ইতিহাস

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি.আই.এ এর পাঁচটি চাঞ্চল্যকর অপারেশন

ইতিহাস বুধবার, ৩০ অক্টোবর ২০১৯ ০৩:৪২:৪১

গোয়েন্দা কাহিনী সবার মনেই ভালো লাগার তালিকায় অন্যতম স্থান করে নেয়। গোয়েন্দা সাহিত্য,উপন্যাস পড়ে অনেকেই এসবের কাহিনীতে রোমাঞ্চিত হন। তবে বাস্তব গোয়েন্দাদের কার্যক্রমও কিন্তু এসব সাহিত্যিক চরিত্র আর অপারেশন থেকে কম না। কখনো কখনো বাস্তব গোয়েন্দা সস্থাদের কার্যক্রম এই সাহিত্যিক কল্পকাহিনীকেও ছাড়িয়ে যায়। তবে এসব সস্থার এসব অপারেশন গোপনে সংঘটিত হয় বলে আমাদের পক্ষ্যে এসব জানা সবসময় সম্ভব হয়ে উঠে না। তবে কখনো কখনো দেখা যায় অপারেশন পরিচালনার পর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর নানা মাধ্যম হতে এসব অপারেশনের বিবরণাদি বেরিয়ে আসে। বিশ্বের নামকরা যে কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে আমেরিকার সি.আই.এ (সেন্ট্রাল ইনভেস্টিগেশন্স এজেন্সি) তার মধ্যে অন্যতম। এই যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমগ্র বিশ্বে একক আদিপত্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে তার অন্যতম অংশীদার হলো এই সি.আই.এ। মার্কিনীদের সকল গোপন অজেন্ডা এই সংস্থার মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করা হয়। যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে শুরু অপর দেশের সরকার পতন ও পছন্দের সরকার কে সে দেশের ক্ষমতায় বসানোর সকল কাজই করে থাকে এই সংস্থা। তবে সব সময় যে তাদের এসব অপারেশন সফল হয় বিষয়টি এমন নয়। অর্থাৎ তাদের সফল ও ব্যর্থ দুই ধরনেরই অপারেশন রয়েছে। তাদের এসব অপারেশন্স সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি। তাদের এমনই চাঞ্চল্যকর পাঁচটি অভিযান সম্পর্কে অল্পবিস্তর আলোচনা করা হলো।


১. অপারেশন ফিনিক্স প্রোগ্রাম

সিআইএ এর চালানো অপারেশন গুলোর মধ্যে অপারেশন ফিনিক্স প্রোগ্রাম অন্যতম। স্নায়ুযুদ্ধ কালীন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সামরিক ও গোয়ান্দা সকল শক্তি নিয়োগ করে সেখানে। আর সিআইএ তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করার জন্য এক জগন্য পরিকল্পনার নীলনকশা করেন। এই নকশা অনুযায়ী ১৯৬৫ সালে তাদের এই প্রোগ্রাম শুরু করা হয়। তাদের মুল এজেন্ডা ছিল "ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট অব সাউথ ভিয়েতনাম" বা ভিয়েত কং বাহিনীর মূল অবকাঠামো ধ্বংস করা, তাদেরকে গুপ্তচরবৃত্তির মাধ্যমে ধরে নিষ্ক্রিয় করে দেয় কিংবা হত্যা করা। কেননা তাদের কে এভাবে দুর্বল না করতে পারলে ভিয়েতনাম যুদ্ধে তাদের জেতার কোন সম্ভবনা নাই। ফলে তাদের এই নীলনকশা অনুযায়ী কার্যক্রম শুরু হয় ভিয়েতনামের প্রধান প্রধান বিপ্লবীদের কে টার্গেট করে করে গ্রেপ্তার বা গুম করা শুরু হয়। তারপর তাদের থেকে তথ্য সংগ্রহ ও বিপ্লব পরিকল্পনার বিরোধী অভিযান চালানোর নাম করে বিপ্লবীদের উপর চালানো হয় বর্বর অত্যাচার। তাদের এই অত্যাচারের ধরন সমুহ ছিল -জিহ্বা, যৌনাঙ্গের মতো স্পর্শকাতর অঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দেয়া! মাথা নিচের দিকে করে বারবার পানিতে ডোবানো, দুই হাত পেছনে দিয়ে বেঁধে সিলিংয়ের সাথে ঝুলিয়ে রেখে পেটানো, হাত-পা বেঁধে বন্দীর উপর আক্রমণাত্মক কুকুর ছেড়ে দেয়া।, দিনের পর দিন আটকে রেখে অনাহারে হত্যা করা, কানের মধ্য দিয়ে সরু রড, কাঠ বা এ জাতীয় কিছু প্রবেশ করিয়ে হত্যা করা!

এগুলো ছাড়াও তারা হত্যা, গণহত্যা, গণধর্ষনের মত জগন্যতম কার্যক্রম চালাতে থাকে খোদ ভিয়েতনামের মাটিতেই। তাদের এই ন্যাক্কারজনক অপারেশন ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত চালানো হয়। অর্থাৎ যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পরও ভিয়েতনামে তাদের এই মিশন অব্যাহত থাকে। এই দীর্ঘ সময়ে প্রায় ২৪-৪১ হাজার ভিয়েতনামিজ তাদের এই বর্বর আক্রমনের শিকার হয়।


২. নকল টিকাদান কর্মসূচি

এটি ছিল আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেন কে খুজে বের করার একটি গোপন পরিকল্পনা। সিআইএ এই প্রোগ্রাম টি পরিচালনা করে পাকিস্তানের মাটিতে। এই অপারেশন পরিচালনার পূর্বেই পাকিস্তানী চিকিৎসক শাকিল আফ্রিদি কে তারা মেনেজ করতে সক্ষম হয়। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে শাকিল সিআইএ এর সাথে চুক্তি করে। ফলে তিনি সি আইএ এর নির্দেশমত টিকা কর্মসূচির নাম করে পাকিস্তানী অসংখ্য শিশুর রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেন। উদ্দেশ্য ছিল এসব শিশুর ডিএনএ এর সাথে ওসামা বিন লাদেনের ডিএনএ মিলানো। যদি কোন শিশুর ডিএনএ মিলে যেত তাহলে অতি সহজেই বিন লাদেনের অবস্থান শনাক্ত করা যেত। মুলত বিন লাদেন কে খুজে বের করার জন্যই তারা এই প্রকল্প হাতে নেয়। তবে এই পরিকল্পনায় তারা পুরুপুরি সফল হতে পারেনি। ওসামা বিন লাদেন মারা যাবার পর সি আইএ  এর এই জাল টিকাদানের কথা প্রকাশিত হয়ে যায়। ফলে ডক্টর শাকিল আফ্রিদি কে গ্রেপ্তার করা হয় এবং সি আইএ এর সাথে যোগাযোগ রেখে দেশের সার্বভৌম লঙ্ঘনের অভিযোগে তাকে ৩০ বছরের সাজা দেয়া হয়। এই ঘটনার পর থেকে পাকিস্তানী সাধারণ মানুষ তাদের বাচ্চাদের টিকাদান কর্মসূচি তে যুক্ত করতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।


৩.অপারেশন মারলিন

এটি ছিল ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের বিরুদ্ধে সি আইএ এর একটি গোপন ষড়যন্ত্রমুলক অপারেশন। ইরান যখন তাদের পারমাণবিক প্রকল্পের কাজ শুরু করেন, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন বিল ক্লিনটন তার পরামর্শেই সি আইএ এই পরিকল্পনায় হাত দেন। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা এমন একটি এজেন্ডা হাতে নেন যে ইরানী বিজ্ঞানীদের হাতে একটি ভুল পারমাণবিক মডেল তুলে দেয়া হবে যার ফলে ইরাণের পারমাণবিক প্রকল্প কে নিজ থেকেই ধ্বংস করবেন ইরাণের বিজ্ঞানীরা। তারা তাদের এই অপারেশন সফল করার জন্য একজন রাশিয়ান পারমাণবিক বিজ্ঞানী কে নিয়োগ দেয়া হয় কিন্তু ওই বিজ্ঞানী সি আইএ এর এই গোপন পরিকল্পনার কিছুই জানত না। ফলে তিনি সত্যিকারের একটি উন্নত পারমাণবিক মডেল প্রনয়ন করে দেন। কিন্তু এটি ইরাণী বিজ্ঞানীদের হাতে যাওয়ার পূর্বেই সি আইএ এর গোপন স্পাইদের দ্বারা মডিফাই হয়ে যায়। অর্থাৎ তারা ইচ্ছাকৃত কিছু ভুল ঢুকিয়ে দেয়। যখন তা ইরাণী বিজ্ঞানীদের হাতে যায়। তখন তারা কিভাবে যেন ঐ রাশিয়ান নকশাকারী বিজ্ঞানীর সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে ফেলেন। ফলে তার মডেলের ভিতরের ভুলগুলো ইরাণী বিজ্ঞানীরা জেনে যায়। ফলে সি আইএ এর এই মিশন ব্যর্থ হয় এবং ইরাণ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বদলে বরং উপকৃত হয়ে যায়।

৪.অপারেশন মকিংবার্ড

স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মার্কিনপন্থী পুঁজিবাদী জোট ও সোভিয়েত পন্থী কমিউনিজম জোটের মধ্যে আদিপত্য বিস্তার কে কেন্দ্র করে প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। এই প্রতিযোগিতার দৌড়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেশ কয়েকটি প্রকল্প হাতে নেয় এর মধ্যে অন্যতম একটি গোপন প্রকল্প ছিল অপারেশন মকিংবার্ড। যেটি সি আইএ কর্তৃক পরিচালিত হয়। তাদের মুল অজেন্ডা ছিল সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের পিছনে ইনভেস্টমেন্ট করে কমিউনিজম বিরোধী প্রোপাগান্ডা ছড়ানো এবং গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদের পক্ষে ইতিবাচক প্রচারনার মাধ্যমে মানুষের কাছে তা গ্রহণযোগ্য করে তোলা। এজন্য প্রায় ২৫ টি সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থার পিছনে বিপুল পরিমান অর্থ বিনিয়োগ করা হয়। ঘুষ ও লবি নিয়োগের জন্যই এর সিংহভাগ অর্থ লগ্নি করা হয়। এই অর্থ ব্যয়ের বার্ষিক পরিমান ছিল প্রায় ২৩৫ মিলিয়ন। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে তাদের এই অপারেশন চলতে থাকে। এই দীর্ঘ সময়ে সি আইএ এর হাত দিয়েই প্রায় ৩বিলিয়ন খরচ হয় এই প্রকল্পের পেছনে । সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর তাদের এই গোপন অপারেশন আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হয়।


৫. অপারেশন কেওস

এটি ছিল সি আইএ এর নিজ দেশে চালনো অন্যতম একটি অপারেশন। ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত এই অপারেশন পরিচালনা করা হয়। এই অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানা ছাত্র ও তরুন সংগঠনের নানা আন্দোলনের পেছনে কোন বিদেশী মদদ আছে কিনা তা খুজে বের করা। বিশেষ করে যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলন ও বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনকারীদের সন্দেহের তালিকার প্রথম দিকে রাখা হয়। তাদের সাত বছরব্যাপী চালানো এই অভিযানে ১ হাজার সংগঠনের প্রায় ৩লক্ষ নেতা কর্মীর বিরুদ্ধে তদন্ত করা হয়। এই সময়ে প্রায় ৭হাজার নেতা কর্মীর তালিকা করা হয় যাদের কে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তাছাড়া অসংখ্য নেতা কর্মীকে গ্রেপ্তার করে তাদের গোপন আস্তানায় নিয়ে জিজ্ঞেসবাদ করা হয় এবং অনেক কে মিথ্যা মামলায় গেপ্তার দেখিয়ে জেলে পাঠানো হয়। তাছাড়া অনেক কে নির্যাতন করে হত্যাও করা হয়। এই হত্যার সংখ্যা ডজন খানেক ছাড়িয়ে গেছে বলে অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেন।


তথ্যসূত্র

১.https://allthatsinteresting.com/operation-mockingbird

২.http://bangladoor.blogspot.com/2014/12/cia.html?m=1

৩.https://www.elitedaily.com/news/politics/the-craziest-cia-operations-that-the-government-doesnt-want-you-to-know-about

৪.https://www.google.com/amp/s/listverse.com/2013/05/25/10-dirty-secret-cia-operations/amp/


লেখকঃ ফরিদ মোল্লা