অন্যান্য

র‍্যাডক্লিফ লাইনঃ হতাশায় আঁকা এক নির্মম সীমান্ত রেখা

অন্যান্য মঙ্গলবার, ২৪ মার্চ ২০২০ ০৭:২৯:৫৩

    "ঠাকুর্দা বলেছিলেন দ্যাখ দ্যাখ ওটা পানকৌড়ি
    অনেকদিন পরে আজ আবার পানকৌড়িকে দেখলাম
    দেশভাগ হয়ে গিয়েছে কবেই তো। মাঝখানটুকু কাঁটাতারের
    বেড়া পানকৌড়ি খবর রাখে না।"

১৯৪৭ সালের ১৭ এই আগস্ট। মাত্র দু-তিনদিন আগে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে দুটো আলাদা দেশ ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হয়েছে। দু দেশের মানুষ আনন্দে আত্মহারা, স্বাধীনতার আনন্দ। এই উদ্বাহু আনন্দের মধ্যখানেই প্রকাশিত হয় স্বাধীন দুই দেশের ভিন্ন মানচিত্র। র‍্যাডক্লিফ নামের ব্রিটিশ আইনজীবী নির্মাণ করেন দুই দেশের সার্বভৌমত্বের দলিল। স্বাধীনতার উদযাপনে মেতে থাকা দুই দেশের মানুষ পড়ল মহাবিপাকে। ধর্মের ভিত্তিতে পাওয়া স্বাধীনতার দায়িত্ব পালন করতে ছাড়তে হল দেশ। হিন্দুরা চলে গেল ভারতে, পাকিস্তান ছুটতে লাগল মুসলিমরা। মাঝখান দিয়ে শুরু হল ভয়াবহ শরণার্থী সমস্যা। উদ্বাস্তুতে পরিণত হল লাখ লাখ মানুষ। স্বাধীনতার মূল্য এভাবে দিতে হবে কজন জানত?

ভারত স্বাধীন হবে তবে

১৮৮৫ সালে সর্বভারতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা পেলে ভারতের হিন্দুরা রাজনৈতিকভাবে একটি বৃক্ষের ছায়াতলে এসে পড়ে। ব্রিটিশ সরকারের আনূকূল্যে থেকে হিন্দুদের উৎকর্ষতা বেড়ে চলছিল ঊর্ধগতিতে। বেচারা মুসলমানদের তখনো সৎ ভাই হিসেবেই দেখত ব্রিটিশরা৷ ব্রিটিশ ভারতে হিন্দুদের এমন অগ্রগতি আর মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ার হতাশা থেকে ১৯০৬ সালে ঢাকায় জন্ম নেয় মুসলিম লীগ। মুসলমানরা রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে পড়ে। এত বড় দেশে কখনোই যুগপৎ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা পেতে পারেনি। ১৯১৬ আর ১৯২৩ এর বেংগল প্যাক্ট বাদে দুই সম্প্রদায়ের মানুষজন নিজেদের আপন ভাবতে পারেনি কখনো। দাঙ্গা হাংগামা আর অবিশ্বাস থেকে ভারতে মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হয় ঐতিহাসিক দ্বিজাতিতত্ত্ব ফর্মূলা। এই তত্ত্বেই ভারতে ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়। তারপরের ইতিহাস আরো করুণ আরো অবিশ্বাসের। কলকাতা, বিহার আর নোয়াখালী দাঙ্গা উভয় সম্প্রদায়ের মানুষজনের কাছে দেশভাগ অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষও ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার জন্য পাশ করে ভারত স্বাধীনতা আইন। ভারতের শেষ বড়লাট দু দেশের সীমানা নির্ধারণ করার জন্য ইংল্যান্ড থেকে এক আনকোরা আইনজীবীকে ধরে নিয়ে আসেন। নাম তার সিরিল র‍্যাডক্লিফ।

র‍্যাডক্লিফ ও একটি হতাশায় আঁকা লাইন

সিরিল র‍্যাডক্লিফ পেশায় ছিলেন ইংল্যান্ডের বারের একজন আইনজীবী। তার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ডের তথ্য মন্ত্রণালয়ে কাজ করা। লর্ড মাউন্টব্যাটেন যখন তাকে সীমান্ত কমিশনের প্রধান হিসেবে নির্বাচন করলেন তখন ব্রিটিশদের অবস্থা এমন যে যেন ভাগ করে পালাতে পারলেই বাঁচি৷ প্রস্তুত ছিলেন না র‍্যাডক্লিফ নিজেও। আগ্রহ ছিলনা তার। নিতান্ত অনাগ্রহী হয়ে তিনি এই বৃহৎ দেশটি ভাগ করতে বসলেন ধর্মের ভিত্তিতে। তাকে সময় দেয়া হল মাত্র ৫ সপ্তাহ। কাজটি এতোই দায়িত্বজ্ঞানহীন এর সাথে করা হল যে, র‍্যাডক্লিফকে একটা ঠিকঠাক মানচিত্রও দেওয়া হল না। জিন্নাহ নেহরুরাও দেরি করতে চাইলেন না পাছে ব্রিটিশরা আবার গদি ধরে আঁকড়ে থাকে। একটিবার ভাবা হলো না সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাসে পরিপূর্ণ এই দেশে হুট করে একটা রেখে টেনে দেয়ার ফলাফল কি হতে পারে। ১২ আগস্ট র‍্যাডক্লিফ তৈরি করলেন ভারত পাকিস্তানের চূড়ান্ত মানচিত্র। কিন্তু সেদিনই প্রকাশ করা হল না সেটি। ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারতীয় নেতাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে স্বাধীনতা প্রদান করা হয় ভারতের,স্বাধীন হয় পাকিস্তান ও ভারত নামের দুই রাষ্ট্র। স্বাধীনতার আনন্দে যখন দুই দেশের মানুষ উন্মাতাল তখন ১৭ আগস্ট প্রকাশ করা হল আলাদা মানচিত্র। এর দুইদিন আগেও কেউ জানত না কোথায় তার দেশের মানচিত্র। নতুন মানচিত্র প্রকাশের সাথে সাথে হতাশা ছড়িয়ে পড়ে। নতুন দেশে পাড়ি জমাতে শুরু হয় তোড়জোড়। কারো ঘর, ভিটেমাটি, পুকুর কিংবা সাধের গাছগুলো পড়ে গেল র‍্যাডক্লিফের নিষ্ঠুর দাগে। ফলে নিরূপায় হয়ে মানুষ ছুটতে থাকে নতুন দেশে। হিন্দুরা হয় ভারতমুখী, মুসলিমরা ধরে পাকিস্তানের ট্রেন, ঐতিহাসিক ট্রেন টু পাকিস্তান।  শুধুমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের কারণে বাংলার এক অংশ পড়ল ভারতে অন্য অংশ পড়ল পাকিস্তানে৷ পাঞ্জাবের এক অংশ পড়ল পাকিস্তানে আরেক অংশ পড়ল ভারতে। হিন্দুরা পাড়ি জমায় ভারতে, ভারতের মুসলমানরা আসে পাকিস্তানে। দু পক্ষই একে অন্যকে বাধ্য করতে থাকে দেশত্যাগে। ফলে আবার নতুন করে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের সৃষ্টি হয়। এই সংকট এতোই ঘনীভূত হয়ে পড়েছিল যে, প্রায় ৬০০ টি শরণার্থী শিবির গড়ে উঠে যারা প্রকৃত অর্থেই দেশহীন হয়ে পড়েছিল। দুই দেশ থেকে আসা যাওয়ার মাঝখানে দু পক্ষ জড়িয়ে পড়ে হানাহানিতে। রাতারাতি নিজের ভিটে ছেড়ে অজানা দেশে পাড়ি জমাতে গিয়ে উদ্বাস্তু সংকটের সৃষ্টি হয়। ৪০ কোটি মানুষের এমন অবস্থা যে হবে তা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন র‍্যাডক্লিফ ও ভারতীয় রাজনীতিবিদরা। কিন্তু তারা ভেবেছিলেন এসব আপোষ মীমাংসা করে শেষ করে ফেলবেন। কিন্তু সমস্যা এতই গভীর হয়ে উঠেছিল যে স্বাধীনতার আনন্দকে কবর দিয়ে সাধারণ জনতাকে মোকাবেলা করতে হয়েছিল এক  নজিরবিহীন মানবসৃষ্ট দূর্যোগ। র‍্যাডক্লিফ বুঝতে পেরেছিলেন এরকম কিছু একটা ঘটবে। তাই তিনি যাবার বেলায় বলে গিয়েছিলেন, তার নাম শুনলে এই উপমহাদেশের মানুষ ঘৃণায় মুখ ঢাকবে। বলে গিয়েছিলেন তিনি আর আসবেন না কখনো এই দেশে। পুড়িয়ে দিয়েছিলেন নিজের সভ নথিপত্র। এই সংকটে প্রায় ৫-১০ লক্ষ হিন্দু মুসলমান প্রাণ হারায় এবং হাজার হাজার নারী নির্যাতিত হয়।

সিরিল র‍্যাডক্লিফ ইংল্যান্ডে গিয়ে এই কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছিলেন নাইটহুড খেতাব। কিন্তু যে সমস্যা তিনি জিইয়ে রেখে গিয়েছেন তার জন্য আজো ভারত পাকিস্তান বারবার যুদ্ধে জড়াচ্ছে কাশ্মীর নিয়ে। পৃথিবীর ভয়ংকরতম সীমান্ত এই ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ সীমান্ত। উপমহাদেশের বুকে কলমের এই দাগ নিঃসন্দেহে এক দগদগে ক্ষত নিয়েই বয়ে বেড়াতে হবে।
লেখকঃ উবায়দুর রাজু