
শায়েস্তা খানঃ বাংলার সফল সুবাদারের গল্প
সুবে বাংলার সফলতম সুবাদার তিনি। কিংবদন্তির আটমণ চাল ১ টাকার কারিগর, ঢাকার সমৃদ্ধির নায়ক শায়েস্তা খান। ১৬৬৪ সালে সুবাদারের দায়িত্ব নিয়ে যখন তিনি ঢাকায় আসেন তখন সুবে বাংলার এই শহর তার কাছে ছিল সম্পূর্ণ অচেনা, অজানা এক নগর। দুই দফায় এই বাংলায় নিজের শাসনকার্য চালিয়ে যখন অব্যাহতি নিয়ে দিল্লি ফিরে যাচ্ছিলেন যাওয়ার পথে শায়েস্তা খান কেঁদেছিলেন, কাঁদিয়েছিলেন। ঢাকার নাগরিকরা নিজ চোখে দেখছিলেন তাদের প্রিয় প্রজাদরদী সুবেদার ঢাকা ত্যাগ করছেন। শায়েস্তা খান তার নির্মিত ফটক দিয়ে যখন ঢাকা ত্যাগ করেন তখন বলেছিলেন,ভবিষ্যতে আর কেউ যদি টাকায় আট মণ চাল খাওয়াতে পারে তবেই যেন এই গেট খুলে দেয়া হয়। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রভাবশালী এই প্রশাসক তার পুরো শ্রম ঢেলে দিয়েছিলেন নদী বিধৌত এই বদ্বীপে। সুবে বাংলার মহান সুবেদারের কর্মবহুল জীবন আজকের নৈবেদ্য।
শায়েস্তা খানের পিতা ছিলেন সম্রাট শাহজাহানের প্রধানমন্ত্রী ইরানী বংশোদ্ভূত আসফ খানের পুত্র। আসফ খান ছিলেন আবার সম্রাট জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নূরজাহানের ভাই। আসফ খানের মেয়ে মমতাজমহল ছিলেন সম্রাট শাহজাহানের স্ত্রী। সেই হিসেবে সরাসরিই শায়েস্তা খানের সাথে মুঘল রাজপরিবারের বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল। আর সেজন্য শায়েস্তা খান পেয়েছেন ভুরি ভুরি পদবী আর সম্মান। মুঘল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশের প্রশাসকের দায়িত্ব নেয়ার পাশাপাশি ভূমিকা পালন করেছেন সেনাপতি হিসেবে। উত্তরাধিকার দ্বন্দ্বে আওরঙ্গজেবের পক্ষ নিয়ে পেয়েছেন তারও নৈকট্য। তবে মুঘল সাম্রাজ্যে দ্যুতি ছড়ানো শায়েস্তা খান নিছক পারিবারিক যোগসূত্রে প্রভাবশালী হয়ে উঠেননি। নিজের কর্মদক্ষতায় তিনি এতোদূর আসতে পেরেছিলেন। মির্জা আবু তালিব বেগ নামের এই মানুষটিকে সম্রাট জাহাঙ্গীর তার রাজত্বের একুশতম বছরে শায়েস্তা খান উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৬৬৩ সালে মীর জুমলার মৃত্যু হলে শায়েস্তা খানকে পাঠানো হয় বাংলা প্রদেশে৷ বাংলায় তখন চলছিল মগ আর পর্তুগিজ জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য।
বাংলার প্রাণভোমরা শায়েস্তা খাঁ
১৬৬৪ সাল থেকে ১৬৭৮ সাল পর্যন্ত প্রথম দফায় শায়েস্তা খান বাংলার সুবাদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মাঝে এক বছর বিরতি দিয়ে ১৬৮০ থেকে ১৬৮৮ পর্যন্ত দ্বিতীয়বারের মত তিনি এ অঞ্চলে তার দায়িত্ব সম্পন্ন করেন। তার আমলে বাংলা সময়ের সেরা সময় অতিক্রম করে। প্রজাদের স্বস্তিতে রাখার জন্য শায়েস্তা খানের প্রশংসা করেছেন ঐতিহাসিকরা। সাথে একের পর এক স্থাপত্য নির্মাণ করে ঢাকাকে করে তুলেছিলেন অনন্য এক শহর। টাকায় আট মণ চাল, সাত গম্বুজ মসজিদ, ছোট কাটরা ছাপিয়ে শায়েস্তা খানের বড় কীর্তি ছিল মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের বিতাড়ন করা। আরাকানদের হাত থেকে চট্টগ্রাম পুনরূদ্ধার করে তিনি এই শহরের নাম দিয়েছিলেন ইসলামাবাদ।
১৬১৭ সালে আরাকান রাজ পর্তুগিজদের কাছ থেকে সন্দ্বীপ কেড়ে নিলে রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত মগদের হুমকির মুখে চলে আসে। মগদের সাথে পাল্লা দিয়ে পর্তুগিজ হার্মাদরাও এদেশের জনগণকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে৷ দিনেদুপুরে মানুষজনকে ধরে নিয়ে ইউরোপীয়দের কাছে বিক্রি করে দিত এরা। এই অবস্থা চলতে লাগল কোন সমাধান ছাড়াই। দেশের মানুষ তখন বাস্তবিকই একজন ত্রাতার অপেক্ষায় ছিল। এমনই অস্থির সময়ে শায়েস্তা খান তার ছয়জন দক্ষ পুত্র নিয়ে আটঘাট বেঁধে জলদস্যুদের মোকাবেলা করার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। আর এরজন্য তিনি নৌশক্তি বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দেন। ৩০০ রণতরী সংগ্রহ হলে শায়েস্তা খান এবার কৌশলী হন। তিনি হাত মেলানোর চেষ্টা করেন ইংরেজদের সাথে। কিন্তু ইংরেজরা সুবাদারকে সাহায্য করতে অস্বীকৃতি জানায়। ক্ষিপ্ত খাঁ এবার ওলন্দাজদের দিকে হাত বাড়ান। ব্যবসায় অতিরিক্ত সুবিধা আদায়ের প্রতিশ্রুতি পেয়ে ওলন্দাজরা শায়েস্তা খানের বাহিনীর সাথে যোগ দেয়। তবে সন্দ্বীপে শায়েস্তা খানের বাহিনী ওলন্দাজদের সহায়তা ছাড়াই পর্তুগিজদের কোণঠাসা করতে সমর্থ হয়। কিন্তু তখনো পর্যন্ত বেশ শক্তিশালী ছিল মগ জলদস্যুরা। শায়েস্তা খান এদের কাঁবু করতে নৌশক্তি ও স্থলবাহিনীর আরো শক্তিশালী করে তুলেন। প্রায় ৪৩ হাজার এক শক্তিশালী বাহিনীর নেতৃত্ব দেন জলে হোসেন বেগ এবং স্থলে তার পুত্র বুযুর্গ উমিদ খান। তেমন কোন শক্তিক্ষয় না করেই মগদের দমন করতে সমর্থ হয় মুঘল বাহিনী৷ ওদিকে একই সময় আরাকানীদের কাছ থেকে চট্টগ্রাম অধিকার করে শায়েস্তা খান তার নাম দেন ইসলামাবাদ। জলদস্যুদের নির্মূল করে তিনি বাংলার অর্থনীতিকে নিয়ে গিয়েছিলেন অনন্য এক উচ্চতায়। আমদানি রপ্তানিতে নতুন করে ভারসাম্য আসে। মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়ে গিয়েছিল। যার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন সেই সময়ে বাংলায় আসা পর্যটকরা।
বাংলার অর্থনীতি আর সামাজিক স্থিরতার এই কারিগর একজন নির্মাতা হিসেবেও তার কাজের সাক্ষর রেখে গেছেন। ঢাকার বড় কাটরা, লালবাগ কেল্লা, মোহাম্মদপুরের সাত গম্বুজ মসজিদ ছাড়াও ঢাকার অনেক স্থাপনাতেই কোন না কোনভাবে শায়েস্তা খানের হাত রয়ে গেছে। ১৬৮০ সালে এই মহান সুবাদার বাংলা ত্যাগ করেন এবং ১৬৯৪ সালে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন।
লেখকঃ উবায়দুর রহমান রাজু