
আল কায়দার উত্থানের প্রেক্ষাপট ও ধারাবাহিক ইতিবৃত্ত
৯/১১ হামলার পর থেকে সমগ্র বিশ্বে সন্ত্রাস বিরোধী মনোভাব তিব্র হতে থাকে। আর এই কাজে যারা সবচাইতে অগ্রণী ভুমিকা পালন করে তারা হলো মিডিয়া বিশেষ করে পশ্চিমা মিডিয়া। তারা এই কাজটি করতে গিয়ে সুকৌশলে আরেকটি বিষয় কে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দেয় সেটি হল মুসলিম সন্ত্রাসী। অর্থাৎ একটা পর্যায়ে এসে তারা মুসলিম ও সন্ত্রাসী একটি কে অপরটির পরিপূরক হিসেবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়। তাই পশ্চিমা বিশ্বে আজকে মুসলিমদের কে সন্ত্রাসী হিসেবে দেখা হয় একই সাথে মুসলিমদের নিয়ে তাদের মনে একধরনের ভীতিও কাজ করে। তবে আজকের এই পরিস্থিতির জন্য যে সংগঠনটি দায়ী সেটি হলো আল কায়দা।তাই চলুন জেনে আসা যাক এই আল কায়দার উত্থান কিভাবে হলো এবং কিভাবে তারা আজকের এই অবস্থায় আসলো।
আল কায়দা সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের আগে ছোট্ট করে তালেবান সম্পর্কে জেনে আসতে হবে। বলা হয়ে থাকে যে তালেবানের বাই প্রোডাক্ট হিসেবেই আল কায়দার জন্ম হয়েছে। ১৯৮০ এর দশকে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান দখলের চেষ্টা করলে আমেরিকা ও পাকিস্তানের সহায়তায় আফগান মুজাহিদিন তালেবানরা সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকে। আর এই যুদ্ধকে তখন মুসলিমদের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের যুদ্ধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ফলে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে তালেবানদের পক্ষে সাহায্য আসতে থাকে। এরকম ই একজন সাহায্যকারী হিসেবে তালেবানের পাশে এসে দাড়ায় সৌদিআরবের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ওসামা বিন লাদেন। পেশায় তিনি প্রকৌশলী হলেও তার পারিবারিক নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল। ফলে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সাহায্য সহযোগিতার জন্য ওসামা বিন লাদেন এগিয়ে আসেন। এসময় তিনি তালেবানদের কে বিপুল পরিমাণ অর্থ সহায়তা দান করেন। আফগান যুদ্ধে সোভিয়েতের পতনের পর তালেবানরা আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসলে ওসামা বিন লাদেন তালেবানের সাথে আর না থেকে নিজে একটি সংগঠন গড়ে তোলার সংকল্প পোষন করেন।
এদিকে আব্দুল্লাহ বিন আজ্জাম নামক একজন ফিলিস্তিনি নাগরিক আল কায়দা সুলবাহ নামক একটি সংগঠন গড়ে তোলেন সেখানেও ওসামা বিন লাদেন একজন অর্থদাতা হিসেবে ভুমিকা পালন করতো। পরবর্তী সময়ে আজ্জামের সাথে বিন লাদেনের সম্পর্কের ফাটল সৃষ্টির সূত্র ধরে ওসামা বিন লাদেন নিজেই এই সংগঠনটির একটি অংশের দায়িত্ব নিয়ে নেয় এবং তার নাম পরিবর্তন করে শুধু আল কায়দা রাখা হয়। এই সংগঠনের কার্যক্রম কে সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার নীতি গ্রহণ করে একই সাথে পৃথীবির বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তরুন মুসলিম যুবকদের টার্গেট করে এই সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করা হতে থাকে। সংগঠন প্রতিষ্ঠার অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই তারা সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের সূচনা করে এবং আত্মঘাতী সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। শুরুতে তারা তাদের এই কার্যক্রম ছোট কিছু অপারেশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলেও যে হামলার মাধ্যমে তারা সারা বিশ্বের নজর কাড়ে সেটি হলো ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপুর্ন তিনটি স্থানকে লক্ষ্য করে একযোগে হামলা চালানো। এসব স্থানসমুহ হলো মার্কিন নিরাপত্তা দপ্তর পেন্টাগন, প্রেসিডেন্ট বাসভবন হোয়াইট হাউস এবং অন্যতম বানিজ্যিক কেন্দ্র টুইন টাওয়ার। এগুলোর মধ্যে টুইন টাওয়ারে তারা সফলভাবে হামলা করতে সক্ষম হয়। পর পর দুইটি বিমান হামলা করে সম্পুর্ন টাওয়ার ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়। কিন্তু অপর দুইটি স্থানে হামলা করার পূর্বেই মার্কিন সামরিক বাহিনী আল কায়দার বিমানসমুহ কে ভূপাতিত করতে সক্ষম হয়।
এই ঘটনার পর সমগ্র বিশ্বে আল কায়দা তথা মুসলিম জঙ্গিগোষ্ঠী সম্পর্কে ভীতি গড়ে উঠে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব আল কায়দা কে নির্মূল করার জন্য উঠে পরে লাগে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আফগানিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে তালেবানদের উৎখাত করেন। এতে আল কায়দাও বেকায়দায় পড়ে যায় কেননা আল কায়দার মুল ঘাঁটি ছিল আফগানিস্তানে।এসময়ে আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেন কে গ্রেপ্তার করার জন্য মার্কিন বাহিনী উঠে পড়ে লেগে যায়। ওসামা বিন লাদেনও সুকৌশলে মার্কিনদের চোখ ফাকি দিয়ে আত্মগোপনে থেকে একের পর এক আত্মঘাতী হামলা ঘটাতে থাকে। ফলে তালেবান ও আল কায়দা কে উৎখাতের জন্য মার্কিনীরা সরাসরি আফগানিস্তানে হামলা চালাতে থাকে এতে মার্কিন বাহিনীর সাথে তালেবান ও আল কায়দার সরাসরি যুদ্ধের সূত্রপাত হয়ে যায় যা বর্তমানেও অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে আফগানিস্তানে আল কায়দার অবস্থা খারাপের দিকে গেলে ওসামা বিন লাদেন পাকিস্তানে এসে আত্মগোপন করেন এবং সেখান থেকেই জঙ্গিবাদী কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকেন।
২০১১ সালের ২মে পাকিস্তানের এবোটাবাদে মার্কিন কমান্ডোদের এক অপারেশনে ওসামা বিন লাদেন নিহত হয়। এর পূর্বে বেশ কয়েকটি দেশে আল কায়দার শাখা গড়ে তোলেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো সিরিয়া,ইরাক,লিবিয়া, ইয়েমেন। তার মৃত্যুর পর আইমান আল জাওয়াহিরি আল কায়দা কে সরূপে ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু সমগ্র বিশ্বে আল কায়দা সম্পর্কে নেতিবাচক ধারনা, সম্মেলিত বাহিনীর আক্রমণ ও তাদের অর্থ যোগান সংকির্ন হয়ে আসার কারনে তারা বর্তমানে পতনের দিকে ত্বরান্বিত হচ্ছে তবে এখনো সমুলে ধ্বংস হয়ে যায় নি। ছোট ছোট হামলা ও ভিডিও বার্তা প্রদানের মাধ্যমে তাদের অস্তিত্ব মাঝে মাঝে জানান দেয়ার চেষ্টা করেন। সে যাই হোক ইসলাম ধর্ম এই ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম কোনদিনই সমর্থন করে নি। তাছাড়া তাদের পিছনে খোদ পশ্চিমা বিশ্বেরই নানা মদদ রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। তাই আমাদেরও চাওয়া যে এসব জঙ্গিগোষ্ঠীর পতনের মাধ্যমে ইসলাম কলঙ্ক মুক্ত হবে এবং শান্তির বানী নিয়ে স্বরূপে ফিরে আসবে।
তথ্য সূত্র
১.https://www.google.com/amp/s/www.history.com/.amp/topics/21st-century/al-qaeda
২.https://www.bbc.com/bengali/news/2014/03/140307_mb_bd_al_qaeda
৩.https://m.somewhereinblog.net/mobile/blog/priyo_bangla/29925843
লেখকঃ ফরিদ মোল্লা