপেক্ষে চীনে যোগদান করে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করা। কিন্তু অপর একটি দল এই মতের বিরুদ্ধে বিরোধীতা করে প্রয়োজনে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে মতামত দেন। যারা চীনের বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তাব দেন তাদের নেতাদের অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই নানা  অভিযোগ এনে গ্রেপ্তার করা হয়। ফলে অতি সহজেই এই স্বাধীন পূর্ব তুর্কিস্তান কে চীনের অধীনে নিয়ে নাম পরিবর্তন করে জিনজিয়াং হিসেবে নামকরণ করা হয়।


সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কিছুদিন পরেই চীনে শুরু হয় তথাকথিত সাংস্কৃতিক বিপ্লব। এই সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়ই উইঘুর মুসলিমদের উপর নেমে আসে বিভীষিকাময় অত্যাচারের খড়গহস্ত। উইঘুরদের ধর্ম ও সংস্কৃতির স্থলে কমিউনিজম চাপিয়ে দেওয়ার জন্য চীনা কমিউনিস্টরা উঠে পড়ে লেগে যায়। এর অংশ হিসেবে তাদের ধর্মীয় শিক্ষা নিষিদ্ধ করা হয়। ধর্মীয় পার্থানালয় ভেঙে দেয়া হয়। ধর্মীয় কার্যাবলীর উপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। চীনাদের এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে যখন উইঘুররা বিদ্রোহ করা শুরু করে তখন রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহায়তায় হাজার হাজার নিরীহ উইঘুর কে হত্যা করা হয়। একই সাথে অনেক কে করা হয় গৃহহীন। এই অঞ্চলে উইঘুরদের নিজস্ব সংস্কৃতি ধ্বংস করে দেয়ার জন্য চীনের অন্য নানা অঞ্চল থেকে মুল চীনাদের এখানে এনে পুনর্বাসন করা হয়। ফলে ১৯৪৯ সালে জিনজিয়াং এ যেখানে উইঘুর মুসলিমদের সংখ্যা ছিল ৯৫% ১৯৮০ সালের মধ্যেই তা ৫৫% এ নেমে আসে।


১৯৮৮ সালে চীনাদের এই দমন পীড়নের হতে মুক্তি লাভ ও চীনের থেকে স্বাধীন হওয়ার জন্য উইঘুররা প্রতিষ্ঠা করেন - পুর্বতুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টি। এই সংগঠনের মাধ্যমে তারা কিছু প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু চীনা সরকার ১৯৯০ সালে সেখানে পরিকল্পিত ভাবে এক দাঙ্গা পরিচালনা করে এবং এই দাঙ্গার অভিযোগেই হাজার হাজার উইঘুর যুবক কে অন্যায়ভাবে হত্যা করে এবং কারাদণ্ড প্রদান করেন।  চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শী জিন পিন ক্ষমতায় আসার পরও উইঘুর উপর এই নিপীড়ন ও অত্যাচার বহাল রাখেন। বর্তমানেও ১৮বছরের পূর্বে কোন মুসলিম তাদের ধর্ম কর্ম পালন করা শুরু করতে পারেন না। সেখানে নামাজ পড়া ও রোজা রাখার উপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে রাখা হয়েছে। মুসলমানদের ধর্ম পালন করা ও নানা ধর্মীয় বিধান মেনে চলার ব্যাপারে তাদেরকে ব্যাপকভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়। সেখানে মুসলিম নারীরা হিজাব পড়লে তাদেরকে অনেক অপমান ও অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়। ধর্মীয় বিধি বিধান যারা মেনে চলেন তাদেরকে সকল ধরনের চাকুরীতে নিতে নিরুৎসাহিত করা হয়। ফলে এখানে একইসাথে ধর্মীয় বিধান মেনে চলা এবং চাকুরীতে অংশগ্রহণ করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। তাছাড়া হাদিস, কুরান ও অন্যান্য ইসলামিক জ্ঞান অর্জনের উপরও নানা রকম বিধিনিষেধ চাপিয়ে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ সেখানে উইঘুর তথা মুসলমানদের ধ্বংস করার জন্য যা যা করা দরকার তার কোন কিছুই বাকি রাখছে না চীনা প্রশাসন ও স্থানীয় জণগন। তবে সকল উদারবাদী শান্তিপ্রিয় মানুষের একটাই চাওয়া যেন অচিরেই উইঘুর মুসলিমরা চীনে তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ফিরে পায়।

তথ্য সূত্র :
১.https://www.bbc.com/bengali/amp/news-45704359

২.http://m.poriborton.com/prints/108851

৩.https://www.thejoban-mag.com/article

৪.http://www.thebangladeshtoday.com/bangla/2018/05/18/%E0%A6%95%E0


লেখকঃ ফরিদ মোল্লা

ট্যাগ : উইঘুর,