
জামাল আব্দুল নাসের : মিশর বিপ্লবের নায়ক ও আধুনিক মিশরের রূপকার
ইতিহাসের গতিধারায় যে সব রাজনৈতিক পরিবর্তন হয় তার বাহিরে একটি নিয়ামক বড় পরিবর্তন ঘটাতে পারে সেটি হলো সামরিক বিপ্লব বা সামরিক অভ্যুত্থান। যদিও গণতন্ত্রের চোখে সামরিক বিপ্লব সবসময়ই নেতিবাচক বিষয়, তবুও ইতিহাসে এর গুরুত্ব তাৎপর্যবহ। এসব বিপ্লব কখনো কখনো জনগণের স্বতস্ফুর্ত সমর্থনে হয়েছে আবার কখনো কতিপয় বিপথগামী সেনা সদস্যের কালো নকশা বাস্তবায়নে হয়েছে। কখনো কখনো এই বিপ্লবের মাধ্যেমে যে নেতা রাজক্ষমতায় এসেছেন তিনি জনগণের ভালোবাসা সাথে তার রাষ্ট্রকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। এমনি একজন হলেন মিশরের জামাল আব্দুল নাসের। যিনি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমেই মিশরের ক্ষমতায় আসেন কিন্তু তিনি সকল বাধাকে উপেক্ষা করে। মিশরকে নিয়ে যান এক অনন্য উচ্চতায় এবং অর্জন করেন মিশরসহ সমগ্র পৃথিবীর অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা। তার এই বর্ণাঢ্য জীবন ও ১৯৫২ সালের মিশরীয় বিপ্লব নিয়েই আজকের প্রবন্ধ।
১৯৫২ সালের মিশর বিপ্লবের নায়ক জামাল আব্দুল নাসের ১৯১৮ সালের ১৫ই জানুয়ারি দক্ষিন মিশরের আসিয়াত প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিল একজন ডাক বিভাগের কর্মচারী। তবে তার পরিবার কৃষি ভিত্তিক পরিবারই ছিল। তার বয়স যখন মাত্র আট বছর তখন তার মা মারা যায়। এরপর শিক্ষা লাভের জন্য তিনি কায়রোয়ে তার চাচার নিকট গমন করেন এবং সেখানে একটি স্কুলে ভর্তি হন। এখানে পড়াকালীন সময়ে তিনি ফ্যাসিবাদী আন্দোলন "গ্রিন শার্টের" এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। সে সময় থেকেই তার ভিতরে দেশপ্রেম ও সমাজের প্রতি তার কর্তব্য সম্পর্কে সচেতনতা জাগ্রত হয়। এখানে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে ১৯৩৭ সালে তিনি মিশরীয় সামরিক কলেজে ভর্তি হন। এর পরের বছর তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে অফিসার হিসেবে মিশরের সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেন। এখানেই তার সামরিক জীবনের সূচনা হয়। বলে রাখা ভালো তখন মিশরের সরকারের উপর ব্রিটিশদের প্রভাব ছিল অত্যধিক। তাই তার মনে তাদের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার দ্বীপ্ত চেতনা জাগ্রত হয়। তিনি এই চেতনা তার সহকর্মী ও বন্ধুদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার প্রয়াস গ্রহণে উদ্যোগী হন।
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি তাতে অংশগ্রহণ করেন। এসময় কয়েকটি ঘটনা সামরিক বাহিনী ও মিশরীয়দের বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এগুলো হলো মিশরের রাজা ফারুকের বিলাসী জীবন যাপন, জনগনের কল্যাণের জন্য কিছু না করা এবং অন্ধভাবে সাম্রাজ্যবাদীদের অনুসরণ করা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে না হতেই আরব-ইজরাঈল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এসময় ফিলিস্তিনের পক্ষ নিয়ে মিশর তথা আরব বিশ্ব ইজরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। কিন্তু এসময়ে ফারুক ও তার সরকার ইজরায়েলের কাছে অস্ত্র বিক্রি করলে তাতে জনগণের মনে তীব্র ক্ষোভ জেগে উঠে। অপরদিকে মিশরীয় সেনাবাহিনী কে ইজরায়েলের বিরুদ্ধে প্রেরন করে ফলে সেনাবাহিনীর মধ্যেও চাপা উত্তেজনা দেখা দেয়। সর্বশেষ আরব বাহিনী ইজরায়েলর নিকট পরাজিত হলে মিশরের জনসাধারণ তাদের পতন কামনা করতে থাকে একই সাথে সামরিক বাহিনী ফারুক সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক বিপ্লবের পরিকল্পনা করে। জামাল আব্দুল নাসের এসব পরিকল্পনাকারীদের মধ্য অন্যতম ছিলেন। তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য জামাল আব্দুল নাসের সহ মোট ১১ জন সেনা অফিসার নিয়ে একটি গোপন বাহিনী গঠন করেন যার নাম ছিল 'ফ্রি অফিসারস'। এই বাহিনী গঠিত হওয়ার পর থেকে তারা তাদের সমমনা অফিসার ও সৈনিকদের এখানে যুক্ত করতে থাকে। বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত তাদের সদস্য দাঁড়িয়েছিল মাত্র ৩০০ জন। এর মধ্যে ১৯৫১ সালে সেনা কর্মচারী ক্লাবের নির্বাচনে ফ্রি অফিসারসদের একজন জেনারেল নাজিব জয় লাভ করে ফলে তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
ফলে তারা রাজা ফারুক ও তার সরকারকে উৎখাত করার জন্য জোরালো পরিকল্পনা করতে থাকে। কিন্তু তাদের এই পরিকল্পনার কথা মিশরীয় গোয়েন্দা বাহিনী জেনে যায় এবং রাজা ফারুক কে অবহিত করে। ফলে রাজা এসব অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য নির্দেশ দেন। রাজা ফারুকের এই নির্দেশ গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পেরে জামাল আব্দুল নাসের তড়িৎ গতিতে ১৯৫২ সালের ২১ জুলাই ফ্রি অফিসারসদের একটি মিটিং আহ্বান করেন। এই গোপনীয় মিটিং এ সিদ্ধান্ত হয় যে ২৩ জুলাই তারা বিপ্লব পরিচালনা করবেন। একই সাথে বিপ্লবের রূপরেখার নকশাও প্রনয়ন করা হয়। যেই কথা সেই কাজ ১৯৫২ সালের ২৩ জুলাই মধ্য রাতে ত্রয়োদশ ব্যাটেলিয়নের একটি সাজোয়া বাহিনী সামরিক বাহিনীর প্রধান কার্যালয় অবরোধ করে। ফলে বিদ্রোহী বাহিনী ও প্রধান কার্যালয়ে দায়িত্বরতদের মধ্যে গুলি বিনিময় শুরু হয়। গুলি বিনিময়ের পর মুল বাহিনীর দুই জন নিহত হলে তারা ভয় পেয়ে যায়, ফলে বিদ্রোহী বাহিনী প্রধান কার্যালয়ের দায়িত্ব নিয়ে নেয় এবং সামরিক বাহিনীর প্রধানসহ বেশ কয়েকজন সামরিক উর্ধতন অফিসারদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন। ফলে এখানেই বিদ্রোহীদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। তারা মুহূর্তের মধ্যে বিমান বন্দর, টেলিযোগাযোগ, বেতার ভবন সহ গুরুত্বপূর্ণ সব কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। একই সাথে সাজোয়া যান কায়রোর রাস্তায় নেমে আসে। ফলে ভোর হওয়ার পূর্বেই সম্পুর্ন কায়রোর নিয়ন্ত্রন বিদ্রোহীদের হাতে চলে যায়। সকাল ৭টায় কায়রোর বেতার কেন্দ্র থেকে বিপ্লবী নেতা আনোয়ার সাদাত সফল বিপ্লবের ঘোষনা দেন একই সাথে জেনারেল নাজিব কে প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এই বিপ্লবের পর মিশরের রাজনৈতিক দৃশ্যপট দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। রাজা ফারুককে জোর পূর্বক ফ্রান্সে পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং জেনারেল নাজিব রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত নাজিব এই ক্ষমতায় থাকেন। এদিকে জামাল আব্দুল নাসের প্রথমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন পরবর্তীতে প্রধান মন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। এই সময়ে তার জনপ্রিয়তা ব্যাপক পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। ফলে ১৯৫৬ সালে তিনি রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় চলে আসেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি মিশরের ভাগ্য পরিবর্তন করার বেশ কয়েকটি সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সেগুলো হলো -সুয়েজ খাল জাতীয় করন,ভূমি সংস্কার, কৃষি ও শিল্পের উন্নয়ন ও বৈদেশিক বানিজ্য শক্তিশালী করণ এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন। এর বাহিরে তিনি যে কাজের জন্য সবথেকে বিখ্যাত হয়ে আছেন সেটি হলো আরব জাতিয়তাবাদ। তিনি আরব জাতিয়তাবাদী তত্ত্বের জন্য ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তার এই জনপ্রিয়তা এমন হয়ে গিয়েছিল যে তিনি কোন স্থানে আগমনের সংবাদ পেলেই সেখানে লোকে লোকারণ্য হয়ে যেত। তাদের এই উপস্থিতি ছিল সম্পুর্ন ই স্বতস্ফুর্ত। এই মহান জনপ্রিয় নেতা ২৮ই সেপ্টেম্বর ১৯৭০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায়ই ছিলেন এবং সমানভাবে জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তথ্যসূত্র
১.https://www.britannica.com/place/Egypt/The-revolution-and-the-Republic
২.https://www.google.com/amp/s/www.middleeastmonitor.com/20170723-remembering-the-1952-egyptian-revolution/amp/
৩.http://egyptian-revolution1.blogspot.com/2013/11/1952-egyptian-revolution.html?m=1
৪.http://nobinkontho.blogspot.com/2017/02/blog-post_52.html?m=1
লেখকঃ ফরিদ মোল্লা