সাম্প্রতিক

বোকো হারামঃ একটি চরমপন্থি জঙ্গি গোষ্ঠী

সাম্প্রতিক মঙ্গলবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৮:১৯:৪৬

বিশ্বের ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠনগুলোর তালিকার শীর্ষে রয়েছে নাইজেরিয়ার বোকো হারাম। বোকো হারাম একটি চরমপন্থি জঙ্গি গোষ্ঠী। ২০০৯ সাল থেকে তারা নিয়মিত ভাবে নাইজেরিয়ার সেনাবাহিনী, পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তা, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ধর্মীয় উপাসনালয় এমনকি সাধারণ মানুষের উপর আক্রমণ করে যাচ্ছে। ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় দশ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে এই সংগঠন এবং ১.৫ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য, যদিও বোকো হারামের নাম শোনা যায় ২০০২ সাল থেকে।

বোকো হারাম মূলত উত্তর নাইজেরিয়ার একটি জঙ্গি গোষ্ঠী ৷ এই সংগঠনের আসল নাম হল “দি পিপল অব দ্যা সুন্নিস প্রিয়েচিং অ্যান্ড জিহাদ”। “বোকো হারাম” শব্দ দুটি এসেছে দুই ভাষা থেকে। ‘বোকো’ শব্দটি হাউসা ভাষার আর ‘হারাম’ এসেছে আরবি ভাষা থেকে। ‘বোকো’ অর্থ ‘পশ্চিমা শিক্ষা’। ‘বোকো হারাম’ মানে ‘পশ্চিমা শিক্ষা পাপ’।

বোকো হারামের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ ইউসুফ ২০০১ সালে বোকো হারাম প্রতিষ্ঠা করেন। বোরনো প্রদেশের রাজধানী মাইদুগুরির নিকটবর্তী শহর দাম্বোয়ায় বোকো হারাম প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংগঠনটি ইতোমধ্যে মালি, নাইজার, সাদ, ক্যামেরুনে তাদের কর্মকাণ্ডের বিস্তার ঘটিয়েছে। এরা মূলত সালাফিস্ট বা ওয়াহাবি মতাদর্শে বিশ্বাসী। ইসলামিক স্টেটের(আইএস) জঙ্গি গোষ্ঠীর প্রতি তারা তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেছে। তাদের সংগঠনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে পশ্চিমা সংস্কৃতির বিরোধিতা। তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সংগঠনের মুখপাত্র আবু কাকা বলেন, “যখন আমরা দেখবো সবকিছু আল্লাহর নির্দেশ মতো করা হচ্ছে এবং আমাদের সঙ্গীদের কারাগার থেকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, একমাত্র তখনই আমরা আমাদের অস্ত্র একপাশে সরিয়ে রাখবো। কিন্তু আমরা তা ত্যাগ করবো না। কারণ ইসলামী বিধান অনুসারে আপনি অস্ত্র একপাশে সরিয়ে রাখতে পারেন, ত্যাগ করতে পারেন না”। বোকো হারামের বর্তমান প্রধান হচ্ছেন আবু মুসাব আল বারনাবি ৷ সে তার সংগঠনকে আইএস এর নেতৃত্বাধীন খিলাফতের একটি অংশ বলে মনে করে এবং এ জন্য তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় তারা ‘শারীয়া আইন’ চালু করেছে ৷ মোহাম্মদ ইউসুফ প্রতিষ্ঠা করলেও ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই সংগঠনটির নেতৃত্বে ছিলেন আবুবকর শেকাউ৷ তার সম্পর্কে কিছু তথ্য নিম্নে দেয়া হলো।

আবুবকর শেকাও নাইজেরিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকা শেকাওয়ে জন্মগ্রহণ করে। একজন ধর্ম পণ্ডিতের অধীনে তার শিক্ষাজীবনের শুরু। পরবর্তীতে সে বর্নো স্টেট কলেজ অব লিগ্যাল এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ থেকে ইসলামের ওপর উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ করে। এই উচ্চজ্ঞানের কারণেই তাকে ‘দারুল তাওহিদ’ নামে পরিচিত। সে বেশ কয়েকটি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারে। যেমন- হৌসা, ফুলানি, কানুরি এবং আরবি। তবে সে ইংরেজিতে কথা বলতে পারে না। পশ্চিমাদের ঘৃণার কারণেই এই ভাষা শিক্ষা এড়িয়ে গেছে সে। বিশ্লেষকরা তাকে একজন নিঃসঙ্গ এবং ছদ্মবেশে বিশেষজ্ঞ বলে আখ্যায়িত করেছেন। বোকো হারামের কয়েকজন নির্ভরযোগ্য সদস্য ছাড়া আর কোনো সদস্যদের সাথে সে কখনো সরাসরি কথা বলে না। এবং তার মেসেজ সদস্যদের কাছে পৌঁছে এই কয়েকজন বিশ্বস্তের মাধ্যমে কয়েক স্তরের পর। এছাড়া সে বিভিন্ন নামেও তার মেসেজ সদস্যদের কাছে পৌঁছায়। যেমন- আবু বকর শিকওয়া, ইমাম আবু বকর শিকু এবং আবু মুহাম্মাদ আবু বকর বিন মুহাম্মাদ আল শাকউই আল মুসলিমি বিসকু।

তারা মানুষের তৈরি আইন ও আধুনিক বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে যদিও তারা তাদের জঙ্গি কার্যক্রমে আধুনিক অস্ত্রের ব্যবহার করে। গবেষকগণ এটাকে তাদের দ্বিচারিতা হিসেবে উল্লেখ করেন। বোকো হারাম নাইজেরিয়ার সরকারের বাহিনীর উপর হামলা করে নিয়মিত ভাবে, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের উপর একের পর এক হামলা চালায়। ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে তারা দুইশত এর অধিক স্কুল পড়ুয়া কিশোরীদের অপহরণ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা করে ছাত্রছাত্রীদের জিম্মি করা তাদের কাছে মামুলি ব্যাপার। নাইজেরিয়াতে ২০১২ সালে ৬২০ জন ও ২০১১ সালে ৪৫০ জন নিরীহ মানুষকে হত্যার জন্য বোকো হারামকে দায়ী করা হয়।

নাইজেরিয়ার সাধারণ মানুষ বোকো হারামের কাছে এক রকম অসহায়। বোকো হারামের জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনার অর্থ তহবিল জুগিয়ে থাকে আল কায়েদার ইসলামিক সদস্যরা এবং সৌদি আরব ও যুক্তরাজ্যের তাদের অনুসারী কিছু গোষ্ঠী। এছাড়াও, আল মুনতাদা ট্রাস্ট নামে এক সংস্থা তাদের তহবিল জুগিয়ে থাকে। তবে, তাদের তহবিলের অন্যতম একটি উৎস হচ্ছে, তারা বিভিন্ন দেশি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের জিম্মি করে মোটা অংকের অর্থ দাবি করে। বিশেষ করে সাংবাদিকদের জিম্মি করে তারা অর্থ আদায় করে। বোকো হারাম নাইজেরিয়ার শরীরে এক দগদগে ঘা স্বরূপ, যা নাইজেরিয়ান জাতিকে ভোগাচ্ছে। পুরো উত্তরাঞ্চল দখলে নিয়ে যেখানে তারা নিজেদের শাসন তথা শরীয়া আইন জারি করেছে, পশ্চিমা ও আধুনিক শিক্ষা-সংস্কৃতি নিষিদ্ধ করেছে।

পুরো পৃথিবীতে বর্তমানে যে চরমপন্থার উদ্ভব ঘটেছে বোকো হারাম তার মধ্যে অন্যতম একটি সংগঠন। ব্রিটেন ভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক টম কিটিঞ্জ মত দিয়েছেন, বর্তমানে বোকো হারামের লোকবল ৯ হাজারের বেশি। গবেষক কিয়ারি মোহাম্মাদ মনে করেন , এই গোষ্ঠী মূলত গ্রামাঞ্চল থেকেই স্বল্প মূল্যে যোদ্ধা সংগ্রহ করে থাকে ৷ দরিদ্রতার কারণে গ্রামাঞ্চলের অনেক মানুষ এই জঙ্গি গোষ্ঠর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।  নাইজেরিয়ান এই গবেষকের মতের সাথে বাস্তবতার মিল লক্ষণীয়। অস্ত্রের যোগানের জন্য এরা সাধারণত দখল করা অঞ্চলের পুলিশ স্টেশন এবং সামরিক ঘাঁটি গুলোকে টার্গেট করে৷ বর্তমানে তারা যুদ্ধে রকেটচালিত গ্রেনেড, অ্যাসল্ট রাইফেল, পিকআপ ট্রাক এবং সাঁজোয়া যান ব্যবহার করে। ভারী অস্ত্রের যোগানের জন্য এরা কালোবাজারির সহায়তা নেয় যেটা সাধারণত সাহেল অঞ্চল কেন্দ্রিক হয়ে থাকে ৷ লিবিয়া থেকে বেশ কিছু অস্ত্রের জোগান পেয়েছে এই জঙ্গিগোষ্ঠী। তবে, অস্ত্র আমদানির উপর নির্ভর না করে তারা নিজেরাই তাদের উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগায় ৷বর্তমানে তাদের ব্যবহৃত বেশকিছু বোমাই স্থানীয়ভাবে তৈরি। বিস্ফোরক দ্রব্যের মজুদ বাড়াতে তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হামলা করে, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় ভাবে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান ৷ তাদের বোমা তৈরিকারী দলে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বহু মেধাবী শিক্ষার্থীও রয়েছে। যারা এই সব বিস্ফোরক দ্রব্যের সাহায্যে বোমা প্রস্তুত করে।

বোকো হারাম বিভিন্ন সময়ে হামলা করে প্রায় ১৫ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে, এছাড়াও বহু মানুষ তাদের হামলার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য হল: 

২০১০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর বাউসি জেল ভেঙে তারা ১০৫ জন বন্দিকে মুক্ত করে উত্তর নাইজেরিয়ার কয়েকটি এলাকায় হামলা করে সেই অঞ্চলে তাদের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালায়।

২০১১ সালে ইয়োলা জেল ভেঙে ১৪ বোকো সদস্যের পলায়ন, ২৯ মে নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলে বোমা হামলা, ১৬ জুন আবুজা পুলিশ সদর দপ্তরে বোমা হামলা, আগস্টে আবুজায় অবস্থিত জাতিসংঘের সদর দপ্তরে হামলা করে ১১ জন জাতিসংঘ কর্মকর্তাসহ হত্যা, এভাবে বোকো হারাম ২০১১ সালে মোট ১১৫ টি হামলা পরিচালনা করে, যার ফলে নির্মমভাবে মৃত্যু হয় ৫৫০ জন মানুষের।

২০১২ সালের ২০ জানুয়ারি তারা পুলিশ ভবনে হামলা করে ১৯০ জনকে হত্যা করে, ২৬ জুন মাইদুগুরির একটি বাগানে হামলা চালালে ২৫ ব্যক্তি নিহত হয়। দেশটিতে ২০১২ সালে প্রায় ৬২০ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়।

২০১৩ এর ফেব্রুয়ারিতে ৭ জন ফরাসি পর্যটককে জিম্মি করে অর্থ দাবি করে ও নভেম্বরে ১ জন ফরাসি ধর্মপ্রচারককে অপহরণ ও জিম্মি করে।

২০১৪ সালের ১৪ এপ্রিল মাসে বোকো হারাম ২৭৬ জন স্কুল পড়ুয়া ছাত্রীদের অপহরণ করে ৷ জুলাই মাসে তারা ক্যামেরুনের সীমান্ত এলাকার এক বাড়িতে হামলা করে সে দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্টের স্ত্রীকে অপহরণ করে এবং তিন মাস পরে তাকে মুক্তি দেয় ৷

২০১৪ সালে এই গোষ্ঠী তেমন বড় ধরনের কোন হামলা না করলেও ২০১৫ সালে বোকো হারাম সেনা সদস্যদের ক্যাম্পে হামলা করে প্রায় ২০০০ মানুষকে হত্যা করে।

১২ জানুয়ারি ক্যামেরুনের সামরিক ঘাটি কোলোফাতাতে হামলা করলে সেখানেও ১৪৩ জন মারা যায়।

২০১৬ সালের জানুয়ারিতে বোমা বিস্ফোরণে মাইদুগিরি থেকে তিন মাইল দূরে দালোরি গ্রামে ৮৬ জন মারা যায়।

২০১৬ সালের নভেম্বরে প্রায় ৪০০ জন নারী ও শিশুকে অপহরণ করে।

২০১৭ সালের ১২ মে তেল খনি বিস্ফোরণ ঘটায় এতে প্রায় ৫০ জন নিহত হয়।

এছাড়া, বোকো হারাম বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অপহৃত ছাত্রীদের দাস হিসাবে বিক্রি করে। বোকো হারামের বন্ধুরাষ্ট্র সেনেগাল এই অপহৃত ছাত্রীদের ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বলে জানা যায়। বিশ্বে এমন অনেক দেশ আছে যারা দাস ক্রয় বিক্রয়ের সাথে জড়িত, সেই সংখ্যা ১৫ এর অধিক ৷ এমন দেশগুলোর সাথে বোকো হারামের দাস ক্রয় বিক্রয়ের ব্যাপারে যোগাযোগ আছে বলে জানা যায় ।

বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন, এই আধুনিক পৃথিবীতে এসেও দাস প্রথা বিলুপ্ত হয়নি বরং এখনো পুরো পৃথিবীতে প্রায় ৩ কোটির মতো দাস ক্রয় বিক্রয় হয় ৷ আধুনিক এসব দাসদের দিয়ে জবরদস্তি শ্রম, বাল্যবিবাহ, যৌন ব্যবসা ইত্যাদি করানো হয়। মূলত, বোকো হারাম এখন নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চল দখলে নিয়ে সেখানে নিজেদের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করে এবং তারা পুরো নাইজেরিয়া এবং এর আশেপাশের দেশগুলোতেও তাদের শাসন জারি করতে চায় যেহেতু তারা মনে করে পৃথিবীর কোথাও সঠিক ইসলাম চর্চা করা হয় না, তারাই একমাত্র সঠিক ইসলামের মধ্যে বিরাজ করছে। যদিও গবেষকগণ মনে করে বোকো হারাম নিজেরাই ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখে না এবং তাদের কার্যক্রমও ইসলাম সম্মত নয় বরং ইসলাম বিরোধী। ইসলাম কখনোই সন্ত্রাস কার্যক্রমকে সমর্থন করেনা।

সূত্রঃ ইতিবৃত্ত ডট কম, প্রীয় ডট কম