সাম্প্রতিক

ক্রিসমাস দ্বীপের আগুনরঙা কাঁকড়াদের দৃষ্টিনন্দন অভিযাত্রা

সাম্প্রতিক বুধবার, ০৮ আগস্ট ২০১৮ ০৫:০৯:১৩

এমন দৃশ্য দেখে রাজনৈতিক হানাহানির কবলে পড়ে দিশেহারা অনেক দেশের মানুষ আফসোস করে বলতেই পারেন। হায়, মানুষ না হয়ে ক্রিসমাস দ্বীপের কাঁকড়া হলেও হয়তো ভাল হতো! হ্যাঁ, দ্বীপ মহাদেশ অস্ট্রেলিয়ার ক্রিমসন দ্বীপের কাঁকড়াদের বছরওয়ারি প্রজণন মৌসুমে বেশ কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ভারত মহাসাগর পাড়ে যাওয়ার অভিযানকালে সেদেশের সরকার এবং সাধারণ মানুষ প্রাণীগুলোর নিরাপত্তায় যে ভূমিকার রাখে, তা দেখলে তাই মনে হবে আমাদের। অস্ট্রেলিয়ায় প্রতি বছর গ্রীষ্ম মৌসুমে মনোলোভা আগুনরঙা কাঁকড়াবাহিনীর ছন্দোবদ্ধ সাগরযাত্রা (Red Crab Migration) নিয়ে এবারের প্রতিবেদন।

প্রতিবছর অস্ট্রেলিয়ায় বসন্তের শেষে ক্রিসমাস দ্বীপটি যেন  হঠাৎ করেই লালে লাল হয়ে যায়। আশপাশে আরক্তিম আভা ছড়িয়ে চলমান একধরনের প্রাণীতে ছেয়ে যায় মাইলের পরম মাইল রাস্তা। বৃষ্টিভেজা রেইনফরেস্টের মাটির তলায় লুকোনো আদ্র বাসস্থান অর্থাৎ গর্তগুলো ছেড়ে আসা উজ্জ্বল লাল রঙের এই প্রাণীগুলো উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত ক্রিসমাস দ্বীপের স্থায়ী বাসিন্দা। তবে মনপছন্দ সেই বাসস্থান ছেড়ে তারা সমুদ্রের দিকে অভিযাত্রা করে প্রজণন এবং পরবর্তী প্রজন্মকে এই মনভোলানো পৃথিবীতে স্বাগত জানানোর জন্য।

৪ কোটি কাঁকড়ার শোভাযাত্রা!

দেশান্তর গমনের মত এই অভিযাত্রায় অংশ নেয় ৪ কোটিরও বেশি প্রাণী। এই মনোরম দৃশ্যের মুন্ত্রমুগ্ধকারী অভিজ্ঞতা স্বচক্ষে না দেখলে এর সৌন্দর্য্য পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা অসাধ্য। অপলক দেখতে দেখতে হঠাৎ একপর্যায়ে আপনার মনে হতে পারে দিগ্বীজয়ী কোনও বীর যোদ্ধার সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী স্লোমার্চ করে চলছে নতুন কোনও দেশ জয়ে

এদের মধ্যে সিংহভাগ কাঁকড়াই হয় উজ্জ্বল লাল রঙা। তবে এদের মধ্যে সংখ্যালঘু একটি দল আছে কমলা রঙা। আর খুব অল্পসংখ্যক থাকে নীলচে-বেগুনী (পার্পল) রঙের। পুরুষগুলো আকারে স্ত্রীদের চেয়ে একটু বড় হয়। মেয়েগুলোর পেট পুরুষগুলোর চেয়ে কিছুটা স্ফীত হলেও তাদের থাবাগুলো আবার পুরুষদের তুলনায় ছোট। তাদের খাবার-দাবার হচ্ছে ঝরে পড়া পাতা, এরমধ্যে তাজা সবুজ পাতা এদের খুব পছন্দ। তবে ফল, ফুল আর ফলবীজেও অরুচি নেই। এর বাইরে মরে পড়া পাখি বা অন্য কাঁকড়াও খায়। আর মাঝেমধ্যে মানুষের ফেলে দেওয়া বাসি-আধখাওয়া খাওয়া-খাদ্যেরও সুযোগমত সদ্ব্যাবহার করে।

১১ সেন্টিমিটার প্রাণীর ৯ কিলোমিটার পথ পাড়ি

অস্ট্রেলিয়ায় অক্টোবর, নভেম্বর বা ডিসেম্বরের প্রথম প্রবল বৃষ্টিপাতের শুরুতে লাল এই কাঁকড়ার দল শুরু করে তাদের অভিযাত্রা। প্রসঙ্গত অষ্ট্রেলিয়ায় অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর এই ৩ মাস গরম কালের মধ্যে পড়ে। এই সময়টায় ওই অঞ্চলের আবহাওয়ায় যথেষ্ট পরিমাণে আদ্রতা থাকে যা বড় আকারের এই কাঁকড়াগুলোর অভিযানকালীন উদ্দেশ্য সাধনে সহায়ক। টেনেটুনে ১১ সেন্টিমিটার আকারের ওই কাঁকড়াগুলো কঠোর শ্রম দেয় সমুদ্রে পৌঁছানোর ওই সময়টায়। নিজেদের স্থায়ী বাসস্থান ক্রিসমাস দ্বীপ থেকে ৯ কিলোমিটার দূরের ভারত মহাসাগর পাড়ের ওই পছন্দনীয় জলমগ্ন জঙ্গুলে স্থানটিতে যেতে তাদেরকে পাড়ি দিতে হয় ৯ কিলোমিটার পথ। তবে ওইটুকুন পথ পাড়ি দিতেই লেগে যায় ৫টি দিন। কখনো কখনো ৭ দিন লেগে যায়।

একদিকে ৯ কিলোমিটার পথ তারা ৫দিনে পাড়ি দিয়ে দেয় কষ্টেসৃষ্টে অপরদিকে ওই সময়টায় তাদের রক্ষার জন্য অস্ট্রেলিয়ার একদল মানুষ দিবারাত্র অসম্ভব ব্যস্ত আর সতর্ক এক সময় পার করে। বলা যায়, কাঁকড়াদের জন্য বেশ কষ্টই করতে হয় তাদের। কারণ সমুদ্র যাত্রায় কাঁকড়াদের যাত্রাপথে পড়ে বেশকিছু পথঘাট আর লোকালয়। কিন্তু দৃষ্টিনন্দন এই প্রাণীগুলো তো আর তা জানে না বা জানলেও মানুষের তৈরি ট্রাফিক সিগন্যাল আর নিয়ম মানা তো তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মের টানে তারা ছুটে চলে সাগরের পানে। তাই পার্কস অস্ট্রেলিয়া নামের প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা কাঁকড়া বাহিনীর সাগরডাকে সাড়া দেওয়ার পর্বকে নির্বিঘ্ন করতে অক্টোবর মাসকে সামনে রেখে প্রতিবছর ওই সময়টাতে ক্রিসমাস দ্বীপের ন্যাশনাল পার্ক এলাকাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করে জনসাধারণকে সতর্ক করতে। কাঁকড়া বাহিনীর চলার স্বাভাবিক রুটগুলোতে পড়া সব পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়, অনেক স্থানে নির্মাণ করা হয় বেড়া। এছাড়া কোথাও কোথাও সুরঙ্গপথও তৈরি করতে হয় তাদের। আর কাঁকড়াদের সাগর-ডাক পর্বের শুরু থেকে তা চলমান থাকা পর্যন্ত গাড়ির চালকদের বিভিন্নভাবে বারবার সতর্ক করা হয় যাতে কোথাও আগুনরঙা প্রাণীগুলোকে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে থামিয়ে ফেলা হয় গাড়ি।

আগে আগে পুরুষ দল

ভারত মহাসাগরের পাড়ের বালুকাময় জলো দিকটায় পৌঁছানোর পরপর কাঁকড়াগুলো লেগে পড়ে গর্ত খোড়ার কাজে। সে দৃশ্য চোখ ভরে দেখার মতই মনোহর। তবে গর্ত বা বাসা তৈরি পর্ব শেষের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় তা দখলের সার্বজনীন লড়াই। প্রসঙ্গত, গর্ত খোড়া এবং তা দখলের পর্বটায় থাকে কেবল পুরুষরা। কারণ, অভিযাত্রী দলের প্রথম ভাগে থাকে কেবল পুরুষরা। মালকিন দল অর্থাৎ মেয়েরা আসেন হেলে দুলে দিন পাঁচেক পর। কখনো সাত দিন পর তারা আসেন। নারীরা এসে পৌঁছানোর পর শুরু হয় মিলন পর্ব। এরপর স্ত্রী কাঁকড়ারা সাগরপাড়ের ওই অস্থায়ী আবাস অর্থাৎ গর্তগুলোয় সমাসীন হয়ে থাকে চাঁদের দ্বিতীয় পক্ষের শেষভাগ পর্যন্ত।

নারী কাঁকড়াগুলো সাগর অভিযান শুরু করতে অনেক সময় কিছুটা বিলম্ব হয়ে যায়। তবে আগে পড়ে যাই হোক, তারা ডিম দেওয়া এবং তা সাগরের লোনা পানির স্পর্শে (অনেকটা ডিমে তা দেওয়ার মত) পরিপুষ্টিসাধনের মাধ্যমে বাচ্চা  ফোটার পরিবেশের জন্য চান্দ্রমাসের শেষ সপ্তাহের  প্রথম দিনটির অপেক্ষায় থাকে। এটাই ডিম প্রসব ও তার সূত্রে বাচ্চা ফোটানোর আদর্শ সময়। জীববিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, চান্দ্রমাসের ওই সময়টায় সমুদ্রে জোয়ার-ভাটার তারতম্যটা কম থাকে। আর এই পরিবেশে বেশির ভাগ ডিমের টিকে থাকা এবং তা থেকে বাচ্চা ফোটার সম্ভাবনাটাও বেশি থাকে। তাই অসাধারণ প্রকৃতি-পাঠক মা কাঁকড়ারা এভাবে সময়ক্ষণ হিসেব করে ডিম ছাড়ে। এটা ঘটে মোটামুটি ক্রিসমাসের আগে পড়ে।

অপরদিকে, মিলন শেষে পুরুষ কাঁকড়ার দল ফিরে চলে ক্রিসমাস দ্বীপের ভেতরকার বৃষ্টিস্নাত রেইনফরেস্টেও নরম মাটির তলায় তাদের মূল বাসগৃহে। অর্থাৎ, স্ত্রীরা যেমন সাগরপাড়ে আসে দেরিতে, তেমনি ফেরেও দেরিতে। আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতির ওপর নির্ভর করে কাঁকড়াদলের ভারত মহাসাগর অভিমুখী অভিযান শুরু হয় ওই সময়ের ৭ থেকে ১৮ দিন হেরফের হয়। তাপমাত্রা যখন কিছুটা শীতল থাকে, অর্থাৎ ভোর বা সন্ধ্যালগ্নে তারা পথ চলতে পছন্দ করে। তবে এরমধ্যে যদি বাতাসে আদ্রতা কমে যায়, অর্থাৎ আবহাওয়ায় বৃষ্টিভেজা ভাবটা না থাকে, তাহলে তারা মাঝপথেই যে যেখানে আছে থেমে যায়। এরপর প্রকৃতিতে ভেজা ভেজা ভাবটা ফের শুরু হলে তাদের চলাও আবার শুরু হয়।

অপরদিকে, সাগরের লোনা পানিতে মা কাঁকড়া ডিম প্রসব করার পরপরই তার লার্ভা সাগরের উষ্ণ লোনা পানিতে দুলে দুলে কয়েকটি স্তর পেরিয়ে সপ্তাহ চারেক সময়ের মধ্যে খুদে খুদে কাঁকড়া শাবকে ভরে যায় ওই এলাকার সমুদ্র। তবে সাগর থেকে লাখ লাখ ওই কাঁকড়া শিশুর ভূমিতে ফিরে আসার তেমন নিশ্চয়তা নেই। কোনও কোনও বছর বা বছরের পর বছর এমনও দেখা গেছে একটি ক্ষুদে কাঁকড়াও ফিরে আসেনি তাদের পিতৃ-মাতৃভূমির মূল আবাসকেন্দ্রে। কোনও কোনওবার আসে অল্পসংখ্যক। তবে যেসব বছরে সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে তারা ফেওে, তা হয় আরও একটি দর্শনীয় ঘটনা।       

সূূত্র: বিবিসি, ক্রিসমাস ডটনেট, পার্কস অস্ট্রেলিয়া

লেখকঃ আহসান হোসেন