সাম্প্রতিক

একবিংশ শতকে ঘটে যাওয়া কিছু আলোচিত সন্ত্রাসী হামলা

সাম্প্রতিক বুধবার, ২৭ মার্চ ২০১৯ ০৭:৩৫:১৫

গত কিছুদিন আগে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইসচার্সের হামলা সমগ্র পৃথিবীর মানবতাকামী মানুষের চোখকে জলে ভিজিয়েছে। সকলে এই নিসংশ হামলার প্রতি নিন্দা জানিয়েছে। তবে এভাবে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে নিরীহ মানুষ খুন করার ঘটনা এটাই প্রথম না। পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত অসংখ্য সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে । তবে এরমধ্যে বেশ কয়েকটি আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর হামলা রয়েছে। তবে শুধুমাত্র এই শতকেই অর্থাৎ একবিংশ শতকে এমন কিছু সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে যেগুলো বার বার আলোচনায় আসে। এসব কিছু চাঞ্চল্যকর সন্ত্রাসী হামলার বর্ননা তুলে ধরা হল -

১.  ৯/১১ হামলা: ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১১তারিখ আন্তর্জাতিক ট্রেড সেন্টারে সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। এই হামলা পরিচালনা করে ১৯জন সদস্যের একটি গ্রুপ। তারা প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের ৪টি যাত্রীবাহী বিমান ছিন্তাই করে এবং এগুলাকেই হামলার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যাবহার করে। তারা লক্ষ্যবস্তু হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও স্থানকে চিহ্নিত করে। এই তালিকায় ছিল আন্তর্জাতিক ট্রেড সেন্টার, প্রতিরক্ষা ভবন (পেন্টাগন বিল্ডিং) ও রাষ্ট্রপতির বাসভবন (হোয়াইট হাউজ)।

হামলার সুচনা হয় টুইন টাওয়ার বলে পরিচিত পাশাপাশি দুইটি টাওয়ারের একটিতে হামলা করার মাধ্যমে। প্রথমে নর্থ টাওয়ারের ৬০তম তলায় হামলা করা হয়। সাথে সাথে সম্পুর্ন বিল্ডিং কেপে উঠে এবং বিশাল অংশ ধসে পড়ে। মুহুর্তের মধ্যে আতঙ্ক চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যেই প্রথম হামলার ঠিক ১৮মিনিট পর পাশের অপর বিল্ডিং এ হামলা করা হয়। অপরদিকে আরেকটি বিমান পেন্টাগনের দিকে এগিয়ে যায় কিন্তু সেখানে তাদের হামলা সফল হয়নি। কিন্তু হামলাকারীরা পেন্টাগনের খুব নিকটে চলে যান অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাসীমা বেধ করতে সক্ষম হয়। ৪র্থ বিমানটি হোয়াইট হাউজে হামলা করার পুর্বেই মাঝ আকাশ থেকে ভূপাতিত করা হয়।

এই হামলায় হামলাকারীরা সকলে মৃত্যুবরণ করেন। পরে তদন্তে জানা যায় যে তারা সকলে সৌদি বংশোদ্ভূত এবং জংঙ্গী গোষ্ঠী আল কায়দার সাথে সম্পৃক্ত। এই হামলায় প্রায় ৩,০০০জন নিতহ হয় এবং প্রায় ৮,৯০০ জন হতাহত হয়।

২.মাদ্রিদ হামলা:

২০০৪ সালের ১১ই মার্চ সকাল ১০ টার দিকে স্পেনের মাদ্রিদে এই হামলা হয়। চারটি পৃথক যাত্রীবাহী ট্রেনে পেতে রাখা প্রায় ১০টি বোমা একসাথে বিস্ফোরিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র স্পেন আতঙ্কে কেপে উঠে। এই হামলা এমন একসময় হয়েছে যখন স্পেনের সাধারণ নির্বাচনের আর মাত্র তিন দিন বাকি। প্রথমে স্পেন সরকার এই হামলার জন্য স্থানীয় ভাস্ক জঙ্গি গোষ্ঠীকে দোষারোপ করলেও পরবর্তীতে প্রমান হয় যে এই হামলা আল কায়দা কর্তৃক চালানো হয়েছে।  এই ঘটনা কে কেন্দ্র করে স্পেনের তৎকালিক সরকার নির্বাচনে পরাজয় বরন করে। এই হামলায় যুক্ত থাকার দায়ে ২১জন কে  পুলিশ আটক করতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে তাদের কে দন্ডাদেশ প্রদান করা হয়। হামলার পাচ দিন পর এর সাথে জরিত অপর ৫ হামলাকারী অপর একটি হামলায় নিহত হন।

এই হামলায় মোট ১৯১ জন নিহত হয় এবং ২০০০ এর অধিক মানুষ আহত হয়। এই হামলা কে একবিংশ শতকে ইউরোপের সবচাইতে বড় হামলা হিসেবে গন্য করা হয়।

৩.মোম্বাই হামলা :

২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর থেকে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত ৪ দিন ব্যাপী ১২ জন অস্ত্রধারী ভারতের বিখ্যাত শহর মোম্বাইয়ে যে হামলা পরিচালনা করে তা ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে। তারা ৪দিনে মোম্বাইয়ের মোট ৮টি স্থানে বোমা-অস্ত্র হামলা করে। হামলাকারীর সকলেই ছিল পাকিস্তানী। তারা প্রথমে করাচি বন্দর থেকে জাহাজে করে ভারত মহাসাগরে আসে পরে সেখান থেকে একটি ভারতীয় মাছ ধরার নৌকা ছিনতাই করে জেলেদের কে হত্যা করে তাদের এই নৌকা নিয়েই মোম্বাই বন্দরে অবতরন করে সেখান থেকে তারা শহরে প্রবেশ করে। এরপর তারা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান নেয়। কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে একযোগে হামলা চালাতে থাকে এই স্থানগুলোর মধ্যে ছিল - শিবাজী টার্মিনাল, তাজমহল হোটেল প্যালেস,  লিওপোল্ড ক্যাফে, কামা হাসপাতাল ,নরিম্যান হাইস ইহুদি কমিউনিটি সেন্টার,মেট্রো অ্যাডল্যাবস,এবং টাইমস অফ ইন্ডিয়া ভবন ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ গলি, এছাড়া মুম্বইয়ের বন্দর এলাকার মাজাগাঁও ও ভিলে পার্লের একটি ট্যাক্সির মধ্যেও বিস্ফোরণ ঘটায়। এই সময়ে তারা এই হামলা করার জন্য বন্দুক ও বোমার বিস্ফারণ ঘটায়।

ভারতীয় পুলিশ দীর্ঘ চার দিনের প্রচেষ্টায় হামলাকারীদের প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। ১২জন হামলাকারীর মধ্যে প্রায় সবাই মৃত্যুবরণ করেন। শুধু একজনকে তারা জীবিত গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। তার মাধ্যমেই জানা যায় যে হামলাকারীরা সকলে পাকিস্থানী জঙ্গি গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বার সদস্য ছিল। জীবিত ঐ পাকিস্তানী হামলাকারীকে ২০১২ সালে ভারতীয় আদালত মৃত্যুদণ্ড দান করেন।

এই হামলায় মোট ১৬৪ জন ব্যাক্তি নিহত হয় এবং ৩০৮ জন আহত হয় এবং বেশ কয়েকটি স্থাপনাসহ অর্থনৈতিক বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। ভারতের ইতিহাসে এটি ছিল অন্যতম বড় একটি সন্ত্রাসী হামলা।

৪.পেশোয়ার হামলা:

২০১৪ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানের পেশোয়ারের একটি সেনা পরিচালিত স্কুলে এই হামলা পরিচালনা করা হয়। পেশোয়ারের ওয়ারসাকে আর্মি পাবিলিক স্কুলটিতে প্রায় ৫০০ এর অধিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করত। তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল আর্মি অফিসার ও সৈনিকদের সন্তান। হামলার পুর্বে ৫/৭ জন সামরিক পোশাক পরিহিত হামলাকারী স্কুলে প্রবেশ করে এবং প্রবেশ করেই এলোপাতারি গুলি ছুড়তে থাকে। স্কুলের ছাত্র শিক্ষকরা কিছু বুঝে উঠার পুর্বেই একের পর এক ধরাশায়ী হতে থাকে। একই সাথে তারা আত্মঘাতী বোমা হামলাও চালায়। পাকিস্তানি পুলিশ-সেনাবাহিনী মিলে ৮ ঘন্টার পরিশ্রম শেষে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়। হামলাকারীদের মধ্যে চারজন কে জীবিত আটক করতে সক্ষম হয়। বাকিরা আত্মঘাতী বা পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। পরবর্তীতে পাকিস্তানের ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠী তালেবান এই হামলার দায় স্বীকার করে এবং তারা এটাকে সামরিক বাহিনীর বিরোদ্ধে প্রতিশোধ হিসেবে উল্লেখ করে।

এই হামলায় প্রায় ১৫০ জন নিহত হয় যাদের অধিকাংশেরই বয়স ১০-১৮ এর মধ্যে ছিল। তাছাড়া ১২২ জন আহত হয়। হতাহতের দিক দিয়ে এটি পাকিস্তানের সবচাইতে বড় সন্ত্রাসী হামলা।

৫.প্যারিস হামলা:

২০১৫ সালের ১৩ নভেম্বর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সন্ত্রাসীরা একযোগে হামলা চালায়। তাদের এই হামলা ছিল সম্পুর্ন আত্মঘাতী বোমা হামলা, তবে এই বোমা হামলার কিছু পুর্বে অল্প সময়ের জন্য বন্দুক হামলাও পরিচালনা করে। প্যারিসের গুরুত্বপূর্ণ সব জনবহুল স্থানে এই হামলা চালানো হয়। হামলাকারীর মোট সংখ্যা ছিল ৮ জন। তাদের সকলেই এই হামলায় নিহত হন। তাছাড়া এই হামলায় ১৩০ জন সাধারন মানুষ নিহত এবং প্রায় ৪১৫ জন সাধারন নাগরিক আহত হয়। এটি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্সে পরিচালিত সবচাইতে বড় হামলা।

৬.লাস ভেগাস হামলা:

২ অক্টোবর ২০১৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যস্ততম নগরী লাস ভেগাসের একটি কনসার্টে এই হামলা করা হয়। ঐসময় লাস ভেগাসের একটি উন্মুক্ত স্থানে রুট ৯১ হারভেস্ট মিউজিক ফেস্টিভ্যাল চলছিল। ফলে আশে পাশের এলাকা থেকে কনসার্ট উপভোগ করার জন্য বহু লোকজন এসে এখানে জড়ো হয়েছিল। রাত আনুমানিক ১০:৩০ মিনিটের দিকে হঠাৎ করে পাশের মান্দালাই বে নামক একটি হোটেলের ৩২তম তলা থেকে স্টিফেন প্যাডক নামক একজন ব্যক্তি গুলি চালাতে থাকে। স্বয়ংক্রিয় কয়েকটি বন্দুক থেকে একের পর পর এক গুলি ছাড়তে থাকে। মানুষজন জীবন বাঁচানোর জন্য এদিক সেদিক ছুটে পালাতে থাকে। প্যাডক এই হামলা পরিচালনার জন্য ১০টির অধিক বন্দুক ব্যাবহার করেছেন।

এই হামলায় তাৎক্ষনাত ৫৮ জন নিহত হয়েছে এবং প্রায় ৫০০ জনের অধিক মানুষ হতাহত হয়েছে। ঐ হামলার পর হামলাকারী প্যাডকও নিহত হয়। তার মৃত্যু সম্পর্কে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কেউ বলেন হামলা শেষে তিনি নিজেই আত্মহত্যা করেছেন আবার কেউ কেউ বলেন তিনি মার্কিন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। প্যাডক একজন খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী ছিলেন।

৭.ক্রাইসচার্স হামলা:

১৫ই মার্চ ২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইসচার্সের দুটি মসজিদে এই হামলা চালানো হয়। এটি সম্প্রতিকালের ইতিহাসে নিউজিল্যান্ডে চালানো সবচাইতে বড় হামলা। নিউজিল্যান্ডের সাধারন মানুষ এর পুর্বে এমন নারকীয় হামলা প্রত্যক্ষ করেনি। শুক্রবার জুম্মার নামাজের কিছু পুর্বে অষ্ট্রেলিয় একজন শেতাঙ্গ এই হামলা পরিচালনা করেন। তিনি একাই প্রথম আল নূর নামক মদজিদে প্রবেশ করে এখানে একে একে সকল কে হত্যা করেন। তারপর পাশের লিনউড নামক অপর একটি মসজিদে প্রবেশ করে নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে। সেখানে আব্দুল আজিজ নামে একজন সাহসী ব্যাক্তির প্রচেষ্টায় ব্যান্টন নামের হামলাকারীকে রুখে দিতে সক্ষম হয়। ফলে লিনউড মসজিদের অনেকের প্রাণ রক্ষা পায়।হামলাকারী নিজে তার পরিচালিত হামলার সমগ্র দৃশ্য ভিডিও হিসেবে ধারন করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। এই হামলার সময় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলও সেখানে ছিল কিন্তু অল্পের জন্য তারা প্রাণে বেচে যায়।এই হামলার পর হামলাকারীকে নিউজিল্যান্ড পুলিশ আটক করতে সক্ষম হয়। এই হামলার পর পর গৃহীত পদক্ষেপের জন্য নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছেন।

এই হামলায় সর্বমোট ৫০জন নিহত হয়। নিহতের সকলেই ছিলেন মুসলিম ধর্মের অনুসারী এবং অন্যান্য দেশ থেকে আসা নিউজিল্যান্ডের অভিবাসী। নিহতদের মধ্যে পাঁচজন বাংলাদেশীও ছিলেন।

তথ্যসূত্র
১.https://www.toptenz.net/top-10-terrorist-attacks.php

২.https://www.worldatlas.com/articles/worst-terrorist-attacks-in-history.html

৩.https://www.msn.com/en-in/news/photos/10-deadliest-terror-attacks-of-the-21st-century/ss-BBBbTYb#image=10

৪.https://m.dw.com/bn/মাদ্রিদে-বোমা-হামলার-পাঁচ-বছর-পূর্তি/a-4091213

লেখকঃ ফরিদ মোল্লা