
সাহারার দুঃস্বপ্ন : উদ্ধারকারীরা শোকে-আতঙ্কে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন
একসময়ে ইউরোপীয়রা মরু-সাগর পাড়ি দিয়ে অন্য দেশে হাজির হতো অধিক ধন-সম্পদ আর প্রাচুর্য্যের লোভে। পরধন লোভে পাগলপ্রায় রবার্ট ক্লাইভের মতো এইসব লোক কখনো কখনো বনে যেত সেইসব দেশের রাজা-বাদশা হর্তাকর্তা। এতে বাছবিচারহীন লুণ্ঠনটা সহজ হয়ে যেত।
আজ সেইসব লুণ্ঠিত দেশের নিরন্ন মানুষ ইউরোপীয় লুটেরা দেশ এবং তাদের নেতৃত্বে থাকা অস্ট্রেলিয়া-আমেরিকায় রুটি-রুজির আশায় ছুটে যায় দলে দলে। বৈধভাবে ঢোকার সুযোগ নেই বেশিরভাগের, তাই যায় অবৈধ চোরাপথে। বিপদসঙ্কুল সেই মরু-জঙ্গল-সাগর ডিঙোতে গিয়ে প্রতিবছর অসহায় নির্মম মৃত্যুর শিকার হচ্ছে হাজারো নারী-পুরুষ-শিশু। টিভিতে, অনলাইনে আর পত্রিকার পাতায় সেইসব নির্মম অসহায় মৃত্যুর এখন আমাদের চোখ সওয়া বিষয়। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছি বাধ্যতামূলক অসহায় মৃত্যুর মুখে পড়া সেইসব আদম সন্তানদের কী রকম নরকতুল্য পরিবেশে পড়তে হয়!
আসুন আজ সেরকম একটি আদম পাচারের ভয়াবহ ঘটনার শিকার এক কিশোরীর মুখে শুনি তেমনি একটি ঘটনা। কয়েক বছর আগের ওই ঘটনা বেশ আলোড়ন ফেলেছিল। ঘটনা.কমের পাঠকদের জন্য এখানে তা তুলে ধরা হলো-
আমার পরিবারের সদস্যদের নিজহাতে দাফন করেছি। সাংবাদিকদের বলছিল ১৪ বছরের কিশোরী শাফা। আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি থেকে ৯২ লাশ উদ্ধারের আলোচিত ঘটনার পটভূমি বয়ান করছিল সে। ওই ভয়াবহ ঘটনার শিকারদের মধ্য থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া কজনের একজন হচ্ছে শাফা।
নির্দয় প্রখর সূর্যতাপে মরুভূমির চরম বৈরি পরিবেশে, ক্ষুৎ-পিপাসায় কাতর অবস্থায় তার চোখের সামনেই পরপর মারা গেছে আপন ২ বোন ও জন্মদাত্রী মা।
ক্ষুধা-দারিদ্র-যুদ্ধ পীড়িত আফ্রিকার সাব সাহারা অঞ্চল থেকে বিপজ্জনক মরু পেরিয়ে সমৃদ্ধ ইউরোপে পাড়ি জমানোর পথে পড়ে স্থলবেষ্টিত দেশ নাইজার। এরপর আলজেরিয়া। আলজেরিয়ার পর ভূমধ্য সাগর পেরোলেই স্বপ্নের দেশ ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি। মাতৃভূমি নাইজার থেকেই যাত্রা করেছিল তারা। তাদের ২গাড়ির কাফেলায় ১০০ এর বেশি মানুষ ছিল।
তবে শাফার বয়ান মতে, আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে তারা আলজেরিয়া যাচ্ছিল। কিশোরী শাফা বলছিল, পথে আমাদের ট্রাকটি বিকল হয়ে পড়ে। ট্রাক সারাতে পুরো দিন লেগে যায়। ঠিক এসময় দেখা গেল আমাদের সঙ্গে থাকা পানি ফুরিয়ে গেছে।
শাফা বলে, আমরা খোঁজাখুজি করে একটি ছোট কূপের সন্ধান পাই। একজন ওই কূপে নেমে যে পানি পেল তা পরিমাণে খুব সামান্যই। দলে অধিকাংশকেই আগের মতোই তৃষ্ণার্ত থাকতে হলো।
এ অবস্থায় একদল পানির সন্ধানে যায় আর গাড়ির চালক আমাদের বলে ওই স্থানে অপেক্ষা করতে। কিন্তু পুরো একটি দিন ও রাত পেরিয়ে গেলেও তারা ফিরে এলো না।
কাফেলার লোকজন মরতে শুরু করলো। পানির অভাবে দ্বিতীয় দিনে ১৫ জনের মৃত্যু হলো। আমরা মৃতদেহগুলো ট্রাকে তুলে যাত্রা শুরু করলাম। একপর্যায়ে দি¦তীয় গাড়িটি ফিরে এল সামান্য পানি নিয়ে। আলহামদুলিল্লাহ্।
এসময়ে আলজেরীয় নিরাপত্তা বাহিনীর একটি দলকে দেখি (অর্থাৎ তাদের কাছে সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল)। কিন্তু গাড়ির চালকরা তাদের এড়িয়ে চললো। তারা চাচ্ছিল না আমাদেরসহ নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ধরা পড়তে। কারণ, আমাদেরকে তারা অবৈধপন্থায় নিয়ে যাচ্ছিল। এ অবস্থায় চালকরা আমাদেরকে একটি গর্তে লুকিয়ে পড়তে বললো। আমরা ওই গর্তেই রাত কাটালাম। অর্থাৎ পরপর ৩টি রাত আমরা কাটালাম পানিবিহীন। আমাদের দলের একজন নারী প্রতিবাদ- করা শুরু করলো। জবাবে ড্রাইভারদের একজন একটি হোস পাইপ দিয়ে আমাদের পেটানো শুরু করলো।
প্রচণ্ড খরতাপ আর ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর নারী ও শিশুরা একে একে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছিল। চালকদের কাছে জেরিকেন ভর্তি কিছু পানি ছিল। কিন্তু যাত্রীরা মরতে থাকলেও সেই পানি তারা নিজেদের জন্য রেখে দেয়।
নিজের হাতে কবর দিলাম...
এ যেন পল্লীকবি জসিমউদ্দীনের কবর কবিতায় বর্ণিত মর্মভেদী কাহিনীর এক ভিন্ন মঞ্চায়ন। শাফা বলছিল চরম অসহায় অবস্থায় কীভাবে তার মা ও বোনেরা মারা গেল- ওই স্থান থেকে ড্রাইভাররা আমাদেরকে নাইজারের সীমানায় ফিরিয়ে আনলো। সঙ্গে থাকা দু-চার ফোঁটা পানিও এবার ফুরিয়ে গেল। অবস্থা এমন হয় যে আমরা প্রচণ্ড তৃষ্ণায় কাতর-অবসন্ন এবং যাত্রা করছিলাম ট্রাকের ওপর রাখা মৃতসঙ্গীদের লাশের ওপর বসে।
নাইজারের ভেতরের দিকে প্রবেশ করার পর ড্রাইভাররা শবদেহগুলো ট্রাক থেকে নামিয়ে নেয় কবর দেওয়ার জন্য। তারা মাটিতে লাশগুলো এভাবে রাখলো--- প্রথমে মায়েরা এরপর তাদের ওপর তাদের সন্তানরা।
আমাদের মধ্যে যারা এখনও নড়াচড়া করতে পারছিলাম তাদেরকে বলা হলো- যার যার গ্রামে পৌঁছে দেওয়া হবে।
সেদিন গাড়ির তেল প্রায় ফুরিয়ে এলো। ড্রাইভাররা তেল কেনার টাকা দিতে বললো আমাদেরকে। এরপর তারা তেল নিয়ে ফিরে আসবে বলে আমাদেরকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিলো। কিন্তু সেই যে তারা গেল, আর ফেরেনি।
খাদ্য এবং পানিবিহীন অবস্থায় আমরা ড্রাইভারদের অপেক্ষায় মরুভূমিতে আরও ২দিন পার করলাম। এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম হাঁটা শুরু করার।
এসময় আমাদের পাশ দিয়ে কিছু গাড়ি পার হতে দেখলাম। তাদের থামাতে চেষ্টা করলাম কিন্তু কেউ সারা দিল না আমাদের আবেদনে। উল্টো একটি গাড়ি আমাদের ৩ জনকে চাপা দিয়ে হত্যা করে পালালো।
এখন আমরা বাকি রইলাম ৮ জন যাদের মধ্যে রয়েছেন আমার মা এবং ছোট বোনেরা। ক্লান্তির চরম পর্যায়ে পৌঁছে একটি গাছ পেয়ে তার নিচে বসে পড়ি সবাই। আমার একজন বোন মারা যায় সেখানে। তাকে সেখানেই মাটি দেই।
এরপর ফের পথচলা। একদিন পর আমার দ্বিতীয় বোনটিও চলে গেল জীবনের মায়া ছেড়ে। তৃতীয় দিনে আমার মাও গেলেন। তাদের সবাইকে এই আমি কবর দিয়েছি।
অতঃপর উদ্ধার...
পাশ দিয়ে যাওয়া কোনও গাড়িই আমাদের সাহায্যে থামছিল না।
একপর্যায়ে একটি গাছ দেখে তার ছায়ায় আমি বসে পড়লাম। সব আশা ভরসা প্রায় ছেড়ে দিয়েছি... এমন সময়ে একটি গাড়ি দেখলাম। আমি আমার গায়ের জামাটা খুলে পাগলের মতো তা নাড়তে থাকলাম। শেষ পর্যন্ত চালক থামলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন ঘটনা। আমি বললাম। গাড়ির আরোহীরা আমাকে কিছু দুধ, পানি ও চালের পিঠা খেতে দিলেন। খাওয়া শুরু করলাম কিন্তু গলা দিয়ে নামছিল না। এটা দেখে তারা আমাকে একটু চা করে দিল।
এরপর আমরা আরলিটে পৌঁছাই। সেখানে পথে বিচ্ছিন্ন আমার দাদুকে ফিরে পেলাম।
আমার বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন, এখন আমার মা-বোনেরাও মারা গেছে। আমার কোনও বোন নেই, ভাই নেই।
এখন আমি আমার খালার সঙ্গে বসবাস করছি। শুনেছি, আমাদের ১০০ জনেরও বেশি সংখ্যক মানুষের দলটি থেকে আমি, একটি ছোট্ট মেয়ে ছাড়া আর মাত্র ১৮ জন বেঁচে ফিরতে পেরেছে।
উল্লেখ্য, পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নাইজারের উদ্ধারকর্মীরা সাহারা মরুভূমি থেকে নারী, শিশুসহ অন্তত ৯২ অভিবাসীর মৃতদেহ উদ্ধার করে। এদের মধ্যে ৫২টিই শিশু। বাকীদের মধ্যে ছিল ৩৩জন নারী ও ৭জন পুরুষের লাশ। শবদেহগুলো উদ্ধারকালে সংশ্লিষ্ট উদ্ধারকারীরা চোখের সামনে মানুষের, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের অসহায় মৃত্যুর নমুনা দেখে যুগপৎ শোকে-আতঙ্কে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন।
কতোটা নির্মম পরিণতি ডেকে আনতে পারে উন্নত জীবনের আশায় বিদেশে পাড়ি জমানোর বাসনায় অসহায় মানুষের বেপরোয়া পদক্ষেপ আর একই সঙ্গে কতোটা নির্মম-নির্দয় হতে পারে একশ্রেণির আদম ব্যবসায়ীর বিবেক তা ভেবে বুক কেঁপে ওঠে সবার।
উদ্ধারকর্মীদের ধারণা, মৃতদেহগুলো অভিবাসী শ্রমিক, তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের। মৃতদেহগুলো সাহারা মরুভূমির প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। অধিকাংশই পচে বিকৃত অবস্থায় ছিল। বেশ কটি লাশের বেশির ভাগ শিয়াল কিংবা অন্য প্রাণী খেয়ে ফেলেছে।
উন্নত রুজি আর আফ্রিকার যুদ্ধ-ক্ষুধা-অনিশ্চয়তা থেকে বাঁচতে সাব সাহারা অঞ্চল থেকে ইউরোপে পাড়ি জমাতে দুর্গম ও প্রতিকূল আবহাওয়ার মরুভূমিতে শত শত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বেশির ভাগ আদম সন্তানই শেষ পর্যন্ত মঞ্জিলে পৌঁছাতে পারে না। উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতেই আটকা পড়ে।
জাতিসংঘের মতে, শাফার দল যে পথে যাত্রা শুরু করেছিল, সে পথে প্রতি বছর প্রায় ৮০ হাজার হতদরিদ্র আফ্রিকান জীবনকে বাজী রেখে যাত্রা করে উন্নত জীবনের জন্য। এমনকি নিম্নতম মজুরির কাজের জন্যও এপথে বেরিয়ে পড়ে অসহায় মানুষ।
বেঁচে যাওয়াদের সূত্রে ধারণা করা যাচ্ছে, সে বছর সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে অক্টোবরের শুরুর দিকের কয়েক দিনে সাহারার বুকে এই নির্মম ট্রাজেডির ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনার পর নাইজারে নারী ও শিশুদের দেশ ছেড়ে উত্তর দিকে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বিবিসি, ডেইল মিরর।
লেখকঃ আহসান হোসেন