হোয়াইট হেলমেটসঃ যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় একদল দেবদূত
"জনাব উথান্ট জাতিসংঘ ভবনের মেরামত আজ অনিবার্য ; আমাকে দেবেন গুরু দয়া করে তার ঠিকাদারী?
বিশ্বাস করুন রক্তমাখা ইটের যোগান পৃথিবীর সর্বনিম্ন হারে দিতে পারি আমি একমাত্র।
যদি চান শিশুর গলিত খুলি, দেওয়ালে দেওয়ালে শিশুদের রক্তের আলপনা
প্লিজ আমাকে কন্ট্রাক্ট দিন" [রিপোর্ট ১৯৭১, আসাদ চৌধুরী ]
জাতিসংঘ সহ পুরো বিশ্ব বিবেক যারা কিনা মানবাধিকারের অমিয় বাণী ফেরি করে বেড়ায় দুনিয়াজুড়ে সব থমকে আছে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে৷ যুদ্ধ যে কত ভয়াবহ তা সিরিয়ার দিকে তাকালে বুঝে না উঠার ফুরসত নেই৷ পৃথিবীর সব প্রভাবশালী দেশ সেখানে নিজেদের ক্ষমতার বড়াই দেখাচ্ছে। ফলাফল হিসেবে সমৃদ্ধ এ দেশ পরিণত হয়েছে ভুতুড়ে জনপদে। শরণার্থীতে পরিণত হয়েছে লাখ লাখ বেসামরিক নাগরিক। মৃত্যু হয়েছে অগণিত। তবু থেমে নেই যুদ্ধ। সময়ে সময়ে পড়ছে বোমা, ধ্বংস হচ্ছে অবকাঠামো। অবশিষ্ট যেসব মানুষ আছে তারাও প্রাণ নিয়ে পালাতে পারছে না। যুদ্ধ ছাড়া দ্বিতীয় কিছু নেই সেখানে।
এত এত ধ্বংস আর রক্তের উৎসবে হেরে যাওয়া রাষ্ট্র সিরিয়ার অবশিষ্ট জনগণের দেখ ভালের দায়িত্ব নিয়েছে সাদা শিরস্ত্রাণ পরিহিত কিছু উদ্যমী দেবদূতের দল। পোশাকি নাম যাদের ‘হোয়াইট হেলমেটস’। তাঁদের অসম সাহসিকতা আর মানবতার যুদ্ধে সংগ্রামের গল্প জানবো আজকের লেখায়।
একজনের জীবন বাঁচানোর অর্থ পুরো মানবজাতির জীবন বাঁচানো সূরা বাকারার এই অমীয় বাণী মূলমন্ত্র মেনে মাত্র ২০ জন স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে ২০১৩ সালের শেষের দিকে ইলেক্ট্রনিকস ব্যবসায়ী রাইজ সালেহ প্রতিষ্ঠা করেন হোয়াইট হেলমেটস নামের এ দল। শুরুর দিকে আলেপ্পো শহরকেন্দ্রিক এ দলের সদস্যপদের প্রাথমিক পর্যায়ে প্রশিক্ষণ নিতে হয়। শপথ করতে হয় অস্ত্র হাতে না নেয়ার, কর্মক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা তথা সকল ধরণের মানুষকে রক্ষার প্রতিজ্ঞা করতে হয়। তাই তারা নিজের জীবন বাজি রেখে, কংক্রিটের চাপাপড়া থেকে বেসামরিক নাগরিকদের যেমন উদ্ধার করেন আবার সরকারি ও বিদ্রোহী গ্রুপের সৈন্যদেরও বাঁচাতে দ্বিধাবোধ করেন না। বোমার শব্দ শুনলেই ছুটে যান অকুস্থলে যেখানে নিজের জীবন বিপন্নের সমূহ সম্ভাবনা থাকে। আবেদ নামের এক হেলমেটস এর ভাষায়
When I want to save someone’s life, I don’t care if he’s an enemy or a friend what concerns me is the soul that might die
মানবতা, ন্যায় ও সংহতি এই তিনটি বিষয়কে সামনে রেখে সিরিয়ার স্থানীয় এবং ইউরোপীয় বিভিন্ন বর্ণের পেশাজীবীদের সমন্বয়ে গড়া এ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ৩,২০০। ২০১৩ থেকে আজ অব্দি তাঁরা প্রায় ৯৯,০০০ সামরিক ও বেসামরিক লোকের জীবন বাঁচিয়েছে।
হেলমেটসদের কাজ
সিরিয়ান সিভিল ডিফেন্স বা হোয়াইট হেলমেটস এর প্রধান কাজ হচ্ছে বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি থেকে আটকা পড়া মানুষদের উদ্ধার। এছাড়া তারা অগ্নি নির্বাপণ এবং রাসায়নিক হামলা থেকে মানুষদের রক্ষা এবং অবিস্ফোরিত বোমা নিস্ক্রিয়করণের কাজও করে থাকে।
সিরিয়ার অভ্যন্তরে রুশ-মার্কিন কিংবা বাশারের চ্যালা প্যালার বোমা হামলার সাথে সাথে দুর্গত এলাকাগুলোতে ডাক হরকরার মত ছুটে বেড়ায় একেকজন কর্মী, মানবতার যেখানে চূড়ান্ত অপমান, ঠিক সে জায়গায় নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানবতা রক্ষকের মূর্তিমান উদাহরণ হয়ে দায়িত্ব পালন করে আসছে এসব হার না মানা স্বেচ্ছাসেবকের দল। এর জন্য তাঁদের চরম মূল্যও দিতে হয়। আজ পর্যন্ত প্রায় ১৫০ হেলমেটস বিমান হামলা বা উদ্ধারকাজে নিহত হয়েছে। এইতো গতবছরের আগস্টের ১২ তারিখ রুশ হামলায় ৭ হেলমেটস কর্মী নিহত হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশে ধর্ম রাজনীতিকে পাশ কাটিয়ে নিজের জীবন বাজি রেখে এহেন কর্মের জন্য বাহবা তাঁদের নিশ্চয়ই প্রাপ্য।
When the bombs rain down, the Syrian civil defense rushes in. In a place where public service no longer function these unarmed volunteers risk their lives to help anyone in need regardless of their religion or politics. Known as the white helmets these volunteer rescue workers operate on the most dangerous place on earth
মিরাকল বেবি ও খালেদ ওমর
সময়টা ২০১৪ সাল আলেপ্পো শহরে রুশ-বাশার মিত্রবাহিনী আর ফ্রি সিরিয়ান আর্মির তুমুল লড়াই চলছে। ভস্ম হয়ে যাচ্ছে চারপাশ তাসেরঘরের মত ভেংগে যাচ্ছে দালানকোঠা ঘরবাড়ি। শোকের মাতমে ভারী হওয়া পরিবেশে যুক্ত হল একটি শিশুর করুণ আর্তনাদ সাথে অসহায় মানুষদের ছোটাছুটি। এদিকে হেলমেট সদস্যরা বসে নেই, বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি থেকে মানুষ মুক্ত করার এক অসম যুদ্ধে লিপ্ত তাঁরা। তারই একজন খালেদ ওমর।
ক্রন্দনরত শিশুর পানে ছুটে গেলেন তিনি কালবিলম্ব না করে। নিজের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে খুঁড়তে লাগলেন কংক্রিট। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ১৬ ঘন্টা পর উদ্ধার হয় সে শিশু পুরো বিশ্বে আলোড়ন তোলা সেই ফুটফুটে বাচ্চাটি পরিচিতি পায় ‘মিরাকল বেবি’ রূপে এবং খালেদ ওমর বীর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন গোটা পৃথিবীতে। তারই ফলশ্রুতিতে ২০১৫ সালের অক্টোবরে জাতিসংঘে সিরিয়া যুদ্ধ নিয়ে তিনি এক বক্তব্য দেন এবং নায়কোচিত রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে রুশ বিমান হামলায় তিনি নিহত হন।
পদক ও সম্মাননা
গত চার বছর ধরে হোয়াইট হেলমেটস এর নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে বেশ জোরেশোরে কথাবার্তা চললেও শেষ পর্যন্ত আর হয়ে উঠেনি। ২০১৭ সালের নোবেল শান্তির সংক্ষিপ্ত তালিকায় নাম উঠা নিয়েও অনেক কানাঘুষা চলে। সে যাইহোক তারা কিন্তু বিকল্প নোবেল পেয়ে বসেছে ২০১৬ সালে। ‘রাইট লাভলিহুড’ নামের এই এওয়ার্ড বিকল্প নোবেল হিসেবে গণ্য করা হয় এবং সিরিয়ান সিভিল ডিফেন্স বা হোয়াইট হেলমেটস সে পুরস্কার ছিনিয়ে আনে সেপ্টেম্বরে ২২ তারিখ ২০১৬ সালে। ২০১৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ‘Tripperary peace prize’ নামের আরেকটি পুরষ্কারে ভূষিত হয় তাঁরা। এছাড়া ৮৯ তম অস্কারে ‘হোয়াইট হেলমেটস’ শিরোনামের একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্র অস্কার জয় করে।
হোয়াইট হেলমেটস নিয়ে সৃষ্ট সন্দেহ
উপরের অংশে আমরা সিরিয়ান সিভিল ডিফেন্সের আলোর অংশই অবলোকন করেছি। এখন দেখব সমালোচকদের চোখে হোয়াইট হেলমেটস আসলে কি?
বাশার আল আসাদ এবং তার মিত্রগোষ্ঠী মনে করে হোয়াইট হেলমেটস আল কায়েদার অন্য রূপ। আল কায়েদার হয়ে সিরিয়ায় তারা সন্ত্রাসবাদে নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং হোয়াইট হেলমেটসদের প্রত্যেকটি সদস্য জঙ্গিবাদের সাথে কোন না কোনভাবে সম্পৃক্ত। এ সম্পর্কে বাশারের ভাষ্য
হেলমেটস আল কায়েদার সদস্য এবং সেটি প্রমাণিত। সিরিয়ার বেসামরিক লোকদের তারাই হত্যা করছে আবার তারা একই সাথে মানবতার রক্ষক। এখন নাকি তারা অস্কারও পেয়ে গেছে!
এছাড়া কিছু সমালোচকদের মতে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থার পরোক্ষ মদদেই সিরিয়ান সিভিল ডিফেন্স পরিচালিত হয় এবং সিরিয়ায় তাদের ভূমিকা মঞ্চায়িত নাটকসদৃশ।
লেখকঃ উবায়দুর রহমান রাজু