
ফকির সন্ন্যাসী আন্দোলনঃ ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফকির সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহ
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে অস্তমিত হয় বাংলার স্বাধীনতার সূর্য। পলাশীর যুদ্ধে বাংলার মানুষের রক্তের দাগের ওপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠা করে ইংরেজ শাসন। পলাশীর যুদ্ধের অব্যবহিত পরে ক্ষমতার রশি ইংরেজদের হাতে দিয়ে পুতুল শাসকরূপে অধিষ্ঠিত হোন মীর জাফর। মীর কাসিম ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কিছুটা প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে চাইলেও বেলাশেষে তিনিও পরাজিত হোন এবং ব্রিটিশরা তথা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষের হর্তাকর্তারূপে আবির্ভূত হয়। অর্থ্যাৎ ক্ষমতা আপাতদৃষ্টিতে ইংরেজদের হাতে চলে যায়। প্রায় ২০০ বছরের শাসনে ব্রিটিশদের মোকাবেলা করতে হয়েছে অনেক বিদ্রোহ, ঘাম ঝরাতে হয়েছে অনেকবার। ঊনিশ শতকের ষাটের দশকে শুরু হওয়া ফকির-সন্ন্যাসী আন্দোলনের কথা জানব আজ।
তৎকালীন সময়ে মুসলিম ফকির এবং হিন্দু সন্ন্যাসীরা জমিদার, গোত্র-প্রধান, সামন্তদের কাছ থেকে অনুদান হিসেবে টাকা, দ্রব্যাদি ভোগ করত। ঐ সময়ে এটা ছিল একটি অলিখিত রীতি বা নিয়ম। প্রভাবশালী এসব লোক নিজেদের সামাজিক উন্নতির ধারা বজায় রাখতে ফকির সন্ন্যাসীদের জন্য এ অনুদান অব্যাহত রাখতেন। এসব সাহায্য প্রদান বা গ্রহণ ফকির- সন্ন্যাসীদের প্রাপ্য হিসেবেই ধরা হত। ইংরেজ সরকার এ কাজকে ভাল চোখে দেখত না। এ অনুদান প্রদানকে তারা অবৈধ হিসেবেই গণ্য করত।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দিওয়ানী লাভ করলে জমিদার, গোত্র-প্রধানদের উপর করের বোঝা বেড়ে যায়। যার ফলশ্রুতিতে জমিদাররা ফকির সন্ন্যাসীদের অনুদান দিতে গড়িমসি শুরু করে এবং সে সুযোগে কোম্পানি সরকার ফকিরদের অনুদান গ্রহণকে বেআইনী ঘোষণা করে।
ফকির-সন্ন্যাসীদের অস্তিত্বের লড়াইয়ের শুরুটা এখানেই।
ইংরেজ সরকার কখনোই এ বিদ্রোহকে বিদ্রোহ হিসেবে আখ্যায়িত করেনি। ওয়ারেন হেস্টিংসের কথায় এর প্রমাণ পাওয়া যায়, তিনি বলেন,
“এটা কোন আন্দোলন বা বিদ্রোহ নয়, এটা নিছক হিন্দুস্তানি যাযাবরদের দস্যুতা ছাড়া আর কিছুই না”
বিদ্রোহী ফকিররা ছিল মুসলিম সূফী তরিকার অনুসারী। তাঁদেরকে ফকির মাদারি’ও বলা হত। হিন্দু সন্ন্যাসীরা ছিল বেদান্তীয় হিন্দু যোগী। সূফী ও সন্ন্যাসীদের ধর্মীয় আদর্শিকতা ও আধ্যাত্মিকতার সাদৃশ্য থাকার কারনে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তারা বীরবিক্রমে বিদ্রোহের পতাকা উড়িয়ে কোম্পানি শাসকদের কপালে ভাঁজের সৃষ্টি করে। ১৭৬০ সালে শুরু হওয়া বিদ্রোহ নব্বই দশকে স্তিমিত হয়ে ঊনিশ শতকের প্রথমভাগে সমাপ্তির রেখা অংকন করে।
ফকির- সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ফ্রন্টম্যান ছিলেন ফকির মজনু শাহ যিনি মজনু শাহ বুরহানা বা মজনু ফকির নামেও পরিচিত। মজনু শাহের সহযোগী হিসেবে এ বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন চেরাগ আলী শাহ, করিম শাহ, পরাগল শাহ প্রমুখ।
পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত সৈনিক জনৈক ব্রাক্ষ্মন ভবানী পাঠক, জমিদার দেবী চৌধুরানী পর্দার আড়ালে বিদ্রোহীদের অনুপ্রেরণা দিতে থাকেন। দেশের কৃষকগোষ্ঠীও এ আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানায়। ১৭৬০ সালে সীমিত পরিসরে এ বিদ্রোহ শুরু হয়, যা ১৭৬৩ সালে চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। এসময় কোম্পানি শাসকের অনুগত জমিদারদের বাসভবন, কোম্পানির কুঠিকে লক্ষবস্তু করে হামলা চালায় বিদ্রোহীরা। আক্রমণে ব্যবহার করা হয় বর্শা, বন্দুক, তরবারি এবং ঘূর্ণায়মান কামান। তাঁরা বিভিন্ন স্থানে কোম্পানি অনুগত লোকদের উপর চোরাগুপ্তা হামলা চালায়। বিদ্রোহীদের একটি গ্রুপ গেরিলা আক্রমনেও নেতৃত্ব দেয়।
সত্তরের দশকে ফকির ও সন্ন্যাসীদের সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এই সম্মিলিত ধর্মীয় ভবঘুরে গোষ্ঠী ইংরেজ সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দেয়, কোম্পানি শাসকদের তাঁরা এতটাই ব্যতিব্যস্ত করে রাখে যে, অত্যাধুনিক সব অস্ত্রসস্ত্র দিয়েও ফকির বিদ্রোহীদের টিকির নাগাল পায়নি ইংরেজ বেনিয়া শাসক।
উপরন্তু গ্রাম্য লোকেরা বিদ্রোহীদের পক্ষে গুপ্তচর হিসেবে কাজ করত যার ফলে বিদ্রোহীরা আগেভাগেই সব খবর জেনে যেত। ১৭৬৩ সালে বিদ্রোহীরা রোমাঞ্চকর এক অভিযান পরিচালনা করে। আকস্মিক এক আক্রমণে তারা ঢাকা কুঠি দখল করে। কুঠির ইংরেজ কেয়ারটেকার পালিয়ে যান। ঢাকা কুঠি আক্রমণ নিয়ে রমনা কালীমন্দিরের মারাঠি সাধুর ভাষ্যমতে, বিদ্রোহীরা বন্দে মাতরম ধ্বনি তুলে কুঠি আক্রমণ করে। একই বছর রাজশাহীর একটি কুঠিতে অভিযান চালিয়ে কুঠির কেয়ারটেকার বেনেটকে আটক করে এবং ধৃত বেনেটকে পাটনায় নিয়ে হত্যা করে।
১৭৬৭ সালের দিকে আন্দোলন তীব্র রূপ ধারণ করে। বিদ্রোহীদের সমুচিত শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে রংপুরে ইংরেজ সরকার একটি বাহিনী প্রেরণ করে এবং এ যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনীর প্রধান মার্টল বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হোন। ১৭৭১ সালে ইংরেজ সরকার প্রকাশ্যে দেড়শ জন ফকির- সন্ন্যাসীকে প্রকাশ্যে হত্যা করলে মজনু শাহ নাটোরের রাণী ভবানীর কাছে পত্রযোগে সাহায্য চান যদিও রাণীর কাছ থেকে কোন সাড়া মেলেনি।
১৭৭২ সালে মজনু শাহের নেতৃত্বে ফকির-সন্ন্যাসীরা রাজশাহী ও রংপুরে কোম্পানির বাণিজ্যকেন্দ্রে লুন্ঠনকার্য পরিচালনা করে। এমনকি মজনু শাহ কিছুসংখ্যক অনুচর সাথে নিয়ে কোম্পানির রাজস্ব অফিস কিছুক্ষণের জন্য দখল করে রাখেন। যার হেতু সেখানকার যাবতীয় অর্থ ফকিরদের হস্তগত হয়।
১৭৭৬ সালে ফকির- সন্ন্যাসীদের দোর্দণ্ড প্রতাপ পরিলক্ষিত হয়। একই সালে মজনু শাহ জনবল সংগ্রহ করতে উত্তরবঙ্গ আসলে ইংরেজ সরকার ভয়ে এতটাই মুহ্যমান হয় যে, দিনাজপুর জেলার রাজস্ব আয় একটি সুরক্ষিত ঘাটিতে স্থানান্তর করে ফেলে।
১৭৮৫ সালে ফকির মজনু মহাস্থানগড়ে এক যুদ্ধে পরাজিত হোন। তার এক বছর পর ১৭৮৬ সালের ৮ ডিসেম্বর কালেশ্বরে লেফটেন্যান্ট সেনানের সাথে যুদ্ধে অনেক ফকির-সন্ন্যাসী নিহত হোন। এ ঘটনার পর ফকির মজনুর মনোবল ভেংগে পড়ে এবং পরবর্তীতে তাঁকে আর কোন যুদ্ধে অংশ নিতে দেখা যায়নি। ধারণা করা হয় ১৭৮৬ বা ১৭৮৭ সালের দিকে ফকির মজনু মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পরেই এ আন্দোলন তার প্রাণ হারায় এবং ঊনিশ শতকের শুরুতে তার সমাপ্তি ঘটে।
লেখকঃ উবায়দুর রহমান রাজু