সাম্প্রতিক

হৃদরোগ চিকিৎসায় অবিশ্বাস্য সাধনের তাক লাগানো কাহিনী

সাম্প্রতিক সোমবার, ২০ আগস্ট ২০১৮ ০৫:১৬:১২

জনাব গলেসওয়ার্থি একজন মেধাবী প্রকৌশলী এবং দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তি। তার উদ্ভাবন হৃৎচিকিৎসায় যুগান্তকারী সাফল্যের দূয়ার উন্মোচন করেছে। কথাগুলো শেফিল্ড টিচিং হসপিটাল (এনএইচএস ট্রাস্ট) এর কনসালট্যান্ট কার্ডিয়াক সার্জন অধ্যাপক গ্রাহাম কুপারের। যাকে নিয়ে তার এই প্রশংসাবাণী সেই টল গলেসওয়ার্থি একজন অ্যারোনটিক্যাল প্রকৌশলী। যন্ত্রপাতির নানা ধরনের সমস্যা চিহ্নিতকরণ আর তা খুলে আলাদা আলাদা করে সমস্যা সমাধান করে ফের জুড়ে দেওয়া তার কাছে অসাধ্য কোনও বিষয় নয়। কিন্তু টানা ৩০ বছর ধরে হৃদযন্ত্র সংশ্লিষ্ট দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত এই লোকটি সেই ভয়াবহ সমস্যা সমাধানের কেরামতি তো আর দেখাতে পারেন না। কারণ মানবদেহ ব্যবচ্ছেদ করে ভেতরকার সূক্ষœাতিসূক্ষè স্পর্শকাতর বিষয়াদি নিয়ে কিছু করার যোগ্যতা অবশ্যই চিকিৎসাশাস্ত্রে অভিজ্ঞ অধ্যাপক-শল্যবিদদেরই মানায়।

এছাড়া যুক্তরাজ্যের গ্লুকেস্টারশায়ারের বাসিন্দা ৫৭ বছর বয়সী প্রকৌশলী গলেসওয়ার্থির সমস্যাটাও খুব জটিল। রোগটির নাম মারফান সিনড্রোম। এ রোগে আক্রান্তদের শরীরের সংযোগক টিস্যুগুলো ত্রুটিপূর্ণ থাকে। এই টিস্যু বা কলাগুলোর প্রধান কাজ হচ্ছে বিশেষত দেহাভ্যন্তরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোকে ধারণ করে রাখা। অর্থাৎ ওই অঙ্গগুলোর নির্দিষ্ট আকার এবং নির্দিষ্ট স্থানে থাকাটা নিশ্চিত করে এসব কলা। কিন্তু যারা মারফান সিনড্রোমে আক্রান্ত তাদের অঙ্গসন্ধি, চোখ এবং বিশেষ করে হৃদপি-ে জটিলতা দেখা দেয়। আমরা জানি, হৃদপি- সারা দেহে রক্ত পাম্প করে। হৃদপি- থেকে বের হওয়া প্রধান ধমনী যাকে আমরা মহাধমনী হিসেবে চিনি এই রক্ত সঞ্চালনে প্রধান ভূমিকা রাখে। নিয়মিত ছন্দে সঙ্কোচন-প্রসারণের মাধ্যমে মহাধমনী হৃদপিন্ডের সরবরাহ করা রক্ত প্রবাহের চাপের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে। সুস্থ স্বাভাবিক মানুষজনের ক্ষেত্রে এই সঙ্কোচন প্রসারণটা স্বাভাবিক নিয়মেই চলতে থাকে। কিন্তু মারফান সিনড্রোমে আক্রান্তদের টিস্যুগত ত্রুটির কারণে ধমনী প্রসারিত হওয়ার পর অনেক ক্ষেত্রেই সংকোচনটা আর হয় না। এর ফলে ক্রমশ এটা স্ফীত হতে থাকে। এতে দেহে স্বাভাবিক রক্তপ্রবাহ ব্যহত হয়। ভুক্তভোগীর শরীরে শুরু হয় নানান জটিলতা আর কষ্টের। এক পর্যায়ে অবস্থা এমনও হয় যে স্ফীত হতে হতে মহাধমনী ফেটেও যেতে পারে। এই অসহনীয় ভয়াবহ সমস্যাটাই তিন যুগ ধরে বয়ে বেড়াচ্ছিলেন গলেসওয়ার্থি। মহাধমনী বার্স্ট করে মহসংকটে পড়ার ঝুঁকির মধ্যে বসবাসের একপর্যায়ে ২০০০ সালে তার চিকিৎসক জানালেন, এবার অপারেশনের সময় হয়েছে। বিপর্যয় ঠেকাতে হলে আর দেরি করা যায় না। কিন্তু এজন্য প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতিটি পছন্দ নয় গলেস সাহেবের। ওই শল্যচিকিৎসাটা একে তো দীর্ঘসময় ধরে চলে তার ওপর বেশ জটিল। যা ইচ্ছা ঘটে যেতে পারে। অর্থ ব্যয় তো আছেই। অপারেশনের সময়ে প্রায় ক্ষেত্রেই মহাধমনীর ত্রুটিপূর্ণ অংশ বাদ দিয়ে কৃত্রিম মহাধমনী জোড়া লাগানো হয়। এই অপারেশনে অনেক সময়ে হৃৎপি-ের অকেজো ভাল্বও প্রতিস্থাপন করা হয় কৃত্রিম ধাতব ভাল্ব দিয়ে।

কিন্তু হৃদপিণ্ডে মেটাল বা ধাতব ভাল্ব বসালে এর প্রভাবে রক্ত ঘন হয়ে যেতে থাকে। এ অবস্থা মোকাবেলায় সারাজীবন রক্ত তরলীকরণের ঔষধের ওপর চলতে হয়। আবার এ ঔষধ গ্রহণের ফলে যে কোনও ছোটখাটো দুর্ঘটনা-আঘাতেও শরীর থেকে গলগল করে রক্ত বের হওয়ার ঝুঁকি থাকে (ঔষধের প্রভাবে রক্ত স্বাভাবিকের চেয়ে তরল থাকায়)। কিন্তু এই ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জটিলতা একেবারেই মেনে নিতে অনাগ্রহী গলেস বাবু। এ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য এরকম আমি কাঁচের বয়েমের নিরাপত্তা বেষ্ঠনীর ভেতর জীবন কাটাতে চাইছিলাম না। আর তাই সন্ধান করছিলাম এমন একটি কায়দার যাতে শরীরে কাটা-ছেড়াটা কম হবে, এবং একই সঙ্গে তা হবে সহজতর যাতে আমার হৃৎপিন্ডের কোনও অংশই কেটে বাদ দেওয়া হবে না।   
আর তাই এর সমাধানকল্পে তিনি তার প্রকৌশল অভিজ্ঞতার প্রয়োগ ঘটালেন। এক্ষেত্রে তার চিন্তাধারা এগোচ্ছিল একদম সরলসিধা, সাদামাঠা কায়দায়। গলেসওয়ার্থ বলেন, বাগানে ব্যবহার করা হোসপাইপের কোনও অংশ পানির চাপে কখনও কখনও ফুলে ওঠে। এক্ষেত্রে আমরা করি কী?  ইনস্যুলেশন টেপ দিয়ে পাইপের ফুলে যাওয়া অংশটুক মুড়িয়ে দেই যাতে তা ফেটে না যায়।
এটা অতি সরল এক হিসাব যা খুবই লাগসই। এখন  চিকিৎসাশাস্ত্রে এর প্রায়োগিক সম্ভাবনার কথা বিশেষজ্ঞ সার্জনদের বুঝিয়ে বলতে পারলেই হয়। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাঁধবে কে?  নিজে তো চিকিৎসক নন। আর চিকিৎসকদেরকে তখনকার বিচারে এই আপাত অদ্ভূত বিষয়টিকে বোঝানো সহজতর বিষয় ছিল না। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা পুরনো রীতি-নিয়ম ছেড়ে অনিশ্চিত নয়া এক কায়দায় এসব জটিল অপারেশন করে হাত মকশো করেও নিজেকে হাসির পাত্র বানাতে কে চাইবে? তবে কোনও প্রতিকূলতাকেই পাত্তা না দিয়ে গলেসওয়ার্থি ঠিক করলেন, যে করেই হোক ডাক্তারদের বিষয়টা বোঝাতেই হবে। তিনি তখন বেপরোয়া। এবং বিরামহীন চেষ্টার একপর্যায়ে লন্ডনের গাইস হসপিটালের প্রফেসর টম ট্রেজার এবং লন্ডনেরই রয়েল ব্রম্পটন হসপিটালের প্রফেসর জন পিপ্পার মনোযোগী হলেন তার ‘উদ্ভট’ ধারণাটির প্রতি। তারা পরখ করে দেখতে চাইলেন ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যার কিছু সরল ধারণা যদি নয়া কিছু শেখা যায়!

নতুন তবে চমৎকার

গলেসওয়ার্থিওর ধারণাটি নিয়ে টানা ৩বছর একটি দল নিয়ে কাজ করলেন অধ্যাপক মহাশয়রা। তারা অনুভব করলেন ধারণাটি নতুন, তবে বেশ লাগসই হতে পারে। এটা করতে পারলে মহাধমনীকে একটি আবরণ দিয়ে আঁটসাট করে বেঁধে বা সেলাই করে দেওয়া যাবে যার ফলে এটা রক্তচাপে ফুলে-ফেঁপেও উঠবে না আবার সঠিক অবস্থানে থেকে ঠিক ঠিক কাজও করে যাবে। আবরণটি দেওয়া হবে শল্যবিদ্যায় হরদম ব্যবহৃত একধরনের জাল দিয়ে। বড় ধরনের কাঁটাছেড়ায় এটা ব্যবহৃত হয়ে আসছে বহুকাল যাবত। তারা এটাও ঠিক করেছেন, ওই আবরণটা দিতে হবে মহাধমনীর বাইরের দিকটায়, ভেতরে নয়। এর ফলে অপারেশনের জটিলতা অনেক কমে যাবে আর বাড়তি সুবিধাটা হলো এর ফলে রোগীকে পরবর্তীতে জীবনব্যাপী রক্ত জমাটরোধী ঔষধের বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত করা যাবে। আরও সুবিধা হচ্ছে, এতে করে ছুরি-কাঁচির তলায় অর্থাৎ অপারেশন টেবিলে বেশ কম সময়ই দিতে হবে রোগী আর ডাক্তারদেরকে।  
চূড়ান্ত সেই দিন
বিশেষজ্ঞরা এই ধরাণাটির ওপর কাজ শুরুর ৪ বছরের মাথায় তারা পুরো প্রস্তুত অবস্থায় পৌঁছলেন এর বাস্তবায়নে। এই গবেষণা বা ব্যবহারিক পরীক্ষার প্রথম গিনিপিগ গলেসওয়ার্থি। ওই পর্যায়ে বিষয়টি এমন ছিল যেন নিজের আবিষ্কৃত বিষ নিজেই চেখে দেখা, আর কী! বিষয়টির ওপর একাধিকবার অনুশীলন করেছেন বিশেষজ্ঞ দলটি যাতে চূড়ান্ত মুহূর্তে হাত-ফস্কানোর মত ঘটনা না ঘটে। আর গলেসওয়ার্থি নিজে ছিলেন উৎসাহের চরম পর্যায়ে। তবে সেই তিনিও অপারেশনের টেবিলে শোওয়ার ওই দিনটিকে চিহ্নিত করেছেন জীবনের সবচেয়ে ভীতিকর দিন  হিসেবে। তিনি বলেন, পেশাগত জীবনের পুরোটা আমি পার করেছি প্রকল্প-পরিকল্পপনা ব্যবস্থাপনার কাজে। কিন্তু এটা বলতেই হয় এবারকার ব্যবস্থাপনার কাজটি ছিল পুরো অন্যরকম। এই পরিকল্পনার ‘বলির পাঁঠা’ বলতে ছিলাম আমি-ই, যাকে নিজেই খড়গের সামনে গর্দান আগে বাড়িয়ে দিতে হবে।
এরপর যা ঘটেছে তা হচ্ছে সাফল্যের এক নয়া ইতিহাস। রাজকীয় ব্রম্পটন হাসপাতালে দু ঘণ্টার ওই অপারেশনের পর ৯টি বছর গত হয়েছে, তবে গলেসওয়ার্থি সুস্থ আছেন। তার মহাধমনী আর স্ফীত হয়ে যায়নি।
গলেস বলেন, মোটের ওপর বলা যায়, আমার মহাধমনী এখন স্বাভাবিক। আমি এখন স্বাভাবিকভাবে স্বাস-প্রস্বাস চালাচ্ছি, ঘুম আর বিশ্রাম নিচ্ছি আরাম করে যা দীর্ঘ অনেক বছর যাবত আমার ভাগ্যে হয়ে ওঠেনি।
তবে প্রথমদিকে এই উদ্যোগটা গলেসওয়ার্থির একার প্রাণ বাঁচানোর লক্ষ্যে পরিচালিত হলেও এখন সেটা এ ধরনের অনেক রোগীর জন্য আশার আলো হয়ে দেখা দিয়েছে। জন র্যা ডক্লিফ হসপিটাল, অক্সফোর্ড হসপিটাল এবং বেলজিয়ামের ল্যুভর ইউনিভার্সিটি হসপিটালের ৪০ জনেরও বেশি রোগীকে এই সেবা দিয়েছে চিকিৎসক দলটি।

গলেসমহাশয় উদ্ধাবিত এই চিকিৎসা কায়দায় মারফান সিনড্রোম প্রতিরোধে সুস্থ হয়ে ওঠাদের একজন হলেন, ফুটবলার অ্যান্ড্রু অ্যালিস। ২৭ বছর বয়সী ফুটবল পাগল এই মানুষটি বলেন, মাত্র কয়েকজনের ওপর চালানো হয়েছে এমন একটি নবীন চিকিৎসা পদ্ধতির সামনে পড়াটা সত্যি ভীতিকর ছিল। কিন্তু এখন আমি আনন্দিত, যে এটা করেছিলাম। অপারেশনের ৫ বছর পর অ্যান্ড্রু এখন সুস্থ্য-সবল আছেন। তিনি হৃদরোগমুক্ত অন্যদের মতই জীবন কাটাচ্ছেন। গলেস বাবুর উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে ২০০৭ সালে শল্য চিকিৎসা করান অ্যান্ড্রু, সম্প্রতি স্ক্যান করে দেখা গেছে, তার মহাধমনী গত ৫ বছরে স্ফীত হয়নি। প্রসঙ্গত, এই একই রোগে অ্যান্ড্রুর বাবা মারা গেছেন যুবক বয়সে। অ্যান্ড্রু বলেন, গলেসের উদ্ধাবন ভীতিকর এক শল্য চিকিৎসার খাড়া থেকে রক্ষা করেছে আমাকে যা মাথার ওপর ঝুলে ছিল দীর্ঘকাল ধরে।

যেতে হবে আরও বহুদূর...

এই চিকিৎসাসেবাকে আরও উন্নত করতে এবং বিশ্বজুড়ে অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে গলেসওয়ার্থি উইরোপজুড়ে চিকিৎসাবিশেষজ্ঞদের আহ্বান জানিয়ছেন তার উদ্ভাবিত এই পদ্ধতিটির ওপর আরও পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ ও পরখ করে দেখতে।
তবে অন্যান্য যে কোনও অপারেশনের মতই এটাও একেবারে ঝুঁকিমুক্ত নয়। সিংহভাগ রোগীর ক্ষেত্রে এটা চমৎকার কাজে দিয়েছে। শুধু অপারেশনকালীন জটিলতায় একজনের মৃত্যু ঘটেছে।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক গ্রাহাম কুপার বলেন, নয়া এই পদ্ধতির কিছু সুবিধা থাকতে পারে। এর ফলে রোগীদের কম সময় হাসপাতালে থাকতে হয় এবং পদ্ধতিটিও সহজতর। তবে অন্য পদ্ধতিগুলোর তুলনায় এটি সেরা চূড়ান্ত এ রায় দেওয়ার আগে এ সংক্রান্ত চিকিৎসাজনিত ভাল-মন্দের তথ্য-উপাত্ত বিচার-বিশ্লেষণের জন্য বেশ কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে আমাদের।
তবে অদম্য উৎসাহী গলেসওয়ার্থি সেইপথেই অগ্রসর হচ্ছেন, এবং বেশ দ্রুতই অগ্রসর হচ্ছেন। কারণ তিনি জানেন এগিয়ে গেলেই রাস্তা পাওয়া যায়। সম্প্রতি তিনি ইউরোপিয়ান হার্ট জার্নাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, যাতে করে তারা চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের একত্র করে তাদের সামনে উদ্ভাবনটি তুলে ধরে এর মানোন্নয়নে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-যাচাই-পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করেন। তাদের পরামর্শে ব্যবস্থাটি আরও নিখুঁত হয়ে উঠতে পারে যা মহাধমনী রোগের জটিলতায় ভুগতে থাকাদের মুক্তির সহজতর উপায়কে সহজলভ্য করে তুলবে।

(বিবিসি, ডেইলি মেইল অবলম্বনে)

লেখকঃ আহসান হোসেন