ইতিহাস

প্রথম আফিম যুদ্ধ : চীনের মাটিতে ইংরেজদের প্রভাব বিস্তারের সূচনা পর্ব

ইতিহাস সোমবার, ২৮ অক্টোবর ২০১৯ ০২:৩৪:২৬

ইউরোপে শিল্পবিপ্লবের পর থেকে ইংরেজরা তাদের বানিজ্য কে সারা পৃথীবি ব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার জন্য এজেন্ডা গ্রহণ করেন। প্রথম দিকে শুধু মাত্র বানিজ্যিক মুনাফা লাভ করাই তাদের মূখ্য উদ্দেশ্য হলেও পরবর্তীতে তারা এই বানিজ্যিক পথ ধরেই উপনিবেশ কায়েমের পন্থা কে প্রধান রূপ দিতে মরিয়া হয়ে যায়। বানিজ্যিক পথকে সুগম করতে গিয়ে রাজনৈতিক হস্থক্ষেপের যে প্রয়োজন দেখা দেয় তার চুরান্তরূপই ছিল উপনিবেশবাদ। তবে সব ক্ষেতে যে তারা তাদের এই এজেন্ডা কে সফলভাবে কাজে লাগাতে পেরেছে বিষয়টি এমন নয়। কখনো কখনো তারা তাদের এই বানিজ্যিক পথ কে সুগম করার জন্য নানা হিন ও যড়যন্ত্রমূলক পদক্ষেপেরও আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। তারই একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো চীনের সাথে ইংরেজদের আফিম যুদ্ধ। চীনের যুব সমাজ কে ধ্বংস ও চীনের উপর ইংরেজদের আদিপত্য বিস্তার করার লক্ষ্যে ইংরেজরা যে পদক্ষেপ গ্রহণ করে তারই ফল স্বরূপ প্রথম আফিম যুদ্ধ সংগঠিত হয়।

পনের শতকের দিকে ইংরেজরা তাদের বানিজ্যিক পন্যসমুহ সমগ্র পৃথিবী ব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। কিন্তু শিল্পবিপ্লবের পর থেকে তাদের এই গতি আরও বৃদ্ধি পায়। তারা তাদের পন্য বিক্রি করার জন্য নতুন নতুন বাজারের সন্ধান করতে থাকে। ফলশ্রুতিতে তারা একটি বৃহৎ বাজার হিসেবে এশিয়া মহাদেশ কে টার্গেট করে। অনেক ক্ষেত্রে সফলও হয়। কিন্তু সমগ্র এশিয়া ব্যাপী তাদের আদিপত্য বিস্তার করা ছিল কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এমনই একটি অঞ্চল ছিল চীন। চীনে তারা বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও যখন তাদের পন্য নিয়ে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারেনি। তখনি তারা চীনের ব্যাপারে এক হটকারী নীতি গ্রহণ করে। তারা দেখল যে চীনে আফিমের অল্পবিস্তর ব্যাবহার আছে। তাই তারা তুরস্ক ও আরব অঞ্চল থেকে আফিম নিয়ে এসে এ অঞ্চলে বিক্রি করতে থাকে। তখনকার যুগে ঔষুধ হিসেবে চীন-জাপানে আফিম ব্যাবহৃত হতো। মুলত ব্যথানাশক ঔষুধ হিসেবে এটি প্রসিদ্ধ ছিল। কিন্তু ইংরেজরা এটি চীনে আমদানি করার সাথে সাথে নতুন নতুন ভোক্তা তৈরি করার কাজে হাত দেয়। অর্থাৎ তারা চীনের সাধারন তরুন ও যুবকদেরকে মাদক হিসেবে এটির ব্যাবহারে অভ্যস্ত করে তোলে। ফলে দ্রুত সময়ের মধ্যে চীনে এটির বিস্তার ঘটে এবং আমদানি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে।

চীনের তৎকালীন সম্রাট চিয়া চিং এই আফিমের ভয়াবহতার কথা আচ করতে পেরে চীনে আফিম আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। বন্দরগুলোতে কড়া নিরাপত্তা বসানোর আদেশ দেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও আফিমের আমদানি ঠেকানো সম্ভব হয় নি। কেননা কছু অসাধু চীনা ব্যবসায়ী ইংরেজদের সাথে হাত মিলিয়ে চোরাই পথে আফিম আমদানি করতেন এবং তাদের কে সাহায্য করতো কিছু অসাধু চীনা কর্মকর্তা। ফলে ১৮০০ সালে যেখানে আফিমের আমদানির পরিমাণ ছিল মাত্র ২ হাজার পেটি মাত্র ৩০ বছরের মধ্যে তা ৪০ হাজার পেটি ছাড়িয়ে যায়। এতেই অনুমান করা যায় কি হারে চীনারা আফিমে আসক্ত হয়ে পড়েছিল। যুবক,তরুন ও সামরিক বাহিনীর মধ্যেই এই আসক্তের পরিমান ছিল অধিক। ফলে চীনের অর্থনীতি ও যুবসমাস ধ্বংসের চুরান্ত পর্যায়ে পৌছে যায়। তা থেকে চীন কে উত্তরনের জন্য সম্রাট আফিম আমদানির প্রধান পথ ক্যান্টন বন্দরে লিন-সুন-সে নামক একজন দক্ষ প্রশাসক কে নিয়োগ দেন। তিনি আফিম আমদানি ও চোরাচালান রোধ করার জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সেগুলো হলো -কোনো বিদেশী যুদ্ধজাহাজ চীনে প্রবেশ করতে পারবে না, বিদেশী ফ্যাক্টরিগুলিতে কোন বন্দুক বা অস্ত্রসস্ত্র রাখা চলবে না, বিদেশীদের সমস্ত জাহাজ চীনে রেজিষ্ট্রি করাতে হবে,প্রতিটি বিদেশী ফ্যাক্টরিতে চীনা ভৃত্যের সংখ্যা বেঁধে দেওয়া হবে।

এসব পদক্ষেপের পরও আশানুরূপ সফলতা না পেয়ে ১৮৩৯ সালে ক্যান্টনে এক অভিযান চালান। এই অভিযানে ক্যান্টনে যতগুলো ইংরেজ কুটি ছিল তার সবগুলো অবরোধ করা হয় এবং সেখান থেকে প্রচুর পরিমাণ আফিম জব্দ করা হয়। এবং এসব আফিম পুড়িয়ে দেয়া হয়। এতে ইংরেজ বাহিনীদের প্রভুত ক্ষতি সাধিত হয়। এতে ইংরেজরা ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। ফলে এই ঘটনা কে পুজি করে এবং আরও কয়েকটি ছোট ঘটনার ছুতা ধরে ১৯৩৯ সালে ইংরেজ এডমিরাল ইলিয়টের নেতৃত্বে একটি প্রশিক্ষিত বাহিনী চীনে আক্রমন করে। এই আক্রমন প্রতিহত করার জন্য সম্রাট ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরন করেন। ফলে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধের সূচনা হয়। এই যুদ্ধ ১৯৪২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩ বছর চলে। কিন্তু চীনা সামরিক বাহিনীর দুর্বলতা, সৈন্যদের আফিম আসক্তি ও চীনা সেনাপতির দুরদর্শিতার অভাবে চীনা বাহিনী ইংরেজদের নিকট পরাজিত হয়।

এই সময়ে ইংরেজদের মাত্র ৫০০ সৈন্য নিহত হয়। কিন্তু অপরদিকে চীনাদের প্রায় ২০ হাজার সৈন্য প্রাণ হারায়। ফলে চীনারা বাধ্য হয়ে ইংরেজদের সাথে এক অপমান জনক ও ইংরেজদের সার্থকামী এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। যা নানকিং চুক্তি হিসেবে পরিচিত। এই চুক্তি অনুযায়ী হংকং দ্বীপ ব্রিটেনের অধিকারভুক্ত হয়, চীন ক্ষতিপূরণ বাবদ ইংরেজ সরকারকে 21 মিলিয়ন ডলার দিতে সম্মত হয়, চীনের ক্যান্টন, অ্যাময়, ফুচাও, নিংকো এবং সাংহাই বন্দরগুলি ব্রিটিশ বণিকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়, কো-হং বণিকদের একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার বাতিল করা হয়, সর্বোপরি স্থির হয় যে, চীন বিদেশী পণ্যের উপর নির্দিষ্ট পরিমাণ শুল্ক ধার্য করবে| তবে সন্ধি পত্রে আফিম সংক্রান্ত কোন শর্তের উল্লেখ করা হয়নি। এই চুক্তির ফলে ইংরেজ পন্যে চীনের বাজার ছেয়ে যায়। অপরদিকে চীনের নিজেদের পণ্য ব্যাপকভাবে হুমকির মুখে পড়ে এবং তাদের অর্থনীতিতে ধস নেমে আসে। একই সাথে এই অঞ্চলে ইংরেজরা শক্তিশালী হয়ে পড়ে। যার উপর ভর করেই পরবর্তীতে দীর্ঘদিন ধরে চীনের আশেপাশের অঞ্চলে আদিপত্য ও উপনিবেশ বিস্তার করতে সক্ষম হয়।

তথ্যসূত্র
১.https://www.alivehistories.com/2019/09/first-opium-war-in-bengali.html?m=1

২.http://netversity.blogspot.com/2013/04/blog-post_1404.html?m=1

৩.https://www.google.com/amp/s/mongsing.wordpress.com/2018/03/17/%25E0

৪.https://www.charpoka.org/2018/12/07/opium-war/
লেখকঃ ফরিদ মোল্লা