অন্যান্য

সালেম উইচ ট্রায়ালঃ মধ্যযুগের ইউরোপে ডাইনি নিধনের ইতিহাস

অন্যান্য শুক্রবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৬:৫২:১৬

সময় তখন ১৬৯২ সালের মাঝামাঝি। তৎকালীন কলোনিয়াল আমেরিকার ম্যসাচুসেটস প্রদেশের সালেম নামের একটি গ্রামে কিছু ডাইনীর সন্ধান পাওয়া যায়। গ্রামের লোকজন খুব সন্ত্রস্ত হয়ে খেয়াল করল এই ডাইনিগুলো শয়তানের পূজা করার মাধ্যমে নিজেদের এমন অতিমানবীয় ক্ষমতায় নিয়ে গেছে যে তারা যেকোন সময় গ্রামবাসীর ক্ষতিসাধন করতে পারে। উৎসাহী গ্রামবাসী এমন ১৯ জন ডাইনিকে একে একে খুঁজে বের করে। এই ১৯ জনের বিরুদ্ধে গ্রামবাসীর অভিযোগ ছিল যে, এরা শয়তানের কাছে নিজেদের আত্মা বিক্রি করে দিয়ে ডাকিনীবিদ্যার চর্চা করে গ্রামের শান্তি নষ্ট করতে চাইছে। এজন্য তারা এই ১৯ জনকে বিচারের মুখোমুখি করায়। শাস্তি হিসেবে তাদের গড়া স্থানীয় বিচারালয়ে এদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। অভিযুক্তদেরকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই এই বিচার সম্পন্ন করা হয়। খুঁজে খুঁজে আরো এমন 'ডাইনি' ধরে এনে এই আদালত তাদের কারাবন্দী করে রাখে। ইতিহাসে এই ঘটনা পরিচিত সালেম উইচ ট্রায়াল নামে।


ডাইনি হত্যার কলংকিত ইতিহাস

১৬৯২ সালে ঘটে যাওয়া সালেম উইচ ট্রায়ালের এই ঘটনার বহু আগে ইউরোপে ডাইনি নিধনের এক করুণ ইতিহাস প্রোথিত হয়েছিল। ১৩০০ সাল থেকে শুরু হওয়া ডাইনি শিকার করার প্রথা চলেছিল আঠারো শতকের শেষ নাগাদ পর্যন্ত। ইউরোপের এই অমানবিক প্রথার তিন-চতুর্থাংশ ঘটেছিল পশ্চিম জার্মানি, ফ্রান্স, উত্তর ইতালি এবং সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে। ইউরোপের শেষ ডাইনি হত্যার ঘটনা ঘটে ১৭৮২ সালে সুইজারল্যান্ডে। মানুষের ভয় ও আবেগকে কাজে লাগিয়ে এসব ডাইনি হত্যা ছিল প্রকারন্তরে গির্জা রাজনীতি , পারিবারিক শত্রুতার জেরে ঘটা কিছু নিরীহ নারীদের ওপর প্রতিশোধের নির্মম বলিদান।

সালেম উইচ ট্রায়াল

১৭ শতকে ম্যাসাচুসেটসে সালেম নামের দুইটি জায়গা ছিল। একটি ছিল ম্যাসাচুসেটস উপসাগর তীরবর্তী শহরতলী সালেম শহর আর আরেকটি ছিল এর ১৬ কিলোমিটার ভেতরে অবস্থিত কৃষিকেন্দ্রিক ছোট্ট গ্রাম সালেম। প্রায় ৫০০ মানুষের বসবাস ছিল এই গ্রামে। গ্রামীণ সমাজ স্পষ্টত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এদের এক ভাগ ছিল বন্দরে কাজে নিয়োজিত চাকরিজীবী যাদের কিনা সালেম শহরের বড় বড় ব্যবসায়ীদের সাথে ভাল যোগাযোগ ছিল। আর আরেক ভাগ ছিল দরিদ্র কৃষক শ্রেণী। বৈচিত্র্যময় এ গ্রামে ১৬৯২ সালের প্রথম নাগাদ একটি গুজব রটে যে গ্রামের কিছু তরুণী শয়তানের আরাধনা করছে এবং তারা তাদের আত্মা শয়তানের কাছে বন্ধক দিয়ে ডাইনিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। গ্রামের সহজ সরল মানুষদের মনে এই গুজব বেশ প্রভাব ফেলে এবং আতংকের সৃষ্টি করে। ঘটনাটি ভয়ংকর মোড় নেয় যখন ১৬৯২ সালের জানুয়ারিতে ৯ বছর বয়সী এলিজাবেথ প্যারিস এবং এবিগাইল উইলিয়ামস হঠাৎ করে মূর্ছাতুর হয়ে পড়ে এবং তার আগে বিকট চিৎকার চেচামেচি করে  মানুষ জড়ো করে ফেলে। এই দুই শিশুকে স্থানীয়  চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে চিকিৎসক এদের ওপর শয়তান ভর করেছে বলে মত দেয়। এর কিছুদিন পর আরো কিছু তরুণী এরকম হঠাৎ করে চিৎকার চেচামেচি করে মূর্ছা যেতে থাকে। ফলে মানুষের মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে যে এরা আসলেই ডাইনি কি না। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে আরো ৩ জনকে অভিযুক্ত করা হয় এবং তাদের ডাইনি বলে সাব্যস্ত করে এদের বিচারের জন্য একটি স্থানীয় আদালত তৈরি করা হয়। শেষমেশ এই ৩ জনকে জিজ্ঞাসাবাদে আনা হয় ম্যাজিস্ট্রেট জোনাথন কোরউইন এবং জন হ্যাথ্রোইনের নেতৃত্বাধীন বিচারালয় সালেম উইচ ট্রায়ালে। প্রকৃতপক্ষে অভিযুক্তরা কখনো ডাকিনীবিদ্যার সাথে জড়িত ছিল না। প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তারা পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল মাত্র। অভিযুক্ত ২ জন নিজেদের নির্দোষ দাবি করলেও তিতুবা নামের একজন নিজেকে ডাকিনিবিদ্যার সাথে জড়িত বলে স্বীকার করে। সে চেয়েছিল নিজেকে ডাইনিদের বার্তাবাহক হিসেবে দাবি করে বড় শাস্তি থেকে বাঁচতে। তার এই স্বীকারোক্তিতে কপাল পুড়ে বাকিদের। সে বছরের জুন মাসে প্রথম অভিযুক্ত হিসেবে ব্রিজেট বিশপ নামের এক নারীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। একই অভিযোগ এরপর আরো ১৮ জন নারীকে ফাসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। এরপর ধারাবাহিকভাবে আরো ১৫০ জন পুরুষ এবং মহিলা যাদের মধ্যে শিশুও ছিল, একইভাবে শাস্তি প্রদান করা হয়। মিথ্যা এই বিচারকার্য এভাবে বিরামহীনভাবে একপেশে রায় দিয়ে চলতে থাকলে সেপ্টেম্বর মাসে সাধারণ জনগণের সহানুভূতি পায় অভিযুক্তরা এবং তারা বিশ্বাস কর‍তে শুরু করে এই বিচার আসলে এক সাজানো ব্যাপার ছাড়া কিছুই না। কিন্তু ততোদিনে খুব দেরি হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে ম্যাসাচুসেটস সরকার এই ঘটনাকে অবিচার হিসেবে উল্লেখ করেছিল। ১৬৯৭ সালের জানুয়ারিতে এই আদালতে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্তদের সম্মানার্থে ম্যাসাচুসেটস এর কেন্দ্রীয় আদালত একদিনের জন্য উপবাস পালন করে মৃতদের স্মরণ করে। সেমুয়াল সেওয়াল নামের সালেম উইচ ট্রায়াল এর এক বিচারক প্রকাশ্য জনগণের কাছে ক্ষমা চান। ম্যাসাচুসেটস কর্তৃপক্ষ মৃতদের পরিবারেকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করে।


মধ্যযুগে শুরু হওয়া এই ইউরোপীয় বর্বরতার বলি হওয়া নিরপরাধ কিছু নারী ও পুরুষের এমন ত্যাগের উপর দাঁড়িয়ে আজকের ইউরোপ পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি আধুনিক এবং প্রগতিশীল। সালেম উইচ ট্রায়ালের মত অমানবিক হত্যাযজ্ঞ ইতিহাসে দগদগে ঘা হয়েই রবে চিরকাল।


তথ্যসূত্র
 https://www.britannica.com/event/Salem-witch-trials/The-trials
https://www.google.com/amp/s/www.history.com/.amp/topics/colonial-america/salem-witch-trials

লেখকঃ উবায়দুর রহমান রাজু