গোয়েরিং- নাৎসী বাহিনীর এক রক্তচোষা নরপিশাচ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হিটলারের বাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ পৃথিবীব্যাপী ইহুদি শুন্য করে দেয়ার প্রচেষ্টা হিসেবেই স্বীকৃত। শুধু হিটলারই নয় নাৎসি বাহিনীর আরো কিছু বিকৃত, জঘন্য, নরপিশাচ ছিলো যাদের অত্যাচার, যাদের কৃতকর্ম হিটলারেরই সমকক্ষ। তারা ছিলো হিটলারের ডানহাত। এমনকি তাদের প্ররোচনাতেই হিটলার অনেক কাজ করেছেন।
ঠিক এমনই একজন হলেন, হেরমান উইহেলোম গোয়েরিং।
হিটলার ঘোষিত হিটলারের উত্তরাধিকারী এবং নাৎসি সরকারের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি হেরমান উইহেলোম গোয়েরিং এর জন্ম ১৮৯৩ সালের ১২ জানুয়ারি উত্তর ব্যাভিরিয়ার রোজেনহেইমের এক সামরিক পরিবারে। কার্লসরুহের ফৌজ স্কুল থেকে বের হবার পর ১ম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে আলসাস লোরেন পদাতিক বাহিনীর ল্যাপটেন্যান্ট পদে কিছুদিন কাজ করার পর বিমান বহরে বদলি হন তিনি।
১৯১৮ সালে কমান্ডার অফ ফাইটার পদে উন্নীত হন।যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর অসামরিক জীবনের সাথে তাল মিলিয়ে চলা গোয়েরিং এর পক্ষে কষ্টকর হয়ে পড়ে। এরপর দুই বছর ফকার এয়ারক্রাফট ওয়ার্কসে কাজ করার পর ড্রেনমার্কে সরকারের বিমান বিভাগের উপদেষ্টা পদে কাজ করেন তিনি। তারপর ষ্টান্ট ফাইলট। এরপর সুইডেনে স্বেনস্কা লুফত্রাফিকে কমার্শিয়াল ফাইলট হিসেবে যোগ দেন। এই সময়ে তার সাথে পরিচিত হয় ফকার পরিবারের মহিলা কারিন ভন ফকারের সাথে। যাকে তার বিবাহ বিচ্ছেদের পর গোয়েরিং বিয়ে করেন। কারিং এর মাধ্যমেই হিটলারের সাথে গোয়েরিং এর পরিচয় হয়।
পরিচয়ের অল্প দিনের মধ্যেই হিটলার তার জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে শুধু নাৎসি বাহিনীতেই নেননি, তাকে এস. এস এর সুপ্রিম কমান্ডার করে নেন। শুঁড়িখানার অভ্যুত্থানে গোয়েরিং আহত হন। তখন গোয়েরিং গ্রেপ্তার হলেই প্রচুর কলকাঠি নেড়ে তিনি চলে যান ইতালীতে এবং পরে সুইডেনে।
প্রবাসে থাকাকালীন প্রথমে সে মাদক নেয়া এবং পরে মাদকের চোরাচালান শুরু করেন। ১৯২৬ সালে জার্মান সরকারের সমস্ত নাৎসি বন্ধীদের মুক্তি দিলে গোয়েরিং ফিরে আসে আবার হিটলারের সাথে যোগ দেন।
১৯২৮ সালের নির্বাচনে গোয়েরিং ছিলো নাৎসি বাহিনীর কয়েকজনের একজন যাদের সংসদে চাকরী হয়েছিলো। ১৯৩২ সালে নাৎসিদের জয়ের পরে হয়েছিলো সংসদের প্রেসিডেন্ট। এবার গোয়েরিং এর নাৎসি দল ও সরকারের উত্থান হতে লাগলো উল্কার মতো। হলো দপ্তরহীন মন্ত্রী, রাইখ কমিশনার ফর এয়ার, প্রাশিয়ান মিনিষ্টার প্রেসিডেন্ট, প্রাশিয়ান অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী। অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী থাকাকালীন প্রাশিয়ার রাজনৈতিক পুলিশ বাহিনীর পত্তন করলো যা ১৯৩৪ সালে মিশে গেলো গেস্টাপোর সঙ্গে।
গোয়েরিং এর প্রথম কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পের প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো ওরানিয়েনবুর্গে। রাইখস্ট্যাগে আগুন লাগাবার পরিকল্পনা তারই হাতের কাজ বলে বহু লোক বিশ্বাস করে থাকেন। ১৯৩৪ সালের ৩০শে জুন, রোহেম "রক্তাক্ত বিমোচন" কে বিদ্যুৎ গতিতে সফল করা ছিলো গোয়েরিং এর হাতের কাজ।
১৯৩৫ সালে হিটলার তার স্বপ্নের কাজ আকাশ দখলের দায়িত্ব দিয়ে তাকে করলো কমান্ডার উন চিপ অব এয়ারফোর্স। এর দায়িত্ব হাতে পেয়েই গোয়েরিং আকাশ যুদ্ধের জন্যে তৈরী হয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি করল আর নিজেই ফুলেফেঁপে উঠলো। ফ্ল্যাট ছেড়ে বসবাস করতে শুরু করলো এক রাজকীয় প্রাসাদে। আর বউ কারিনের নামে তার প্রাসাদের নাম রাখে "কারিন হল"।
অন্যসব নাৎসি নেতাদের মতো গোয়েরিং এর মন মানসিকতাও ছিলো অত্যন্ত বিকৃত। হিটলারের পছন্দমত যাবতীয় বিকৃত মন মানসিকতার লোক সরবরাহ করতেন তিনি। তার সরবরাহ করার লোকজনের মধ্যে ছিল যৌন ছবির ফটোগ্রাফার জুলিয়ান স্ট্রেশার, ধর্ষকাম হাইনরিখ হিমলার, মদের স্যালস ম্যান জোয়াকিম ভন রিভেনট্রপ ইত্যাদি। হিটলারের নেক নজরে পড়া এই লোকগুলো পরবর্তীতে অনেক উঁচু পর্যায়ে উঠে গিয়েছিলো। তার বক্তব্যই ছিলো " আমি আমার নিজের প্রয়োজনে হিটলারের সাথে যোগ দিয়েছি। নিকুচি করেছি আদর্শের"। এই জন্যেই কোনো প্রশ্ন না করেই হিটলারের সমস্ত কাজ বা হুকুম তামিল করে যেতো। সে আরো বলতো, " মানুষ বোকা। তাদের যা গেলানো হবে তারা তাই গিলবে।"
১৯৩৬ সালে রাইখসব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্ট জালমার স্যাখটের সতর্কবাণী উপেক্ষা করে হিটলার গোয়েরিংকে জার্মান অর্থনীতির পরিচালক করে নেন। ১৯৩৭ সাল থেকে গোয়েরিং একের পর এক কোম্পানি নিজের অধীনে নিয়ে নেন। একই সঙ্গে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় পরাজিত দেশগুলো থেকে তার হুকুমে তার লোকের যাবতীয় শিল্প, সম্পদ লুট করে এনে রাখতো তার কাছে। যার পরিমাণ এতোই বেশি ছিলো যে সেই সব জিনিস পাঠাতে ট্রেন ব্যবহার করা হতো।
এর মধ্যেই ১৯৩৫ সালে গোয়েরিং বিয়ে করে অভিনেত্রী সনেমানকে। ওই সময় পর্যন্ত যদিও হিটলার অবিবাহিত ছিলো কিন্তু বিভিন্ন ধরণের নারীর সাথে তার ঘনিষ্ঠতা নাৎসি দলের উপরস্থারে অবিদিত ছিলোনা। তারই সুযোগ নিয়ে গোয়েরিং তার নববিবাহিত স্ত্রীকে হিটলারের সাথে বিভিন্ন জায়গায় পাঠাতে লাগলো। অবস্থা এমন হয়ে উঠলো যে গোয়েরিং এর স্ত্রীই ঠিক করে দিতো হিটলার কোন অনুষ্ঠানে যাবে আর কোন অনুষ্ঠানে যাবেনা।
১৯৩৬ সালে হিটলার গোয়েরিংকে পূর্ণ জেনারেল পদে নিয়োগ করলো। গোয়েরিং তখন ২য় মহা যুদ্ধের গন্ধ পাচ্ছিলো। ১৯৩৯ সালের ৩০শে আগষ্ট সে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলেনের ঘনিষ্ঠ সুইডিশ মধ্যস্ততাকারী বার্গার ডাহলেরুশের মাধ্যমে গোপনে প্রস্তাব পাঠালো বৃটেনের সঙ্গে গোপন সমঝোতার।কিন্তু তখন বড়ই দেরি হয়ে গেছিলো। সেই প্রস্তাব লক্ষ্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছিলো।
১৯ জুন হিটলার গোয়েরিংকে সেনাবাহিনীর অধিনায়ক করে। ইতিমধ্যে জার্মান অর্থনীতির পরিচালক গোয়েরিং- এর দখল পরাজিত দেশ গুলোর উপরেও পড়ছিলো। যুদ্ধ যতোই এগুতে থাকলো গোয়েরিং এর ভাগ্য রেখা ততোই নিচের দিকে নামতে থাকলো। হিটলারের ইচ্ছে ছিলো আকাশ জয় করা। তার জন্যে গোয়েরিংকে সর্বাধিকার দেওয়া ছিলো বিমান, অস্ত্র বা পাইলটদের ট্রেনিং দেওয়া পর্যন্ত। কিন্তু তবুও আকাশ রয়ে গেলো মিত্র শক্তিদের দখলে।
নাৎসি বাহিনীর অন্য দুই প্রভাবশালী সদস্য হিমলার আর বোরম্যান এই সুযোগে হিটলারের কানে কুমন্ত্রণা দিতে লাগলো এই বলে যে, গোয়েরিং নিজে জার্মানির ফুয়েরার হওয়ার জন্যে বৃটেনের সাথে গোপনে যোগাযোগ রাখছে। হিটলার এই কথা শুনে এতোটাই ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন যে সাথে সাথেই আদেশ জারি করেন গোয়েরিং এর সকল ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তাকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করার নির্দেশ দেন। হিটলার যেমনই ছিলো যুক্তিহীন তেমনই কান পাতলা। সে কাউকেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতোনা। অবশেষে গোয়েরিং নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে না পেরে তার স্ত্রীকে কাজে লাগালো। শেষমেশ প্রাণে রক্ষা পেলো।
তবে যুদ্ধ শেষ হবার পর ন্যুর্মবার্গ বিচারে তার প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়। তবে তার প্রাণদণ্ড কার্যকর হওয়ার দুই ঘন্টা আগেই রক্ষীদের সহায়তায় পটাশিয়াম সাইনাইডের ক্যাপস্যুল খেয়ে তিনি আত্মহনন করেন। পরে তার লুট করে আনা কোটি কোটি টাকার সম্পদ আমেরিকা ও বৃটেন ভাগাভাগি করে নেয়।
তথ্যসূত্রঃ
১.https://www.britannica.com/biography/Hermann-Goring
২. নাৎসি বিরোধী জার্মান বীরত্ব কথা- সুবর্ণ হাজরা।
লেখকঃ এস এম সজীব