
ভার্সাই চুক্তিঃ শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যার্থ চুক্তির সমালোচনা ও ফলাফল
জার্মান সরকার যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসনকে ১৯১৮ সালের অক্টোবরের মাসে একটি সাধারণ যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায়। এর প্রেক্ষাপটে উড্রো উইলসন তার বিখ্যাত চৌদ্দ দফা পেশ করেন যাকে সঠিক শান্তির একমাত্র উপায় হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এরমধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দফা ছিল জার্মানির কাছে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত সকল মিত্রপক্ষের ক্ষতিপূরণ দাবী। এর মধ্যে নয়টি দফা ছিল নতুন রাষ্ট্রীয় প্রেষিতক বিষয়ে। বেশ কয়েকটি গোপন চুক্তির কারণে এই দফাগুলোর ধারণা জটিল আকার ধারণ করেছিল। এর মধ্যে আছে যুদ্ধের শেষ বছরগুলোতে গ্রিস এবং রুমানিয়ার সাথে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং ইতালির সম্পাদিত চুক্তিসমূহ।
১৯১৯ সালের বসন্তে প্যারিসে অনুষ্ঠিত প্যারিস শান্তি সম্মেলনে চুক্তির খসড়া করা হয়। খসড়ার মূল নকশা করেন চারজন নেতা যারা ইতিহাসে বিগ ফোর হিসেবে খ্যাত। এরা হলেন বৃটেনের ডেভিড লয়েড জর্জ, ফ্রান্সের জর্জেস ক্ল্যামেনকু (Georges Clamenceau), যুক্তরাষ্ট্রের উড্রো উইলসন এবং ইতালির ভিটোরিও অরল্যান্ডো। মূলত প্রথম তিনজনই নকশা তৈরি করেন। কোন পরাজিত জাতি চুক্তির খসড়া তৈরিতে কোন ভূমিকা রাখতে পারেনি, এমনকি মিত্রশক্তির সহযোগী জাতিসমূহেরও তেমন উল্লেখযোগ্য কোন ভূমিকা ছিলনা। ২৮ জুন তারিখেই এই চুক্তি অনুমোদিত হয়। কিন্তু এতে উপস্থিত জার্মান প্রতিনিধিদল অসন্তোষ প্রকাশ করে, কারণ তাদের মতে এতে সম্মেলন চলাকালে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহের ব্যত্যয় হয়েছে এবং মূল সমস্যা ছিল এই যে এই চুক্তিতে জার্মানিকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এর জন্যে ভার্সাই চুক্তির ব্যাপক সমালোচনার মুখেও পরতে হয়েছে। জার্মানির উপর বিজিত দেশ গুলোর জবরদস্তি চাপিয়ে দেয়ার ফলে জার্মানি অর্থনৈতিকভাবে ও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন।। চলন জেনে নেই ভার্সাই চুক্তির সমালোচনা ও তার ফলাফল।
ভার্সাই চুক্তির সমালোচনাঃ
ভার্সাই চুক্তি আধুনিক কালের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কমূলক বিষয়। জার্মান জাতি এটিকে 'Dictated peace' বা বিজিতের উপর বিজেতার জবরদস্তি মূলক চাপানো শান্তিচুক্তি ও জার্মানির সর্বস্ব হরণের চুক্তি বলে মনে করে।
ভার্সাই চুক্তিতে সরাসরি জার্মানির বিরুদ্ধে ইউরোপীয় শক্তিবর্গের ও ইউরোপীয় জনগণের তীব্র অসন্তোষ ও ঘৃণার সুস্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়। এ চুক্তির মাধ্যমে মিত্রশক্তির অক্ষশক্তির প্রতি বিরুদ্ধ মনোভাব স্পষ্ট আকারে ফুটে উঠে।
সন্ধিপত্র স্বাক্ষরিত হতে বিজয়ী ও পরাজিত উভয় পক্ষের সম্মতির প্রয়োজন হয়। কিন্তু ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে জার্মানির কোন মতামত নেয়া হয়নি। জার্মানিকে শর্তহীন ভাবে চুক্তিপত্রের শর্তগুলো মেনে নিতে বাধ্য করা হয়েছিলো। জার্মানি চুক্তিপত্রে আপত্তি জানালেও তা নিঃশর্তে মেনে নেয়ার জন্য জার্মানিকে ভীতি প্রদর্শন করা হয়, আবার যুদ্ধের হুমকিও দেয়া হয়। তাই জার্মানি নিঃশর্তে চুক্তি পত্রে লিখিত সব শর্ত মেনে নেয়।
ভার্সাই চুক্তির আগে উড্রো উইলসনের চোদ্দ দফায় প্রত্যেক দেশকে অস্ত্র ও যুদ্ধের সরঞ্জামাদি হ্রাস করার কথা বলা হয়। অথচ ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে শুধুমাত্র জার্মানিকে অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম হ্রাস করতে বাধ্য করা হয়।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত জার্মানির স্বার্থের দিকে না তাকিয়ে তাদের উপর ক্ষতিপূরণের বিশাল বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়। নৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পঙ্গু জার্মানির শিল্প বাণিজ্য ধ্বংস করার পাকাপাকি বন্দোবস্ত করা হয় এ চুক্তির মাধ্যমে। অপরদিকে তাদের উপরই আবার বিশাল ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়। এ যেন হাঁসকে উপবাসী রেখে তার কাছ থেকে সোনার ডিম আদায় করার মত।
ভার্সাই চুক্তির ফলাফলঃ
Germany was punished, disarmed and humiliated। ১ম বিশ্বযুদ্ধের পর ভার্সায় চুক্তির মাধ্যমে জার্মানিকে সম্পূর্ণরূপে পঙ্গু করে দেয়া হয়। একটি শক্তিশালী ও আন্তর্জাতিক মর্যাদা সম্পন্ন দেশকে পূর্বে কখনো এভাবে পদানত করার দৃষ্টান্ত দেখা যায় না। স্বভাবতই এ চুক্তি মেনে নেয়া জার্মানির পক্ষে অসম্ভব ছিলো।
চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার বছরেই জার্মানিতে নাৎসি বিপ্লবী পার্টির অভ্যুদয় ঘটে। নাৎসি দল দ্ব্যার্থহীন ভাষায় ভার্সাই চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ১ম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয়ে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। জার্মানির গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত এবং ফ্যাসিবাদী হিটলারের অভ্যুদয়ের পেছনে এই ভার্সাই চুক্তির সরাসরি কার্যকরী ভূমিকা রয়েছে। এই অসন্তোষকে মূলধন করে নাৎসি প্রধান হিটলার ভার্সাই চুক্তিকে অস্বীকার করেন এবং পরবর্তীকালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করেন।
ভার্সাই চুক্তি সম্পর্কে ঐতিহাসিক Riker মন্তব্য করেছেন, It's greatest condemnation is that it contained within it the germs of a Second World War. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই রোপিত হয়েছিলো ভার্সাই চুক্তিতেই। ফলে ইউনাইটেড নেশানের মত শান্তি স্থাপনকারী আন্তর্জাতিক সংগঠন গুলো নিরূপায় হয়ে পড়েছিলো। ভার্সাই চুক্তিই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে অনিবার্য করে দিয়েছিলো।
সূত্রঃ
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস (অধ্যাপক কে. আলী)
https://www.historynet.com/failed-peace-treaty-versailles-1919.htm
লেখকঃ এস এম সজীব