ইতিহাস

পালমিরাঃ হাজার বছরের পুরনো শহরের ইতিহাস

ইতিহাস মঙ্গলবার, ০৯ জুলাই ২০১৯ ০৫:২৭:৩৭

মধ্যপ্রাচ্যের নিষ্ঠুর যুদ্ধের বলির পাঁঠার এক দেশের নাম সিরিয়া। এত ধ্বংসযজ্ঞ আর বোমাবাজির তোপে দেশটির অস্তিত্ব এখন বিপন্ন। পুরো দেশ যখন একটি ভাগাড়ে পরিণত হয়ে আছে এই শতকে তার ঠিক এক যুগ আগেও সিরিয়া ছিল এক ঐতিহাসিক দেশ-শ্যামদেশ। ইতিহাস ঐতিহ্যে ভরপুর এ দেশের এমনই একটি মূল্যবান শহর ছিল পালমিরা। আইএস জঙ্গীদের হাতে এই ঐতিহাসিক শহর এখন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। হাজার বছরের পুরনো প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা তারা গুড়িয়ে দিয়েছে। ধ্বংস করেছে হাজার-শত বছরের পুরনো মন্দির, থিয়েটার। পালমিরাকে কেন মূল্যবান বলছি তা জানতে হলে আমাদের পেছন ফিরতে হবে। তৃতীয় শতকে পালমিরা ছিল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যকার বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ এক রুট। পালমিরা হয়ে তখনকার রোমান, আরব ব্যবসায়ীরা তাদের কাফেলা নিয়ে যাতায়াত করত। পালমিরা তখন ছিল রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে একটা অঞ্চল। কিন্তু স্বীয় বৈভব আর গুরুত্বে পালমিরা হয়ে উঠছিল অদ্বিতীয়া।

মরুর মুক্তাখ্যাত পালমিরা শহর প্রতিষ্ঠা পেয়েছে খ্রিস্টের জন্মের প্রায় দুই হাজার বছর আগে। প্রথম শতাব্দীতে রোমানদের অধীনে আসার আগ পর্যন্ত পালমিরা বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে শাসিত হয়ে আসছিল। দ্বিতীয় খ্রিস্টাপূর্বাব্দের প্রথম দিকে পালমিরা পরিচিত ছিল তাদমোর নামে। এখনো অনেকেই পালমিরাকে তাদমোর নামে চিনে। ১৯৩২ সালে ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়া সিরিয়ার এ মরু শহর প্রথম শতাব্দীর মধ্যভাগে রোমানদের অধীনে একটি প্রদেশ হিসেবে যখন শাসনে আসে তখন ভারত, চীন আর পারস্যের বাণিজ্যের ঐতিহাসিক সিল্করোড হিসেবে ব্যবহার হতে থাকে। নানান দেশের বণিকদের আগমনে পালমিরা হয়ে উঠে বিশ্বজনীন এক অঞ্চল। গড়ে উঠে চোখ ধাঁধানো স্থাপত্য। শিল্প ও প্রত্নতত্ত্বে সমকালীন অন্য সব অঞ্চলকে ছাড়িয়ে যাওয়া পালমিরা এক সময় রোমান সাম্রাজ্যের বাহুডোর থেকে বেরিয়ে আসে। ইতিহাস বিখ্যাত পালমিরান রাণী জেনোবিয়া পালমিরাকে রোমানদের থেকে আলাদা করে প্রায় রোমান সাম্রাজ্যের সমকক্ষ আলাদা একটি পালমিরান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। রাণী জেনোবিয়ার হাতে পালমিরান সাম্রাজ্যের ভেতরে চলে আসে বর্তমান মিশরও। রোম অধিপতি তখন চেয়ে চেয়ে দেখছেন পালমিরার সমৃদ্ধি কিন্তু কিছুই করতে পারছেন না, এমনই অদ্বিতীয় হয়ে উঠেছিল মরুভূমির মুক্তার এই নগর। ১৯৮০ সালে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে স্থান পাওয়া পালমিরায় গ্রিক, রোমান, পারস্যের আবহ পাওয়া যায় এর স্থাপত্যে। বড় বড় মন্দির, দালান আর রোমান এম্পফিথিয়েটার পালমিরাকে এনে দিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ নগরীর তকমা। ২০১১ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হলে ২০১৩ সালে ইউনেস্কো পালমিরাকে বিপন্ন বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে। এর আগে ১৯৩২ সালে পালমিরার হাজার বছরের ইতিহাস থমকে গেলেও এর ধ্বংসাবশেষ ছিল বিশ্ব ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ দলিল। পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা হাজার বছরের পুরনো এ শহরের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে ইসলামিক স্টেট জঙ্গীদের হাতে। ২০১৫ সালের মে মাসে পালমিরার দখল নেয় আইএস যোদ্ধারা। পরের বছর সিরিয়া সরকার থেকে ইসলামিক স্টেট জঙ্গীদের হটিয়ে দিলেও আবার একই বছর আইএসের হাতে চলে যায় পালমিরা। আর এসময়ই পালমিরার ভাগ্য বিপর্যয় শুরু হয়। আইএস জঙ্গীদের প্রচারিত ভিডিওতে দেখা যায় হাজার বছরের পুরনো মন্দির বড় হাতুড়ি দিয়ে ধ্বংস করছে তারা। রোমান এম্ফিথিয়েটারকে তারা পরিণত করেছে নিজেদের কারাগার ও আদালত হিসেবে। বেল মন্দির, বাল শামিন মন্দির, আর্ক অফ ট্রিয়াম্ফ এর মত ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো আইএস জঙ্গীরা গুড়িয়ে দেয় নিসংকোচে । ২০১৭ তে সিরিয়ান আর্মি পালমিরার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। কিন্তু ততোদিনে যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। নিয়ন্ত্রিত পালমিরার প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্কারে ১ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলারের প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে ইউনেস্কো। কিন্তু হাজার বছরের পালমিরার অবশিষ্ট ধ্বংসাবশেষ শুধু মনে করিয়ে দিচ্ছে এক আফসোস গাঁথা। রাণী জেনোবিয়ার পালমিরা নিছক এক ধ্বংসস্তূপের ইতিহাস ছাড়া আর কিছুই না।  

তথ্যসূত্র
 https://www.nationalgeographic.com/archaeology-and-history/magazine/2017/11-12/history-queen-zenobia-defied-rome/

https://en.m.wikipedia.org/wiki/Palmyra

https://www.britannica.com/place/Palmyra-Syria

লেখকঃ উবায়দুর রহমান রাজু 

ট্যাগ : পালমিরা,