ইতিহাস

ইতিহাসের স্মরণীয় ব্যর্থ অভ্যূত্থানের গল্প- পর্ব ১

ইতিহাস মঙ্গলবার, ০৯ জুলাই ২০১৯ ০৫:৩৮:৫৪

দেশের সরকারের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে অনেক সময় সংশ্লিষ্ট দেশের সেনাবাহিনী অভ্যূত্থান করে বসে। কখনো কখনো দেশপ্রেমের ব্রত নিয়ে এগিয়ে আসলেও অনেক সময় কিছু অফিসারের উচ্চাভিলাষী নীতির কারণেও এসব অভ্যূত্থান সংগঠিত হয়। অজস্র সফল অভ্যূত্থানের পাশাপাশি ইতিহাস সাক্ষী হয়েছে বেশকিছু ব্যর্থ অভ্যূত্থানেরও। অভ্যূত্থানকারীদের অপরিপক্বতা, সরকারের চতুরতা কিংবা জনগণের অসহযোগিতা অভ্যূত্থানকারীদের ব্যর্থদের খাতায় নাম লিখিয়ে দেয়। ইতিহাসের এমন কিছু ব্যর্থ অভ্যূত্থানের আদ্যোপান্তই আজকের আলোচনা।

তুরস্কের ব্যর্থ অভ্যূত্থান (জুলাই, ২০১৬)

২০১৬ সালের ১৫-১৬ জুলাই তুরস্কের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব অভ্যূত্থান প্রচেষ্ঠা সংগঠিত হয়। তার্কি শান্তি পরিষদ নামের সংগঠনকে এই অভ্যূত্থান প্রচেষ্টার জন্য দায়ী করা হয়। জুলাই মাসের এই অভ্যূত্থান তুরস্কের ইতিহাসে বিশেষভাবে স্মরণীয়। তুরস্কের নির্বাচিত রিসেপ তাইপ এরদোয়ানের সরকারের পক্ষে এসময় দেশের জনগণ রাস্তায় নেমে এসে অভ্যূত্থান প্রতিহত করে। সেদিন রাতে বিদ্রোহী সেনারা রাজধানী আংকারা ও ইস্তাম্বুল শহর কিছু সময়ের জন্য দখল করে নেয়। দেশের টেলিভিশনগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তারা সেগুলোর সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়। এমন অস্থির সময়ে দেশের   প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান অবকাশ যাপনের জন্য রাজধানীর বাইরে অবস্থান করছিলেন। বিদ্রোহী সেনাদের মূল লক্ষ্য ছিল এরদোয়ানকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেয়া। কিন্তু সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসারদের অসহযোগিতা তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ইস্তাম্বুলের কামাল আতাতুর্ক বিমানবন্দরে এক ভিডিও বার্তায় এরদোয়ান দেশের জনগণকে রাস্তায় নামার আহ্বান জানিয়ে সরকারের নিয়ন্ত্রণ বজায় আছে বলে ঘোষণা দেন। মুহূর্তের মধ্যে দৃশ্যপট পাল্টাতে যেতে শুরু করে। জনগণ রাস্তায় নেমে অভ্যূত্থান বিরোধী শ্লোগান দিয়ে সেনাদের ট্যাংক দখল করে নেয়। ততক্ষণে বিদ্রোহীরা কোণঠাসা হয়ে গেছে। তুরস্কের সরকার জনগণকে সাথে নিয়ে এই অভ্যূত্থান সফলতার সাথে ব্যর্থ করে দেয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই অভ্যূত্থান প্রচেষ্টার নিন্দা করা হয়। এরদোয়ান এই অভ্যূত্থানের পেছনে মার্কিনপন্থী ধর্মীয় নেতা ফেতুল্লাহ গুলেনকে দায়ী করেন। গুলেন তা অস্বীকার করেন।

ইথিওপিয়ার ব্যর্থ অভ্যূত্থান, ১৯৬০

প্রথম হেইল সেলাসি নাম নিয়ে ১৯৩০ সালে ইথিওপিয়ার শেষ সম্রাট হিসেবে অভিষেক হয় রাস তাফারির। ক্ষমতায় আরোহন করে সেলাসি পূর্বতন রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে উদ্যোগী হন। ইথিওপিয়াকে আধুনিক বিশ্বের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে তিনি প্রিন্টিং প্রেস, কার, টেলিফোন এবং আইন ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করেন। এছাড়া শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বৈদেশিক নীতিতে তার সরকার প্রভূত উন্নতি নিয়ে আসে। কিন্তু তার সরকার দেশের প্রচলিত বর্ণপ্রথা লোপ করতে ব্যর্থ হয়। ১৯৫৫ সালে দেশের সংবিধান কাটছাঁট করলে সেনাবাহিনীর একটি অংশের তলে তলে বিদ্রোহ দেখা দেয়। ইথিওপিয়ান ইম্পেরিয়াল গার্ডের কমান্ডার  মেংগিস্তু নিওয়ে এবং তার ভাই জারমেম সেনাবাহিনীর কিছু অফিসারদের সাথে নিয়ে ১৯৬০ সালের ডিসেম্বরে সেলাসির দেশের বাইরে থাকার সুযোগ নিয়ে  রাজধানী আদ্দিস আবাবা দখলের চেষ্টা চালায়। জেনারেল মেংগিস্তুর নেতৃত্বে ইম্পেরিয়াল গার্ডের বিদ্রোহী সেনারা ইথিওপীয় ক্রাউন প্রিন্স এবং একজন সরকারি কর্মকর্তাকে বন্দী করে রাখে। কিন্তু ইম্পেরিয়াল গার্ডের বিদ্রোহীরা এই অভ্যূত্থানকে সফল করতে পারেনি। পরিকল্পনার দুর্বলতা এবং জনগণের অসমর্থন এই অভ্যূত্থান প্রচেষ্ঠাকে ব্যর্থ করে দেয়। সেলাসি দেশে ফিরলে রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ নেন এবং অভ্যূত্থানকারীদের কঠোর শাস্তির আওতায় নিয়ে আসেন।

জাপানের সাম্রাজ্যবাদী গার্ডের অভ্যূত্থান চেষ্টা (আগস্ট, ১৯৪৫)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির কাছে পরাজিত হয়ে জাপান চারদিক থেকে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। জাপানের বিষয়ে ফয়সালা করার জন্য মিত্রশক্তির নেতৃবৃন্দ এক বৈঠকে বসেন। ইতিহাসে এই বৈঠক পোটস্টাম ডিক্লারেশন নামে পরিচিত। এই ঘোষণায় জাপানকে তার সৈন্যদের সাথে নিয়ে মিত্রশক্তি বরাবর শর্তহীন আত্মসমর্পণের জন্য চাপ দেয়া হয়। কিন্তু জাপান এই অপমানজনক সন্ধিতে সাক্ষর না করে উষ্মা প্রকাশ করে৷ জাপানের এমন অবাধ্যতায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হেনরি ট্র‍্যুম্যান ইতিহাসের বর্বরতম এক আদেশ দেন ইউএস মিলিটারিকে৷ আগস্টের ৬ তারিখ জাপানের হিরোশিমা শহরে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে মার্কিন সেনাবাহিনী। নিহত হয় ৮০,০০০ বেসামরিক মানুষ, আহত হয় প্রচুর। একই ভাগ্য বরণ করতে হয় আরেক শহর নাগাসাকিকে। যার ফলে বাধ্য হয়ে সম্রাট হিরোহিতো ও প্রধানমন্ত্রী সুজুকি অপমানজনক আত্মসমর্পণের ব্যাপারে রাজি হয়ে যান। তাদের এমন পদক্ষেপ পছন্দ হয়নি জাপানের সাম্রাজ্যবাদী যোদ্ধার দল ইম্পেরিয়াল গার্ডের। তাদের শংকা ছিল এই চুক্তিতে সাক্ষর করলে জাপানের সাম্রাজ্যবাদী প্রথা ভেস্তে যাবে। আগস্টের ১৪ তারিখ সম্রাট হিরোহিতো যখন প্রকাশ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণের দিবেন তার কয়েক ঘন্টা আগে মেজর কেঞ্জি হাতানাকার নেতৃত্বে ইম্পেরিয়াল গার্ডের সৈন্যরা রাজপ্রাসাদ অবরুদ্ধ করে রাখে এবং বাইরের পৃথিবীর সাথে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। মেজর হাতানকা আর তার সহযোদ্ধারা চেয়েছিলেন সাম্রাজ্যবাদ ব্যবস্থা অক্ষুণ্ন রেখে নতুন আরেকটি সরকার যাতে গঠন করা হয় যার হাল ধরবেন কোন সেনা মন্ত্রী। কিন্তু ততক্ষণে সম্রাট হিরোহিতো তার বক্তৃতা রেকর্ড করে লুকিয়ে রেখেছিলেন। বেলা ১১ টার সময় এই রেকর্ড দেশজুড়ে প্রচার করে দেয়া হয়। আর এরই সাথে ইম্পেরিয়াল গার্ডের সৈন্যরা চরম হতাশ হয়ে পড়ে। মেজর হাতানকা নিজ মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন। অন্যান্যরাও একই পরিণতি বরণ করে নেয়।

তথ্যসূত্র
https://listverse.com/2016/05/02/10-failed-20th-century-coups/
https://www.bbc.com/bengali/news/2016/07/160716_why_did_turkish_coup_plot_fail

লেখকঃ উবায়দুর রহমান রাজু