ইতিহাস

হাসান বিন সাবাহ ও গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়ের কথা

ইতিহাস সোমবার, ০৪ নভেম্বর ২০১৯ ০১:৩২:৫৭

আব্বাসীয় খিলাফতের সমকালীন সময়ে এই খিলাফতের সাথে পাল্লা দিয়ে গড়ে উঠেছিল আঞ্চলিক কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলিম সাম্রাজ্য। সেলজুক সালতানাত ছিল এমনই এক ক্ষুদ্র মুসলিম শাসিত অঞ্চল। এই সাম্রাজ্যের সুলতান মালিক শাহ ( ১০৭২-১০৯২) এর শাসনের শেষদিকে উদ্ভব হয় এক গুপ্ত সন্ত্রাসবাদী দলের৷ যারা ইতিহাসে পরিচিত গুপ্তঘাতক সম্প্রদায় নামে। এরা মুসলিম সাম্রাজ্যে এক ধরণের ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে। গুপ্তহত্যা, লুন্ঠন ইত্যাদি ছিল তাদের নিত্যকাজ। এদের মূল টার্গেট ছিল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ৷ বিশেষ কিলিং মিশনে এরা ছিল পটু। মুসলিম ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত নিজাম উল মূলক এদের হিংস্রতার স্বীকার হয়ে নিহত হোন। নিজাম উল মুলকের এক সময়ের বন্ধু হাসান বিন সাবাহ ছিলেন এই দলের প্রতিষ্ঠাতা৷ যিনি ইতিহাসে পর্বতের বৃদ্ধ লোক বা Old man of the mountain নামে পরিচিত।

গুপ্তঘাতক সম্প্রদায় এর ইংরেজি নাম এসাসিন (Assassin) ৷ কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন,  এসাসিন শব্দ হাসানাউন বা হাসানীয়ীন শব্দের অপভ্রংশ। ঐতিহাসিক জেবিলিনের মতে, ফারসি শাহেনশাহ শব্দ থেকে এসাসিন শব্দের উৎপত্তি।  এর কারণ ছিল হাসান বিন সাবাহ তার শিষ্যদের কাছে শাহেনশাহ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন এবং তার কথা সবাই মান্য করত। এসাসিনরা হাশীশ নামের এক মদ জাতীয় পানীয় ব্যবহার করত এজন্য তাদেরকে হাসাসিনসও বলা হতো। ঐতিহাসিক আমীর আলী গুপ্তঘাতক সম্প্রদায়কে একটি নাস্তিক্যবাদী গোষ্ঠী বলে মত দিয়েছেন। যার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন হাসান বিন সাবাহ নামের শিয়া ইসমাইলীয় নেতা।

হাসান বিন সাবাহঃ পর্বতের বৃদ্ধ লোক

হাসান বিন সাবাহর পুরো নাম ছিল হাসান বিন আলী বিন মুহাম্মদ বিন জাফর বিন হোসাইন বিন আস সাবাহ আল হিমারী। কুফার কাছে কুম শহরে জন্ম নেয়া হাসান নিজেকে দক্ষিণ আরবের হিমারীয় রাজাদের বংশধর বলে দাবি করতেন। ১৭ বছর বয়সেই হাসান গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিষশাস্ত্র ও জাদুবিদ্যায় পারদর্শীতা অর্জন করেন।  পেশাগত জীবনের প্রথম দিকে সেলজুক সুলতান আল্প আরসালানের সমরাস্ত্র বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। পরে মালিক শাহের রাজকীয় বিভাগেও চাকরি গ্রহণ করেন। মালিক শাহের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নিজামুল মুলক এবং উমর খৈয়ামের সহপাঠী ছিলেন হাসান বিন সাবাহ। তাদের মধ্যে এই বলে প্রতিজ্ঞা হয় যে, যে সবচেয়ে উঁচু পদে আসীন হবেন তিনি বাকি দুজনকে প্রতিষ্ঠা পেতে সাহায্য করবেন। নিজামুল মুলক প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর উমর খৈয়াম ও হাসান বিন সাবাহকে প্রাদেশিক গভর্ণর পদে অধিষ্ঠান করেন। উমর খৈয়াম সন্তুষ্ট হলেও হাসান বিন সাবাহ মন্ত্রিত্ব দাবি করে বসেন। এতে নিজামুল মুলকের সাথে হাসান বিন সাবাহর দূরত্ব সৃষ্টি হয়। একবার নিজামুল মুলক কৌশলে হাসানকে ডেকে এনে সবার সামনে অপমান করেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে প্রতিশোধের বাসনা নিয়ে হাসান বিন সাবাহ মিশরে গমন করেন।

প্রথম জীবনে হাসান বিন সাবাহ দ্বাদশপন্থী শিয়াদল ইবনে আশারিয়ার অনুসারী হলেও পরবর্তীতে ইসমাইলীয় শিয়া মতবাদ গ্রহণ করেন। ফাতেমীয়দের প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন বিভিন্ন গুপ্ত সংগঠন। আজারবাইজানের প্রধান ফাতেমীয় প্রচারক ইবনে আততাশ হাসানকে ১০৭২ সালে মিশরে গমন করে এই মতবাদ প্রচার করার উপদেশ দেন। ১০৮০ সালের দিকে হাসান বিন সাবাহ কায়রোতে আসেন এবং প্রায় ১৮ মাস অবস্থান করেন।

নিযারীয় মতবাদ প্রচার

হাসান নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করে ফাতেমীয় খলিফা মুসতানসিরের বড় ছেলে নিযারের নামে প্রচারণা চালাতে থাকেন। ১০৯৪ সালে ফাতেমীয় খলিফা মুসতানসির মৃত্যুর আগে তার বড় ছেলে নিযারকে পরবর্তী খলিফা হিসেবে মনোনয়ন দিয়ে যান। কিন্তু আর্মেনীয় উজির খলিফার নাবালক পুত্র আবুল কাসিমকে সিংহাসনে বসান। এই কারণে মিশরের সাথে হাসান তার সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে নিযারীয় প্রচারণায় মন দেন। হাসান বিন সাবাহর শক্তিশালী ৬ প্রচারক দল ছিল।

১ম দল- দায়ী আল দোয়াত। এদের সদর দপ্তর ছিল গুপ্তঘাতকদের ঘাটি আলামুত দুর্গে ।

২য় দল- দায়ী আল কিবর- শ্রেষ্ঠ প্রচারক দল।

৩য় দল- দায়ী আল কিবর- সাধারণ প্রচারক দল।

৪র্থ দল- রফিক- এরা সাধারণের সহযোগী হিসেবে কাজ করত।

৬ষ্ঠ দল- ফিদায়ী বা আত্মোৎসর্গী- এরা ছিল প্রকৃত গুপ্তঘাতক৷ এই দলের অধীনে ছিল এক বিশেষ কিলার সেল।

আলামুত দুর্গঃ গুপ্তঘাতকের ঘাটি

ঈগলের বাসা বলে খ্যাত আলামুত দুর্গ ছিল গুপ্তঘাতকদের আবাসভূমি। এই দুর্গ ছিল একাধারে দুর্ভেদ্য এবং নয়নাভিরাম। ১০৯০ খ্রিস্টাবে হাসান বিন সাবাহ সমুদ্রপৃষ্ঠের ১০,২০০ ফুট উঁচুতে নির্মাণ করেন এই দুর্গ। হাসান বিন সাবাহ তার দরবারে ১২ থেকে ২০ বছর বয়সী বেশ কিছু যুবককে রাখতেন। এদেরকে তিনি দুর্গের অনিন্দ্যসুন্দর বাগানে নিয়ে যেয়ে হাসীস খাইয়ে মাতাল করে তুলতেন। তারপর তারা যখন বোধশক্তি ফিরে পেতো দেখত তারা বাগানের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে এবং তাদের সামনে অপেক্ষমান অনেক সুন্দরী যুবতী। তারপর যখন কাউকে হত্যার প্রয়োজন পড়ত এখান থেকে একজন যুবককে ডেকে নেয়া হত এবং বলা হতো যাও অমুককে হত্যা করে এসো। আলামুত দুর্গের শক্তিমত্তাকে কেন্দ্র করে গুপ্তঘাতকরা উত্তর পারস্য, ফারস, কুজিস্তান, খুজিস্তান পর্যন্ত নিজেদের প্রভাব কায়েম করে ফেলে। হাসান বিন সাবাহর অনুসারীরা এবার সিরিয়া,লেবাননের পার্বত্য অঞ্চলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। সিরিয়ার খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা এবং মুসলিম ক্রুসেডবিরোধীরা দুই পক্ষই গুপ্তঘাতকদের আক্রমণে সর্বদা ভীত থাকত। তারা বিষ প্রয়োগ করে সেলজুক রাজবংশীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাকে হত্যা করে। শাহজাদা থেকে শুরু করে নিজামুল মুলক কেউই তাদের কোপানল থেকে রেহাই পায়নি। মালিক শাহ এদের বিরুদ্ধে দুইটি অভিযান চালালেও দুটিই তারা প্রবল আক্রোশে রুখে দেয়। ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডেও তারা গণরোষের মুখে পড়ে। ১১৪৬ সালে রাইয়ের আব্বাস গুপ্তঘাতকদের হত্যা করে তাদের মাথা দিয়ে পিরামিড তৈরি করেন।

গুপ্তঘাতকদের পতন

১২৫৮ সালে মোঙ্গলদের হাতে বাগদাদ পতনের আগে পশ্চিমাঞ্চলে সামরিক অভিযানের অংশ হিসেবে মোঙ্গল নেতা হালাকু খান গুপ্তঘাতকদের দমন করতে অগ্রসর হোন। ১২৫৬ সালে মোঙ্গল বাহিনী আলামুত দুর্গ অবরোধ করে। গুপ্তঘাতকদের সেই সময়ের নেতা রুকুনুদ্দীন ভাই শাহেনশাহ ও আরো ৩০০ জন অনুচরকে  মোঙ্গলদের কাছে পাঠায়৷ এই দলকে নিরাপত্তা দেয়ার কথা বলে হালাকু খান তাদের হত্যা করেন। এরপর গুপ্তঘাতকদের মনে ভীতির সঞ্চার হয়। রুকুনুদ্দীন আত্মসমর্পণ করেন। হালাকু খান আলামুত এবং লানবাসার নামের দুর্গদ্বয় ধ্বংস করে দিলে গুপ্তঘাতকদের পতন নিশ্চিত হয়। এরপরও ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে সন্ত্রাসী এই গোষ্ঠীটি নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে নিলেও আর কখনো সংগঠিত হতে পারেনি।

তথ্যসূত্র

আব্বাসীয় খিলাফত ও আঞ্চলিক রাজবংশসমূহ- মাহবুবুর রহমান
মধ্যযুগের মুসলিম ইতিহাস- আশরাফউদ্দিন আহমদ

লেখকঃ উবায়দুর রহমান রাজু