অন্যান্য

নীলদর্পন নাটক এবং পাদ্রী জেমস লঙ এর কারাদন্ড

অন্যান্য রবিবার, ১৭ মে ২০২০ ১১:৫৩:২৭

১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাই যুদ্ধের পরিসমাপ্তির পর ঢাকায় একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই প্রেস ছাপাখানাটির নাম বঙ্গলা যন্ত্রালয়। সেই বঙ্গলা যন্ত্রালয় থেকেই দীনবন্ধু মিত্রের লেখা নীল দর্পণ নাটকটি ছাপা হয়েছিল। নাটকটি প্রকাশ হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই বিখ্যাত নাটকরূপে খ্যাতিলাভ করেছিল। প্রকাশ কাল ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর বা ১৭ আশ্বিন ১২৫৭ বঙ্গাব্দ। নীল দর্পণ নাটকটির মুদ্রক ও প্রকাশক ছিলেন রামচন্দ্র ভৌমিক।   

ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি সদরঘাটের উত্তর দিকে একটি পোস্ট অফিস স্থাপন করেছিল। সেই পোস্ট অফিসের পোস্ট মাষ্টার ছিলেন দীনবন্ধু মিত্র।

দেশীয় নীলচাষী আর শ্রমিকদের ওপর কুঠিয়ালদের অত্যাচার চোখে দেখা ঘটনাকে নীল দর্পণ নাটকে রূপ দিয়েছিলেন দীনবন্ধু মিত্র।

দীনবন্ধু মিত্র এটি ছদ্মনাম। আসল নাম গন্ধর্ব নারায়ণ মিত্র। জন্মস্থান নদীয়া জেলার চৌবাড়িয়া গ্রামে। এনট্রান্স পাস করার পর চাকরি পেয়েছিলেন পোস্ট অফিসে। কোলকাতা থেকে ঢাকায় বদলি করা হয়েছিল। সেখানে এমনিতেই কুঠিয়াল সাহেবরা নীল চাষী আর শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন চালাত। গন্ধর্ব নারায়ণ ঢাকায আসার পর মানুষের মুখে শোনা কাহিনী পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। দেখেছিলেন বুড়িগঙ্গার উত্তর পাড়ে প্রায় ১ মাইলের মত জায়গা জুড়ে বিদেশী বণিকরা ব্যবসা করে, বিখ্যাত নীল কুঠিয়ালরাও বাস করে। সদরঘাটের পশ্চিমে নীল কুঠিয়ালরা বাস করে। সেই কুঠিয়ালদের প্রধান কর্মকর্তার নাম ছিল জেমস পিটার ওয়াইজ। সেই ওয়াইজ সাহেবের নাম অনুসারে ঢাকার ওয়াইজঘাট নামকরণ হয়েছিল।

নীল দর্পণ নাটকটি প্রকাশের পর নাট্যকার নিজেই একটা কপি পাদ্রী জেমসলঙ সাহেবের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সে সময় জেমসলঙ ঢাকাতেই অবস্থান করছিলেন। এখানে উল্লেখযোগ্য জেমসলঙ তার মাতৃভাষা আইরিশ বাদেও বাংলাসহ আটটি ভাষা জানতেন। জেমসলঙ সাহেব নীল দর্পণ নাটকটি পড়ে ভীষণভাবে মর্মাহত হয়ে পড়েন। নীল কুঠিয়ালদের অমানুষিক অত্যাচারের কবল হতে নীরবে নীল চাষী শ্রমিকদের রক্ষা করার জন্য নাটকটি মাইকেল মধূসূদন দত্তকে দিয়ে ইংরেজিতে অনুবাদ করিয়ে ক্যালকাটা প্রিন্টিং এন্ড পাবলিশিং প্রেস থেকে গ্রন্থ প্রকাশ করিয়ে গ্রন্থে বেঙ্গল গভর্নরের সীলমোহরের ছাপ দিয়ে এক কপি লর্ড ক্যানিংকে দেখা হয়। আরও দেয়া হয় নীলকর গ্রুপের মুখপাত্র ল্যান্ড হোলর্ডার্স এ্যান্ড কমার্শিয়াল  এসোসিয়েশন অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার সেক্রেটারি উইলিয়াম ফ্রেডারিক ফার্গুসনকে। এই গ্রন্থ ব্রিটিশ রাজসভাতেও পাঠানো হয়।

নীল দর্পণ নাটকটি পড়ে ইংরেজরা আঁতকে উঠেছিল। কুঠিয়াল সাহেবরা চিৎকার করে বলেছিল-নাটকের কাহিনী-বানোয়াট-সব মিথ্যা। কিন্তু ইংরেজী অনুবাদের নাটকে লেখকের নাম ঠিকানা নেই। প্রকাশকের নামও নেই। কুঠিয়ালদের বুঝতে বাকি থাকল না যে ভয়ের কারণেই বাংলা ও ইংরেজি কারোর মধ্যেই লেখকের নাম ঠিকানা প্রকাশ করা হয়নি। কিন্তু কুঠিয়াল সাহেবরা এ নাটকের মূল হোতাকে ধরার সকল প্রচেস্টা অব্যাহত রাখে।

অনেক চিন্তা ভাবনা করার পর নীলকর সেক্রেটারি ফ্রেডারিক ফার্গুসন ১৮৬১ ১লা জুন তারিখে ডেপুটি গভর্ণরের বরাবর উক্ত গ্রন্থে কেন সীলমোহর মারা হয়েছে চিঠি লেখে পাঠায় ডেপুটি গর্ভনরের নিকট। সেক্রেটারি ই এইচ লাসিংটন ৩-৬-১৮৬১ তারিখে উক্তপত্রের উত্তরে লিখলেন আমরাও গ্রন্থটি পড়েছি মানহানিকর তেমন কিছু এর মধ্যে নেই। নাটকটি ঘটনার বহি:প্রকাশ। আর সীলমোহর মারা হয়েছিল গভর্ণরের অনুপস্থিতি ও বিনা অনুমতিতে। অবশেষে নীলকর সমিতি প্রিন্টার্স হেনরী ম্যানুয়েলের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মানহানীর মামলা দায়ের করে। আর ঠিক এই সময়ই ছদ্মবেশী জেমসলঙ সত্যের আলোয় বেরিয়ে এসে ঘোষণা করলেন ম্যানুয়েল নেহায়েতই মুদ্রাকর। নীল দর্পণ গ্রন্থের অনুবাদ ও প্রকাশকের গুরুদায়িত্ব আমিই নিয়েছিলাম। ম্যানুয়েলের ১০ টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দিয়ে জেমসলঙ এর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা দায়ের করা হয়।

ঠিক এই ঘটনার কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার সূত্র এসে এর সঙ্গে সংযুক্ত হয়। ঘটনাটি নীলকরদের অত্যাচারে নীল চাষীরা নীল চাষ বন্ধ করে দেব বলে সুর  তুললে এর  তদন্তের জন্য ইংরেজ কোম্পানি ইন্ডিগো কমিশন গঠন করে তদন্ত শুরু করলে সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থিত করা হয়। এই তদন্ত কমিশনে জেমসলঙ সাক্ষ্য দিয়েছিলেন ১২ জুন মঙ্গলবার ১৮৬০ সালে। বেঙ্গল হরকরা ও ইংলিশম্যান পত্রিকা দ্বয়ের বিরুদ্ধে জেমসলঙ তার জবানবন্দীতে বলেছিলেন যে, ইংলিশম্যান ও বেঙ্গল হরকরা পত্রিকা দু’টি পক্ষপাত দুষ্ট। শোষিত ও নির্যাতিত কৃষক শ্রমিকদের উল্টো-দোষারোপ করে।

এরূপ সাক্ষী দেয়ার ফলে নীলকর তথা সমগ্র ইংরেজ কোম্পানি অপমান বোধ করে, ফলে পত্রিকা দ্বয়ের পক্ষে ওয়ালটার ব্রেন ও নীল এসোসিয়েশনের পক্ষে নীল সেক্রেটারী ফার্গুসন সুপ্রিম কোর্টে  মামলা দায়ের করেন। বাদীর পক্ষে প্রায় সমগ্র ইংরেজ আর বিবাদীর পক্ষে বাঙালির জোট। মামলার ব্যয়ভার বহন করার জন্য বেশ কয়েকজন বিত্তবান আসামী লঙ এর পাশে এসে দাঁড়ান- এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রাজা প্রতাপ চন্দ্র সিংহ, কালী প্রসন্ন সিংহ, রমাকান্ত ঠাকুর, রাজা রাধাকান্ত দেব প্রমুখ।

১৮৬১ খ্রিস্টের ১৯-২০ জুলাই তারিখে নীল দর্পণ অনুবাদ করে ইংরেজ সমাজে প্রচারের অপরাধে ধর্ম প্রচারক পাদ্রী জেমস লঙকে কোর্টের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ফৌজদারী আসামী হিসাবে বিচার করে বিচারপতি মর্ডান্ট ওয়েলস জুরিদের সাথে একমত হয়ে উপস্থিতদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিয়ে লঙকে একমাস জেল ও এক হাজার টাকা জরিমানা করেন।

বাদী পক্ষ এই দুই দিনে লঙ সাহেবকে কিছু বলতে না দিয়ে এক তরফাভাবে বিচার করে দন্ডাদেশ প্রদান করে। বিচারকের ডিক্রি জারির পর বিবাদী পক্ষের উকিল ও গণ্যমান্য বক্তিবর্গের অনুরোধে সাজাপ্রাপ্ত পাদ্রীকে ২৪ জুলাই তার কিছু বলার থাকলে তা বলার জন্য সুপ্রীম কোর্টের কাঠগড়ায় দাঁড় করান হয়। তখন জেমস লঙ উপস্থিত সকলের প্রতি দৃষ্টিপাত করে আদলতকে বলেন- নীল দর্পণ নাটকটি নির্যাতিত নীলকরদের চালচিত্র। ইংরেজ প্রশাসক হয়ত এ বিষয়ে অবগত নন আর সে কারণেই আমি নীল দপর্ণ নাটকটি হাতে পেয়ে অনুবাদ করে ইংরেজ কর্মকর্তাদের অবহিত করার জন্য প্রচার করেছিলাম। সত্যকে প্রচার করাই আমার ধর্ম। নীল দর্পণের বিষয় বাস্তব বহির্ভূত নয়। বেঙ্গল হরকরা ও ইংলিশ ম্যান, সাপ্তাহিক দু’টি যা প্রকাশ করে তা সত্য নয়। নেটিভ দেশীয়দের পত্রিকাগুলোতে নীলকরদের জুলুমবাজি কি ধরনের হয় বিক্ষিপ্তভাবে ছাপা হয় অথচ প্রশাসক এসব পত্রিকায় কি সব ছাপা হয় ভুলেও খোঁজখবর নেন না। যা পড়েন তা ঐ ইংলিশ ম্যানদের পত্রিকা দু’টি। ইংলিশ ম্যানরা যেটা করছে তা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত পথ। ইংরেজ প্রশাসনের জানা উচিৎ ইংরেজদের প্রকাশিত পত্রিকার প্রচার আর কয়েকজন সৈন্য দিয়ে ইন্ডিয়াকে শাসন ও নিজেদের নিরাপত্তা রক্ষ করা সম্ভব নয়। দেশবাসীর কি অবস্থা প্রশাসক তা জানেন না। আমি জানি। আমি পথে প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে জনতার মধ্যে ঈশ্বরের বাণী প্রচার করি। নীল কুঠিয়ালদের বিষয়ে সম্যকভাবে আমি অবগত। বাস্তব ঘটনার আলোকে নীল দর্পণ লেখা হয়েছে।

নীলকরদের জুলুম প্রশমিত হোক এই ইচ্ছা নিয়েই শাসকদের অবহিত করার জন্যই নীল দর্পণ অনুবাদ করে প্রচার করার জন্যই নীল দর্পণ অনুবাদ করে প্রচার করেছিলাম। একথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে এই দেশ এদেশবাসীরাই। এই বাস্তবকে স্বীকার করে প্রশাসন কাঠামো তৈরি না করলে প্রশাসন স্থায়ী হবে না।
অত:পর জেমস লঙ সৈয়দ আহমদের মতবাদের ওপর আলোকপাত করে বললেন, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায়-আইন পরিষদে যদি একজনও ভারতীয় বুদ্ধিজীবী থাকতেন এবং ভারতীয়দের সমস্যা তাদের মনের কথা  ব্রিটিশ  প্রশাসন বুঝতো তাহলে সিপাহী বিদ্রোহ হোত এরূপ মনে করা যায় না।
আমার শেষ বক্তব্য হচ্ছে এদেশে ইংরেজদের ভাবি নিরাপত্তা ও দেশীয়দের কল্যাণ এই দুই’এর পক্ষে আর কোন বিষয় এতখানি প্রয়োজনীয় নয়, যতখানি প্রয়োজন সকল শ্রেণীর ইউরোপীয়গণ যেন এদেশবাসীর আভ্যন্তরীণ ও মন-মানিসকতার বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকেন। দেশীয় জনসাধারণের সন্তুষ্টি বিধান করতে না পারলে শাসকদের উন্নতি সাধনের প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হবে না, হয় না। আমার শেষ কথা আমার ক্ষুদ্র নসিহত এই যে দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্রে ও পুস্তকে কি লেখা হয় তা পড়ার জন্য প্রশাসকদের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি। আর যদি শাসকগণ নেটিভদের ভাষায় প্রকাশিত পত্র-পুস্তকের প্রতি অবজ্ঞাপাত করেন তাহলে তার মত নির্বুদ্ধিতা আর কিছুই হতে পারে না।

লঙ সাহেবকে আর কিছুই বলতে দেয়া হোল না কাঠের হাতুড়ী ঠুকে অর্ডার অর্ডার বলে। বিচারপতি পিকক্ পূর্ব রায় বহাল রেখেই হাজার টাকা জরিমানা আর এক মাস কারাদন্ডের আদেশ দেন। ২৪ জুলাই ১৮৬১ জরিমানার টাকা রকামান্ত ঠাকুর ও রাজা রাধা কান্ত দেব দিতে চাইলেও ওদের নিরস্ত করে। সেই কারাদন্ডের টাকা দিয়েছিলেন “হুতুম প্যাচার নকশা ”রচয়িতা কালীপ্রসন্ন সিংহ। কালী প্রসন্ন সিংহ জেলের বদলে আরও টাকা দিতে চাইলে বিচারপতি তা নাকচ করে দিয়ে কারাগারে পাঠাবার নির্দেশ দেন। তখন কোর্টের বাইরের দৃশ্য ছিল দেখার মত, কয়েক হাজার বাঙালি এসে কোর্টের চারপাশে ঘিরে ফেলেছিল। প্রয়োজনবোধে তারা তাদের বন্ধু লঙ সাহেবকে ছিনিয়ে নেবে। অবস্থা দেখে বাদী পক্ষ বন্দুকধারী সৈনিক মোতায়েন করে। লঙ সাহেবেক যখন কারাগারে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঘোড়ার গাতিতে ওঠায়, তখন ঐ জনতা ধ্বনি তুলে লঙকে ছিনিয়ে নিতে এগিয়ে এলে, ফাঁকা গুলী চালালে জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। কারাদন্ড ভোগ করেছিলেন জেমস লঙ।

তৎকালীন বাউল কবিরা সে সময় গান লিখেছিলেন-

“নীল বানরে সোনার বাংলা, করলে এবার ছাড়ে খার।

অসময়ে হরিশ মোলো, লঙের হলো কারাগার।

প্রজা আর প্রাণ বাঁচানো হলো ভার”।

সূত্রঃ বাংলাপেডিয়া, দৈনিক সংগ্রাম, উইকিপিডিয়া

লেখকঃ বোরহান মাহমুদ