
আধুনিক ব্যাংক লিজেন্ড কুমিল্লার নরেন্দ্র চন্দ্র দত্ত
বাংলাদেশে ব্যাংকিং এর ইতিহাসে নরেন্দ্র চন্দ্র দত্তের নাম অনেকেই হয়ত জানিনা। নরেন্দ্র চন্দ্রের জন্ম ২৫ নভেম্বর ১৮৭৮ সালে।
উপমহাদেশের আমাদের অংশে (অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশে) ১৯ শতকের প্রথম দিকেই কুমিল্লাতে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা প্রক্রিয়া চলে। ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পথিকৃত হচ্ছেন নরেন্দ্রচন্দ্র দত্ত। তাকে এখনো ভারতের ব্যাংকিং ক্ষেত্রে পথিকৃত বলা হয়। বলা হয় আধুনিক ব্যাংকে একজন লিজেন্ড। ‘সেন্টার ফর ষ্ট্যাডিজ অন স্যোসাল সাইন্স, কলকাতা’ নামের থিঙ্ক ট্যাংক খ্যাত প্রতিষ্ঠানের বিশিষ্ট গবেষক, ইন্দ্রজিৎ মল্লিকের একটি বিশাল লেখা রয়েছে নরেন্দ্রচন্দ্র দত্ত সম্পর্কে। ‘ডেভলাপমেন্ট ব্যাংকার ফরম ব্যঙ্গল’ নামের ঐ লেখায় মি. দত্ত এবং সে সময়কার ব্যাংক ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। ঐ লেখায় দেখা যায়, মি. দত্ত পেশায় ছিলেন একজন আইনজীবী। কুমিল্লার কালাকচুয়া (গ্রামটি সম্পর্কে লেখা আছে এ ভিলেজ অব ত্রিপুরা ষ্টেট) গ্রামে তার জন্ম হলেও তিনি থাকতেন কুমিল্লা শহরে। তাঁর শিশুকাল ছিলো অত্যন্ত কষ্টের। মাত্র নয় মাস বয়সে তিনি তার পিতাকে হারান। কষ্টকর তাঁর সেই শিশুকালেই তিনি লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগী হন। কলেজ পেরিয়েই তিনি কলকাতা থেকে ল’পাশ করেন। এরপর কুমিল্লা ফিরে আসেন। কুমিল্লা সিভিল কোটে আইন পেশায় যুক্ত হন।
সময়টি ছিলো ১৯১৪ সাল। সে সময় তিনি ছোট আকারে ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করেন। সাইকেল চড়ে বিভিন্ন জনের বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকাপয়সা লেনদেন করতেন, হিসাবপত্র রাখতেন। পরবর্তীতে আদালতের জজ সাহেব, তাকে অনুমতি দেন আদালত অঙ্গনে তার ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে যেতে। সে অনুযায়ী আদালত ভবনের পাশে একটি ষ্টিলের শেড তৈরি করে তিনি সেখানে ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু করেন।
তা যাই হোক অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ‘কুমিল্লা ইষ্টার্ন ব্যাংকিং কর্পোরেশন’ নামে ব্যাংক চালু করেন মাত্র চারহাজার টাকা দিয়ে। এ টাকা যোগাড় করার জন্য তিনি তাত বসত বাড়ি ১৫০০ টাকায় বিক্রি করে দেন। সেই ব্যাংকটিই বর্তমানে কুমিল্লা কান্দিরপারে পূবালী ব্যাংক হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে।
১৯১৪ সালে মি. দত্ত তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্যাংক থেকে মাত্র ৮ টাকা ভাতা নিতেন। এরপর তার ছেলে বাতা দত্তও লেখাপড়া শেষ করে কুমিল্লা ফিরে এসে বাবার মতোই ব্যাংক ব্যবসা শুরু করেন । তার প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকটির নাম ‘নিউ স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক অব ইন্ডিয়া। ১৯১৫ সালে এ দুটি ব্যাংক একিভূত হয়।
পরবর্তীতে ‘ইউনিয়ন ব্যাংক’ নামে আরো একটি ব্যাংক কুমিল্লায় প্রতিষ্ঠা পায়। ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠা করেন ইন্দ্র ভূষণ দত্ত। ১৯১৯ সালে মহাত্মা গান্ধী এ ব্যাংকটি উদ্বোধন করেন। কিন্তু ব্যাংকটি বেশিদিন চলেনি। পরে এ ব্যাংকটিও কিনে নেন মি.দত্ত। এ ভাবে ব্যাংক ব্যবসায় মি.দত্ত ও তাঁর ছেলের অনেক প্রসার ঘটে। তারা ব্যবসার প্রয়োজনে চা-বাগানে বিনিয়োগ শুরু করেন এবং প্রয়োজনের তাগিদেই কলকাতা, মহারাষ্ট্র, গুজরাট বিভিন্ন স্থানে সম্প্রসারণ করেন তাদের কার্যক্রম। তারা আরো দুটি ব্যাংক একত্রিত করে ইউনিয়ন ব্যাংক অব ইন্ডিয়া স্থাপন করেন। যার কার্যক্রম এখনো অব্যাহত রয়েছে। শুধু তাই নয় ভারতের টাটা, বিড়লা, টিভিএস বিশেষ করে ওবেরয় চেইন হোটেলেও তাদের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। নরেন্দ্রচন্দ্র দত্ত, মর্টগেজ পদ্ধতি থেকে শুরু করে ব্যাংক ব্যবস্থার যেসব আধুনিক আইনকানুন তৈরি করে গেছেন, সেগুলো আজো ব্যাংক কার্যক্রমে সাফল্যের সাথে ব্যবহৃত হচ্ছে। এজন্যই মি. দত্তকে ব্যাংকের পথিকৃত এবং লিজেন্ড হিসাবে সারা ভারতে সম্মান দেয়া হয়। ১৯৬২ সালের ১৫ এপ্রিল, কলকাতায় এ ব্যাংক লিজেন্ড পরলোক গমন করেন।
সূত্রঃ কুমিল্লার কাগজ, উইকিপিডিয়া এবং ইন্দ্রজিৎ মল্লিকের লেখা ‘ডেভলাপমেন্ট ব্যাংকার ফরম বেঙ্গল
লেখকঃ বোরহান মাহমুদ