
গুয়ানতানামো বে: মার্কিন অত্যাচারের এক উজ্জল দৃষ্টান্ত
একটা সময় ছিল যখন মানুষ বনে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে খাদ্য সংগ্রহ করত। তখন তাদের স্থায়ী কোন বাড়ি-ঘরও ছিল না। তখন তারা খাদ্যের জন্য সংগ্রাম করত। এমনকি খাদ্যের জন্য যুদ্ধ করে একে অপরকে হত্যা করত। তখনকার সমাজে ন্যায় অন্যায় বলতে কোন কিছু ছিল না। পেশী শক্তির জোরেই সমাজ পরিচালিত হতো। সভ্যতার ধারাবাহিকতায় যখন তারা জোটবদ্ধ হয়ে সমাজে বসবাস করতে শুরু করল। তখন তারা ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য করতে শিখল। একইসাথে অন্যায় অপরাধের মাত্রা কমানো ও সমাজে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য নানা নিয়ম/আইনের প্রনয়ন হতে থাকে। আর এসব আইন সমাজের সাথে সাথে উন্নত হয়ে আজকের পর্যায়ে এসেছে। ফলে তৈরি হয়েছে আইন -আদালত কারাগার। ফলে অপরাধীও আইনের আস্রয় নিতে পারছে। আদালতে তার পক্ষে সমর্থন করা বর্তমানে গুরুত্বপুর্ন একটি আইনি অধিকার হিসেবে বিশ্বজোড়া প্রতিষ্ঠিত। তবে এখনো এমন জায়গা রয়েছে যেখানে অপরাধী কে বিনা বিচারে আটক রেখে বছরের পর বছর ধরে তার উপর চালানো হয় নির্মম অত্যাচার। এমন কি সে অপরাধী নাকি নির্দোষ তা প্রমান করার কোন সুযোগ দেয়া হয় না। আপনারা এই কাহিনী শুনে হয়তো ভাবছেন আফ্রিকান কোন দেশের কথা বলছি। না এটি বর্তমান বিশ্বের সভ্যতার ধারক বাহক বলে দাবী করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুয়ানতানামো বে কারাগারের কথা বলছি।
গুয়ানতানামো বে কারাগার
গুয়ানতানামো বে হল কিউবার মাটিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্মিত একটি কারাগার। ১৯০৩ সালে হাভানা চুক্তির মাধ্যমে কিউবার কাছ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৪৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের একটি জায়গা ইজারা হিসেবে গ্রহন করে। তবে এই ইজারার চুক্তিটি ছিল একটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চুক্তি। তারপর দীর্ঘসময় ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এটিকে নৌঘাঁটি হিসেবে ব্যাবহার করতে থাকে। তবে ১৯৯১ সালের পর থেকে তারা এখানে বিভিন্ন অপরাধীদের রাখতে শুরু করে যা ছিল সম্পুর্ন গোপনীয়। পরবর্তীতে জর্জ ডাব্লিউ বুশ ক্ষমতায় আসলে এর ব্যাপক সংস্কার সাধিত হয়। ২০০১ সালে ৯/১১ হামলা হলে বুশ প্রশাসন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে যুদ্ধ ঘোষনা করেন। ফলে মার্কিন গোয়েন্দা এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয় নানা দেশে তাদের টার্গেট করা লোকদের গ্রেপ্তার ও হত্যা করতে থাকে। যে সব লোকদের গ্রেপ্তার করা হতো তাদের সরাসরি মার্কিন আদালতে না তুলে তাদের বিরুদ্ধে গোপন বিচার কার্য চালানো ও তাদের বন্দি করে রাখার জন্য ২০০২ সালে এই গুয়ানতানামো বে কারাগার তৈরি করা হয়। শুরুর দিকে এই কারাগার সম্পর্কে সব কিছু গোপন থাকলেও পরবর্তীতে এখানের অমানবিক নির্যাতন ও বিনা বিচারে আটক রাখার ঘটনা কে কেন্দ্র করে এটি আলোচনায় আসে এবং এর তথ্য জনসম্মুখে চলে আসে।
যাদেরকে আটক রাখা হয়: ৯/১১ এর হামলা হওয়ার পর মার্কিনরা সন্ত্রাসীদের বিরোদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষনা করে তারই অংশ হিসেবে এই কারাগার নির্মান করা হয়। তবে শুরুতে এটি নির্মানের খবরটি মার্কিনীরা গোপন রাখলেও যখন তা ফাঁস হয়ে যায় তখন তারা বলে যে এটি শুধুমাত্র জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যদের আটক রাখা ও বিচার পরিচালনার জন্য নির্মান করা হয়েছে। এখানে শুধু জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যদের রাখা বলা হলেও পরবর্তীতে দেখা যায় জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্য ছাড়াও সাধারন লোলজনদের সেখানে রাখা হয়। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে তারা জঙ্গিগোষ্ঠী দমনের নাম করে এই প্রকল্প গ্রহণ করলেও এর পিছনে তাদের আরও কোন উদ্দেশ্য রয়েছে।
এখন পর্যন্ত এই কারাগারে ১৪৯ জন সদস্য আটক রয়েছে। এদের মধ্যে বিভিন্ন দেশের লোকজন রয়েছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে আফগানিস্তান, সিরিয়া,ইয়েমেন, সিরিয়া,তিউনিসিয়া। এইসব কারাবন্দীদের গ্রেপ্তার করার প্রক্রিয়া অনেকটাই আইন পরিপন্থী কেননা এইসব বন্দীর অধিকাংশই মার্কিন গোয়েন্দা বাহিনী সিআইএ এর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে। সিআইএ তাদের কে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে এখানে নিয়ে আসে। কিন্তু তার পুর্বে তারা গ্রেপ্তারকৃত ব্যাক্তির বিরোদ্ধে কোনপ্রকার অভিযোগ আনেন নি। এবং যে দেশ থেকে তাদের আটক করা হয় সে দেশের আদালতের অনুমতি ছাড়াই তাদেরকে ঐ কারাগারে নিয়ে আসে। এমনকি কখনো কখনো ঐদেশের প্রশাসনও জানে না যে তাদের দেশ থেকে সিআইএ কাউকে আটক করে নিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ অনেকটা ঘুম করারমত পরিস্থিতিতে তাদের গ্রেপ্তার করে। যা সম্পুর্ন আইন পরিপন্থী। এমনকি এখন পর্যন্ত যাদের কে আটক করা হয়েছে। তাদের অধিকাংশের ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্রের কোন আদালতে কোন অভিযোগ দায়ের করা হয়নি। ফলে বলা যাচ্ছে যে এখানে মানবাধিকার /আইনি অধিকার কোন কিছুরই বালাই নাই। যুক্তরাষ্ট্র যাকে তার বিরোধী মনে করছে তাকেই তুলে নিয়ে গিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় অত্যাচার চালাচ্ছে। হোক সে জঙ্গি অথবা ভাল মানুষ। কেউ তাদের বিরোদ্ধে গেলেই তার ঠিকানা হয়ে যাবে গুয়ানতানামো বে। এখন পর্যন্ত ৭৮ জন কে পাওয়া গেছে যাদের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোন অপরাধের সুনির্দিষ্ট কোন প্রমান দেখাতে পারে নি। এর মধ্যে একজন বাংলাদেশীও রয়েছেন। যাদেরকে বাধ্য হয়ে পরবর্তীতে মুক্তি দিতে হয়। মোহাম্মদ ওউলিদ সালেহী একজন মৌরিতানিয়ান নিবাসী যাকে কোন ধরণের অভিযোগ ছাড়াই কারাবরণ করতে হয় দীর্ঘ চৌদ্দ বছর। সে মুক্তি পাবার পর এই কারাগার সম্পর্কে বড় তথ্য বের হয়ে আসে। মুলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতি বাস্তবায়ন করার জন্যই তারা এটি কে ব্যাবহার করত। বর্তমান সিরিয়ার জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস প্রধান আবু বকর আল বাগদাদীও সে কারাগারে বন্দি ছিল। সেখান থেকে সে মুক্ত হয়েই আইএস গঠন করে। তার মত একজন কুখ্যাত জঙ্গিকে কোন সূত্র ধরে মুক্তি দেয়া হয়েছে তা অনেকের মনেই প্রশ্নের জন্ম দেয়। আবার এই আইএস এর হাতেই কি করে মার্কিন অস্ত্র পাওয়া যায়, তা একটি বড় বিতর্কের বিষয়। এখন পর্যন্ত ১৩০ জনকে মুক্তি দেয়ার কথা থাকলেও তারা তা করেনি। নানা সমালোচনার পরেও ট্রাম্প প্রশাসন এটি সচল রেখেছে। সর্বশেষ এখানে কতজন বন্দি এখনো সেখানে রয়ে গেছে তার সঠিক হিসেব কারো কাছেই নেই। তবে যখন থেকে এই কারাগারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি বিশ্বের সামনে চলে আসে তখন থেকে বন্দিদের সংখ্যা কমতে শুরু করে। ধারনা করা হয় যে এখন মাত্র ৪০ জনের মত বন্দি এখানে অবশিষ্ট রয়েছে।
যে কারনে এটি বিখ্যাত হয়েছে
এই কারাগারটি বন্দিদের উপর অমানবিক ও নিষ্ঠুর অত্যাচার চালানোর জন্য কুখ্যাতি অর্জন করেছে। এখানে অত্যাচারের ধরন বর্ননা করতে গিয়ে এখান থেকে মুক্তি পাওয়া একজন বন্দি বলেন নির্যাতনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো, হাতকড়া পড়াবস্থায় চোখ বন্ধ করে দীর্ঘক্ষণ সময় দাঁড় করিয়ে রাখা, উলঙ্গ অবস্থায় মিলিটারি পুরুষ ও নারী সদস্যদের দ্বারা যৌন নির্যাতন, পানি খেতে না দেয়া, তীব্র আলোর ঝলকানি, তীব্র ঠাণ্ডা বরফে শুইয়ে রাখা, মুখে কাপড় বেঁধে অনবরত পানি ঢালা, হাত পায়ের নখ উপড়ে ফেলা, বেধড়ক পেটানো জ্ঞান না হারানো অবধি এবং তীক্ষ্ণ উচ্চমাত্রার শব্দ দ্বারা নির্যাতন করা। এইসব অত্যাচারের জন্য সেখানকার অনেক বন্দিই আত্মহত্যা করতে চাইত। অনেকে আত্মহত্যা করার চেষ্টাও করেছেন। তাদের এই অত্যাচারে কারা হেফাজতেই ৬/৭ জন মারা যাওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আরেকজন বলেন তাকে খাবার দেয়া হতো নাকে পাইপ ঢুকিয়ে যা ছিল তার জন্য অনেক যন্ত্রনাদায়ক। তিনি সুস্থ থাকা সত্ত্বেও তাকে শুধুমাত্র কষ্ট দেয়ার জন্যই এই পদ্ধতিতে খাবার দেয়া হতো।
মার্কিন প্রশাসনের অবস্থান
২০০৮ সালে বারাক ওবামা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তিনি ঘোষনা দেন যে অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিতর্কিত গুয়ানতানামো বে কারাগার বন্ধ করে দেয়া হবে। তিনি তার কথা রাখার জন্য এবিষয়ে একটি অধ্যাদেশও স্বাক্ষর করেন। কিন্তু পরবর্তীতে রিপাবলিকানদের বিরোধীতার জন্য এটি আর সিনেটে পাশ হয়নি। ফলে বারাক ওবামার আমলে আর এটি বন্ধ হয়নি। তারপর রাষ্ট্রপতি হিসেবে ট্রাপ ক্ষমতায় আসলে তিনি তার দলের সাবেক রাষ্ট্রপতি বুশকে অনুসরণ করে এটি খোলা রাখার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। ফলে বর্তমান সময়েও এটি টিকে রয়েছে।
ব্যায় ও বন্দিদের মুক্তি পরবর্তী পরিনাম
মার্কিন কর্মকর্তারা জানান, গুয়ানতানামোয় একজন বন্দীকে রাখতে বছরে খরচ হয় ২৭ থেকে ২৮ লাখ মার্কিন ডলার। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে অত্যাধুনিক কারাগারে একজন বন্দীকে রাখতে খরচ হয় ৭৮ হাজার ডলার।
মুক্ত ব্যক্তিদের অপরাধপ্রবণতা
গুয়ানতানামো থেকে মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিদের ওপর কড়া নজর রাখে যুক্তরাষ্ট্র। কয়েকটি পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ছাড়া পাওয়া ব্যক্তিদের ৩০ শতাংশই পশ্চিমাদের ওপর হামলার মাধ্যমে প্রতিশোধ নিতে পুরোনো জঙ্গি সংগঠনে ফেরত যান। একজন মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, অপরাধী হিসেবে শনাক্ত এবং সন্দেহভাজন উভয়ের ক্ষেত্রেই এটা দেখা যায়। তিনি বলেন, মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিদের ১৬ শতাংশ যুদ্ধক্ষেত্রে ফেরত যাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত এবং ১২ শতাংশের বিষয়ে ধারণা করা হচ্ছে।
মার্কিনরা মুখে মানবাধিকার, ব্যাক্তি স্বাধীনতা,আইনের শাসনের কথা বলে বিভিন্ন দেশে দেশে তার মোড়লত্ব প্রকাশ করে। কিন্তু নিজেদের প্রশাসনের অভ্যন্তরে যখন মানবাধিকার, ব্যাক্তি স্বাধীনতা ভুলন্ঠিত হয় তখন সে কোন পদক্ষেপে গ্রহণ করতে পারে না। প্রত্যেক শান্তি প্রিয় মানুষই চায় জঙ্গিবাদ/শন্ত্রাসবাদ মুক্ত একটি শান্তিপূর্ণ পৃথিবী। তবে তথা কথিত শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা দাবী করা দেশ সমুহই অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের প্রয়োজনে অশান্তির বীজ বুনে দিয়ে যায়। এখন সকলের প্রত্যাশা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পৃথিবীর নরক নামক এই গুয়ানতানামো বে কারাগার বন্ধ করে দেয়া হবে এবং কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ থাকলে তাকে আদালতে হাজির করে বিদ্যমান আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।
তথ্যসূত্র :
১.https://www.aljazeera.com/topics/subjects/guantanamo-bay.html
২.https://www.nytimes.com/topic/destination/guantanamo-bay-naval-base-cuba
৩.http://www.rongginn.com/gallery/মর্ত্যের-নরক-গুয়ানতানাম/
৪.http://itibritto.com/guantanam-bay-prison/
লেখকঃ ফরিদ মোল্লা