সাম্প্রতিক

নামিবিয়ার কঙ্কাল উপকূল

সাম্প্রতিক বুধবার, ০৮ আগস্ট ২০১৮ ০৩:২৮:৫৭

পর্তুগিজ তিমি শিকারী নাবিক জলদস্যুরা জায়গাটির নাম দিয়েছিল গেট অব হেল । আর নামিবিয়ার বুশম্যান গোষ্ঠীর লোকজনের মতে এলাকাটি ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন প্রচন্ড রাগ নিয়ে। কর্কশ কঠোর সেখানকার পরিবেশ প্রকৃতি। ছোটখাটো কিছু প্রাণী সেখানে বেঁচে থাকে কঠিন সংগ্রামের মাধ্যমে। উদ্দাম সাগরপাড়ের মরুময় শুষ্কংকাষ্ঠং ওই পরিবেশে আদ্রতার একমাত্র উৎস সামুদ্রিক জলীয়বাষ্প। ছোট ছোট পশুপাখি বিশেষ করে একধরনের শিয়াল সেখানে তৃষ্ণা মেটায় পাথরের গায়ে মিশে থাকা জলীয় বাস্প গায়ে মেখে।

আকাশ থেকে এর নিরস-নিরানন্দ তটরেখা দেখতে দৃষ্টিমনোহর। তীরে আছড়ে পড়া শুভ্র ফেনার ঢেউয়ের পাড় লাগানো সবুজাভ গভীর সাগর। দিনমান সেই ঢেউ মিলিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের তটরেখায়। দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনে হবে তার তরঙ্গ-হিন্দোল যেন আন্দোলিত করে অতিদূর বিস্তৃত বালিয়াড়িকেও। তবে আকাশ থেকে যাই দেখাক, ভূমিতে এই জায়গার পটভূমি এক ভিন্ন ইতিহাস তুলে ধরে। আটলান্টিক মহাসাগর থেকে ছুটে আসা বেঙ্গুয়েলা স্রোত এই তটে আঘাত হানে ক্রদ্ধ গর্জনে, প্রচন্ড তেজের সঙ্গে।

সুশীতল আটলান্টিকের ঠান্ডা স্রোত চামড়া পোড়ানো নামিব অঞ্চলে হামলে পড়ে যেন জলদস্যুর রক্তলোলুপ ক্রুর উল্লাসে। আগে এই জায়গাটায় তিমি ও সিলমাছ নির্ভর শিল্পের এক জমজমাট মোকাম ছিল, এখনও তার সাক্ষ্য দিচ্ছে সৈকতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তিমি-সিলের অসংখ্য কঙ্কাল। বোঝা যায়, ব্যবসা-বাণিজ্যের চরম রমরমাকালে কেন অমন ভীতিকর নাম রাখা হয় এ জায়গাটার। এর নাম স্কেলিটন কোস্ট অর্থাৎ কঙ্কাল উপকূল! উল্লেখ্য, সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী তিমি-সিলের তেল, হাড় আর মাংসনির্ভর পণ্যের জন্য সপ্তদশ, অষ্টাদশ আর উনবিংশ শতাব্দী এমনকি বিংশ শতাব্দীতে হাজারে হাজারে তিমি শিকার বা হত্যা করা হতো। ১৯৩০ সালের এক হিসেবে দেখা যায়, সে বছর ৫০ হাজারের বেশি তিমি হত্যা করা হয়। পরে ১৯৮৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল হোয়েলিং কমিশন (আইডব্লিউসি) আইন করে অকারণে স্রেফ বাণিজ্যিক কারণে তিমি হত্যা নিষিদ্ধ করে।

তবে তার আগে শতাব্দীকালধরে নির্বিচারে হত্যা করা তিমির কঙ্কাল, সিলের কঙ্কাল, সামুদ্রিক কচ্ছপের খোলসের নিদর্শন বেশ উল্লেখযোগ্যভাবে এখনও বিদ্যমান স্কেলিটন উপকূলে। তবে এই ভীতি জাগানিয়া বিষয়টি শুধুমাত্র জলচর তিমি-সিলদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয় একটু দৃষ্টি প্রসারিত করে তাকালে দেখবেন তটরেখোর দূরেই ডুবো পাহাড়ে আটকে থাকা জাহাজের ধ্বংসাবশেষ। তিমির কঙ্কালের পাশেই ডুবে যাওয়া জাহাজের ছোটবড় টুকরা বা ভগ্নাংশ জানান দেয়, চরম রুদ্র সামুদ্রিক পরিবেশে ওইসব জাহাজডুবির ভয়াবহ ঘটনাগুলোর পর বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা বেশিদিন টিকতে পারেননি। কারণ এখানকার প্রকৃতি খুব সহজেই জানান দিয়ে দেয়, স্বাভাবিকভাবে মানুষের টিকে থাকা এখানে অসম্ভব। পালতোলা জাহাজের আমলে রুদ্র সাগর টপকে এখানকার উপকূলে আসা গেলেও পাড়ে ভেড়া ছিল প্রায় অসম্ভব। আর সাগরপথ ছাড়া এখানকার ভূমিতে পৌঁছাতে হলে পাড়ি দিতে হয় শত মাইলের জলাভূমি। ওইসময়টায় না ছিল গাড়ি, না ছিল বিমান-হেলিকপ্টার। তাই কঙ্কাল উপকূলে একবার আটকা পড়লে নির্ঘাত মৃত্যু ছাড়া পথ ছিল না। আর তাই দুঃসাহসী-বেপরোয়া স্বভাবের পর্তুগিজ নাবিক-জলদস্যুরাও সমীহ করে এ জায়গার নাম দিয়েছিল ‘দোজখের দ্বার’ বা ‘নরকের দরজা’ হিসেবে। স্থানীয় বুশম্যানরাও একইভাবে মনে করতো যে অমন সৃষ্টিছাড়া রুদ্র পরিবেশের স্থান খোদা একমাত্র রেগে থাকা অবস্থায়ই সৃষ্টি করতে পারেন। প্রশ্ন দাঁড়ায়, তারপরেও মানুষ কেন এই বিদঘুটে-কর্কশ স্থান দেখতে যাবে? এর সহজ জবাব একটাই পরিবেশ-পরিস্থিতির এতসব ভীতি জাগানিয়া বৈশিষ্ট্যের কারণে এই এলাকাটা থেকে গেছে অনেকটাই অনাঘ্রাত সুন্দরীর মত। সোজা কথা ঝুট-ঝামেলা আর বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশের কথা জেনে খুব কম পর্যটকই এখানে পা রাখেন বছর জুড়ে। আর এটাই এই এলাকাটিকে পর্যটকে ভরাক্রান্ত পরিবেশের শিকার হওয়া থেকে রক্ষা করেছে। মোটামুটি দুনিয়ার অন্যসব সৈকত এলাকা থেকে এখানকার পরিবেশ বেশিমাত্রায় প্রাকৃতিক রুক্ষ আর রুদ্র হলেও বৈচিত্রময়। তাই, নিখাদ প্রকৃতির সান্নিধ্যপ্রেমিদের কাছে এখানকার আকর্ষনটাও বেশিই হবার কথা। নিরানন্দ আর জনশূন্য হওয়া সত্ত্বেও সুন্দর এ এলাকাটির অবস্থান উত্তর-পশ্চিম নামিবিয়ার সোয়াকপমুন্ড শহর থেকে অ্যাঙ্গোলা সীমান্ত পর্যন্ত সমুদ্রোপকূল জুড়ে ৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত। ২০ লাখ হেক্টর বিস্তৃত বালিয়াড়ি আর নূড়ি-কঙ্করময় মরুপ্রবন সমতল জুড়ে স্কেলিটন কোস্ট এক অদ্ভূত এলাকাই বটে।

বিশাল বিশাল সব বালির পাহাড় হঠাৎ বিনা নোটিশেই প্রবল বাতাসের দমকায় হারিয়ে যায়, ফের ভোজবাজির মত উদয় হয় কয়েক মাইল দূরের অন্য কোনও সমতলে। বেশ কয়েকটি নদী বিধৌত এই এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে একটি ন্যাশনাল পার্ক। স্কেলিটন কোস্টের দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে বয়ে গেছে উগাব ও হোয়ানিব নদী আর উত্তরে হোয়ানিব ও কুনিনি। তবে দুর্গম বলেই যে যার ইচ্ছা সেখান থেকে ঘুরে আসতে পারেন ব্যাপারটা এমন নয়। বিশেষ করে এলাকাটির উত্তরাংশে পর্যটনের অনুমতি মেলে কদাচিৎ। আর তাই সারাবছর সেখানে ঘুরতে যাওয়ার ভাগ্যবানের সংখ্যা সাকুল্যে ৮শ জনের মত। এলাকার নির্জন, বন্য, মরুময় আর একইসঙ্গে ভঙ্গুর প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের স্বার্থেই এই কড়াকড়ি।

সাধারণত দক্ষিণাংশে দিনব্যাপী পর্যটনের জন্য ব্যক্তিপর্যায়ে আবেদন করতে হয় নাবিবিয়া সরকারের কাছে। কিন্তু যারা কঙ্কাল উপকূল দেখতে চান, তাদের প্রায় সবাই এর অনাঘ্রাত উত্তর অংশটিতেই যেতে চান। আছে মানুষের কঙ্কালও কঙ্কাল উপকূলের উত্তরাংশে বেড়ানোর নিরাপদ আর সহজ সুযোগ নিতে হলে আপনাকে ধরতে হবে আকাশপথের সাফারি ট্রিপ যদিও বেশ ব্যয়বহুল। সাধারণত ৪ দিনের জন্য পরিকল্পিত এ ধরনের সাফারিতে জনপ্রতি গুণতে হয় ৬ হাজার ডলার। ছোট বিমানে করে পর্যটকদের নিয়ে নামানো হয় তটরেখা থেকে ২০০ কিলোমিটার ভেতরের এয়ারস্ট্রিপে। এরপর সেখান থেকে ল্যান্ডরোভার গাড়িতে করে শুরু হয় উদ্দাম আর বন্য এক যাত্রা। এই যাত্রাপথে দেখবেন শেয়াল, গিরগিটি, পোকামাকড়, পাখি, কখনো বা মরুবাসী হাতি। এরপর সহসাই আপনি হাজির হবেন এক বিশাল গোরস্থানে বলা যায় তচনচ করা এক গোরস্থানের রূপ এটি। হাজারে হাজারে সিলের খুলি, সামুদ্রিক কচ্ছপের খোলস আর বিশালাকার তিমির অস্থিসন্ধি-কঙ্কাল জড়াজরি করে পড়ে আছে। মনে হবে আপনি দুনিয়াসেরা কোনও গাড়ির কারখানার স্ক্র্যাপইয়ার্ডে চলে এসছেন। আপনি যখন একটি স্তূপ দেখছেন তখন প্রবল জঙ্গি বাতাসের বেগ আপনাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ঘুড়িয়ে ঠেলে আরেকটি স্তূপের দিকে টেনে নিয়ে যাবে। বিষয়টি একার্থে ভৌতিক এক আবহ এনে দেয় দিন-দুপুরেই। মনে হবে বাতাসের জলদস্যুসুলভ ক্রুদ্ধ গর্জনের আড়ালে বাঁচার তীব্র ইচ্ছা নিয়ে ফিস ফিস করে যেন কথা বলে উঠছে শত শত মরনোন্মুখ তিমি, সিল, কচ্ছপ। ঠিক এ সময়ে আপনার মনে উদয় হতে পারে সেই ভীতিকর প্রশ্নটি এখানে কী মানুষের কঙ্কালও আছে? আপনার সন্দেহপ্রবণ মন নিশ্চয়ই বলছে থাকতেও তো পারে, অসম্ভব নয়। এবং সত্য কথা হচ্ছে, পর্যটক মনের এই ধারণাটি সত্য। কারণ, আগেই বলেছি শুধুই সিল-তিমিদের মরণক্ষেত্র নয় এটি, এখানে হাজার হাজার জাহাজেরও শেষ ঠিকানা হয়েছে। সেইসব জাহাজের দুর্ভাগা যাত্রীদের বলা যায়, কেউই জ্যান্ত ফেরেননি। সুতরাং, তাদের কঙ্কালগুলোও এখানে মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে।

ডুবে যাওয়া নৌযানের স্মৃতিঃ  অনেক নামিদামি জাহাজের শেষ শয্যা হয়েছে এই স্কেলিটন কোস্টে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বৃটিশ লাইনার ডুনেডিন স্টার। ১৯৪০ সালে এক ডুবো প্রবাল প্রাচীরে আঘাত খেয়ে তার শেষ ঠিকানা হয় এখানে। অবশ্য কারও কারও মতে, প্রবালপ্রাচীর নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) ওই জাহাজটি ধ্বংস হয়েছিল একটি ইউবোটের (ছোট আকারের জার্মান রণতরী বা ডুবোজাহাজ) সঙ্গে সংঘর্ষে। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করার মত, তা হচ্ছে ডুনেডিন স্টারকে উদ্ধারে যাওয়া স্যার চার্লস এলিয়ট নামের টাগবোটটিও একই পরিণতির শিকার হয়। অর্থাৎ নরকের দ্বার হিসেবে কুখ্যাত স্কেলিটন কোস্টে এসে ডুবে যায় চার্লস এলিয়ট। এখানে দেখা যাবে তিমির হাড় দিয়ে তৈরি একটি খিলান দিয়ে চিহ্নিত করা ওই টাগবোটের দুই নাবিকের সমাধি। তাদের নেতৃত্বেই টাগবোটটি ছুটে গিয়েছিল ডুনেডিনকে উদ্ধারে। তীরে আছড়ে পড়া অবিরাম অশান্ত উর্মিমালার মাথা ছাড়িয়ে জেগে থাকা ওই টাগবোটের ধ্বংসাবশেষ এখনও দেখা যায়। এছাড়াও ডুবে যাওয়া জাহাজের তালিকায় আছে এডুয়ার্ড বোলেন, ওটাভি, টোং ট প্রভৃতি।

লেখকঃ আহসান হোসেন