রামমালা পাঠাগার- কুমিল্লায় অবস্থিত শতাব্দী প্রাচীন গবেষণা গ্রন্থাগার
অনেকের কাছেই হয়ত অপরিচিত বাংলাদেশের এই শতাব্দী-প্রাচীন গবেষণা গ্রন্থাগার- ‘রামমালা পাঠাগার’। রাজধানী শহর ঢাকা থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরের একটি মফস্বল শহর কুমিল্লায় অবস্থিত। এই গ্রন্থাগারে সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন, ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ক দুস্প্রাপ্য বারো হাজার গ্রন্থ ও সাড়ে আট হাজার হাতে লেখা পুঁথির সংগ্রহ রয়েছে।
রামমালা পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা হলেন শ্রী মহেশ ভট্টাচার্য। তাঁর অপরিসীম শ্রম ও দানের ওপর নির্ভর করেই এই পাঠাগারটি গড়ে ওঠে। মহেশ ভট্টাচার্য (১৮৫৮-১৯৪৩) বাবার নামে করেছেন কুমিল্লা ঈশ্বর পাঠশালা হাই স্কুল। মা রামমালা দেবীর নামে করেছেন রামমালা গ্রন্থাগার। মহেশ ভট্টাচার্য ছিলেন কুমিল্লা জেলার বিটঘর গ্রামের বাসিন্দা। বর্তমানে এই গ্রামটি নবীনগর উপজেলার অন্তর্গত। মহেশ ভট্টাচার্যের গ্রাম বিটঘর সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিদ্যাশিক্ষায় অগ্রণী ছিল। কিন্তু শ্রী মহেশ ভট্টাচার্যের পরিবার দারিদ্র্য-পীড়িত ছিলেন বলে তিনি বিদ্যাশিক্ষার পরিবর্তে ভাগ্যান্বেষে শৈশবেই কুমিল্লা চলে আসেন। জানা যায়, মহেশ ভট্টাচার্য ভালো রান্না করতে পারতেন। কুমিল্লায় এসে তিনি প্রথমে কয়েকটি বাড়িতে পাচকের কাজ নেন। কিছুদিন পর এই কাজ করে তার হাতে কিছু টাকা-পয়সা জমলে তিনি স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু সেখানেও তাকে অর্থের অভাবে কয়েক বছরের জন্য লেখাপড়া বন্ধ করে রাখতে হয়। পরে তিনি বিভিন্ন কাজের পারিশ্রমিক হিসেবে কিছু অর্থকড়ি রোজগার করেন এবং ‘ভট্টাচার্য অ্যান্ড কোং’ নামে একটি হোমিওপ্যাথি ওষুধের দোকান খোলেন। এবার তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়। তিনি অনেক অর্থের মালিক হন। মূলত সে অর্থ দিয়েই তিনি মায়ের নামে নিবেদিতা স্কুল ও ঈশ্বর পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করেন এবং ছাত্রদের থাকার জন্য রামমালা ছাত্রাবাস নির্মাণ করেন। একই সঙ্গে বিরাট একটি নাটমন্দির নির্মাণ করেন।
এখানেই তৎকালীন কুমিল্লার সভা-সমিতি, সংগীত ও বিচিত্র ধরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। মহেশ ভট্টাচার্য রামমালাকে মূলত একটি কমপেক্স হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন, পরে রামমালা পাঠাগার তত্ত্ববধান ও এই গ্রন্থাগারের বইপত্র কেনার জন্য শ্রী রাসমোহন চক্রবর্তীকে চাঁদপুর থেকে কুমিল্লা নিয়ে আসেন। এই রাসমোহন চক্রবর্তী আজীবন নিজ সন্তানের মতো রামমালা পাঠাগারকে অাঁকড়ে ধরেছিলেন। তিনি ছিলেন অকৃতদার, পড়াশোনাই ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত। মূলত তাঁর নীরব- নিভৃতের তপস্যায় এবং মহেশ ভট্টাচার্যের অর্থায়নে রামমালা পাঠাগার একটি আদর্শ গবেষণা গ্রন্থাগারে রূপ নেয়।
কুমিল্লা সদরেই মহেষাঙ্গন। সদর দরজা দিয়ে ঢোকার পর সোজাসুজি যে ভবন, তার নিচতলায় গ্রন্থাগারের পুস্তক বিভাগ। পুঁথি বিভাগটি মহেষাঙ্গনের দেবালয়ের পাশে। সেখানে এখন সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। পুস্তক বিভাগের ১৪টি আলমারি দুষ্প্রাপ্য বইয়ে ঠাসা। রবীন্দ্রনাথের নামাঙ্কিত একটি স্মৃতিফলক আছে সেখানে। রবীন্দ্রনাথ মহেষাঙ্গনে এসেছিলেন ১৯২৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। দৈনিক কালের কন্ঠে ৯ ফেব্রুয়ারী ২০১৮ এর একটি ফিচার হতে জানা যায় বর্তমান গ্রন্থাগারিক ইন্দুকুমার সিংহ (বর্তমান বয়েস ৮০ এর বেশী) মারফত জানা যায় যে ১৯১২ সালে ঈশ্বর পাঠশালা স্কুলের প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আর গ্রন্থাগারটি ১৯১৯ সালে। শুরুতে মহেষাঙ্গনে পাকা বাড়ি ছিল না। ২৪টি টানা টিনের ঘর ছিল। দালানের কাজ ধরেছিলেন ১৯১৫ সালে। রাসমোহন চক্রবর্তী টোল চালাতেন গর্জনখোলায়। কিন্তু ছাত্রসংখ্যা বেশি হয়ে যাওয়ায় মহেশবাবু টোলটি মহেষাঙ্গনে নিয়ে আসেন। রাসমোহন বাবুর সহকারী হয়ে কাশি থেকে আসেন পণ্ডিত নবীনচন্দ্র ব্যাকরণতীর্থ। আরেকজন সহকারীও ছিলেন, নাম পণ্ডিত স্মৃতিতীর্থ। টোলের জন্য তখন বই পাঠাতেন কাশির হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অন্নদাচরণ তর্কচুড়ামণি। কলকাতার একজন অধ্যাপকও বই পাঠাতেন। বইপত্র সংরক্ষণ করতেন স্মৃতিতীর্থ মহাশয়। আস্তে আস্তে সংস্কৃত লাইব্রেরিটি গড়ে উঠল। স্থানীয়রা তখন সংস্কৃত বেশি বুঝত না। তাদের অনুরোধে বাংলা বই আর পত্রপত্রিকা সংগ্রহ করা হতে লাগল। একপর্যায়ে ভারত সংস্কৃতিবিষয়ে বই সংগ্রহ করা শুরু হয়। এ বিষয়ে যত রকম বই পাওয়া গেল কোনোটাই বাদ দেওয়া হলো না। তারপর তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের বই জোগাড় করা হলো। পৃথিবীর প্রায় সব ধর্মের বই এখানে পাবেন। আর পুঁথি এখানে আছে প্রায় ২৫ হাজার। মহেশবাবু বলতেন, পুঁথি সংগ্রহের এখনই ভালো সময়, নইলে নষ্ট হয়ে যাবে। তিনি পুঁথি কিনেও নিয়েছেন অনেক। অনেক পুঁথি ভুর্জপত্রে লেখা।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলা একাডেমীর মতো জাতীয় প্রতিষ্ঠান ভিন্ন রামমালা পাঠাগারের মতো প্রাচীন পুঁথির সংগ্রহশালা আর কোথাও নেই।
সূত্রঃ বাংলাপেডিয়া এবং কালের কন্ঠ