ইতিহাস

মীর জুমলা গেট: ঢাকার বিলুপ্তপ্রায় এক ঐতিহাসিক নিদর্শন

ইতিহাস সোমবার, ২৪ জুন ২০১৯ ১০:১৮:৩৫

ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে নানা স্থানে ভাল করে লক্ষ্য করলে নানা রকম ঐতিহাসিক নিদর্শনের সন্ধান মিলবে। তবে ব্যস্ত এই নগরীতে এসব কিছু সাধারণ মানুষের চোখে খুব বেশি একটা পড়ে না। তাই বলে এসব ঐতিহাসিক নিদর্শনের গুরুত্ব বিন্দুমাত্রও কমে যায়নি। কমে গেছে শুধু মূল্যায়ন করার আগ্রহ টা। ঢাকা যে বহু পুরাতন জীবন্ত ইতিহাস কে বহন করে চলছে তার দলিল পত্র হল এইসব নিদর্শন। এমন একটি নিদর্শন হল "মীর জুমলা গেট" বা ঢাকা গেট। এটি বাংলায় মুঘল শাসনের সাক্ষ্য বহন করে চলছে, যা কয়েকশো বছর পুরানো।


ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এই স্থাপনাটি অবস্থিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি হতে তিন নেতার মাজারের রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে দোয়েল চত্বরের ঠিক আগেই এটি দেখতে পাওয়া যাবে। মূলত তিনটি অংশে বিভক্ত গেটটি। এ গেটের তিনটি অংশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নবায়নযোগ্য শক্তি গবেষণা কেন্দ্রের দিকে, মাঝখানের অংশটি পড়েছে সড়ক বিভাজকের দিকে এবং অপর অংশটি রয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের তিন নেতার মাজারের পাশে। তবে দেখে বোঝার উপায় নেই যে এগুলা ঐতিহাসিক নিদর্শন। কেননা এটি সংরক্ষণের জন্য তেমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি এর আশে পাশে কোন নাম ফলকও নেই যাতে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কে কিছু লেখা থাকবে।

এই গেটের নামকরণ নিয়ে বেশ অস্পষ্টতা রয়েছে। মুঘল আমলে বুড়িগঙ্গা নদী হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করার জন্য এই গেট ব্যবহৃত হতো তখন তার নাম ছিল মীর জুমলা গেট। তবে আরেকটি ঐতিহাসিক দল বলেন যে সুবাদার ইসলাম খাঁর আমলে রমনা অঞ্চলে ছিল বাগে বাদশাহী নামে মুঘল উদ্যান। বাগে বাদশাহীর প্রবেশ পথে ছিল দুটি স্তম্ভ। পরে তা পুনর্নির্মাণ করে নামকরণ করা হয় ময়মনসিংহ গেট। এরপর থেকে এটি ময়মনসিংহ গেট নামেই দীর্ঘদিন ধরে তার পরিচিতি বজায় রেখেছিল। পরবর্তীতে এটি ঢাকা গেট হিসেবেও পরিচিতি লাভ করে। তারও আরও বহু পরে এটি রমনা গেট হিসেবে পরিচিতি পায়। তবে রমনা গেট হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার পেছনে প্রধান কারণ হল সাধারন মানুষজন এটিকে সহজে চেনার জন্য এই নাম ব্যবহার করতো অর্থাৎ লোক মুখে বলতে বলতেই এটিকে রমনা গেট হিসেবে পরিচিতি পাইয়ে দেয়। তবে সর্বশেষ বাংলাদেশ সরকার এটি নিয়ে যে গেজেট প্রকাশ করে তাতে এর নাম "মীর জুমলা গেট" হিসেবেই উল্লেখ করে।


এই গেটের ইতিহাস সম্পর্কে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। একটি দল মনে করেন যে এটি সম্রাট আওরঙ্গজেবের সুবাদার মীর জুমলা ঢাকাকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নির্মাণ করেন। এশিয়াটিক সোসাইটি এই মতের পক্ষে সমর্থন দান করেন এবং তারা আরও মত দেন যে ১৬৬০-১৬৬৩ সালের মধ্যে মীর জুমলার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপেই এটি নির্মাণ করা হয় এবং এটি করা হয় মগদের আক্রমন থেকে ঢাকা কে রক্ষা করার জন্য। এরপর থেকে এই গেটটি ঢাকার প্রবেশ পথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আরেকটি দল মনে করেন এটি মীর জুমলা নয় বরং বাংলার আরেক সুবাদার ইসলাম খাঁ কর্তৃক এটি নির্মাণ করা হয়েছে। তবে এই মতের পক্ষে কোন জোরালো প্রমাণাদি পাওয়া যায় না। আরেকটি দল মত প্রকাশ করেন যে এটি ব্রিটিশ সময়কার ঢাকার ম্যাজিষ্ট্রেট চার্লস ডয়'স মূল শহরের সঙ্গে রেসকোর্সকে সংযুক্ত করার জন্য ময়দানের উত্তর-পূর্ব দিকে একটি সড়ক তৈরি করেন। এই সড়কের প্রবেশ পথে তৈরি করা হয় দুটি স্তম্ভ। যাকে তারা ঢাকা গেট হিসেবে উল্লেখ করেন। তাদের পক্ষে মতামত প্রকাশ করেন এ. এইচ. দানী। তার মতে, এগুলো মোগল আমলে তৈরি হয়নি। কারণ স্তম্ভ দুটির গড়ন ইউরোপীয় ধাঁচে যা মূল শহরের সঙ্গে রেসকোর্সকে যুক্ত করার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে। তবে এতো কিছুর পরও এটি মুঘল স্থাপত্য হিসেবে ঐতিহাসিকদের নিকট অধিক গ্রহণ যোগ্যতা লাভ করেছে।


এই পুরাতন ঐতিহাসিক নিদর্শনটি এমন অবহেলায় অনাদরে পড়ে থাকলে তা অচিরেই ধ্বংসের মুখে পতিত হবে। সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে এর রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণের জন্য পদক্ষেপে গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া এর উপর নতুন খড়গ এসে যুক্ত হয়েছে মেট্রোরেল। কেননা মেট্রোরেলের একটি অংশ এর উপর দিয়ে যাবে। তবে ঢাকা গেট বা মীর জুমলা গেটকে কি করা হবে তা এখনো ঠিক করা হয়নি। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে যেন যেকোন মূল্যে এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটিকে রক্ষা করে মেট্রোরেলের কাজকে এগিয়ে নেওয়া হয়।

তথ্য সূত্র:

১.https://www.manobkantha.com/নগরের-ঐতিহ্য-ঢাকা-গেট/

২.https://m.somewhereinblog.net/mobile/blog/iamkomol1/30171857

৩.https://travelbd.xyz/ঢাকা-ভ্রমণ-ঢাকা-গেট/

৪.http://itibritto.com/dhaka-gate-and-tsc-du/


লেখকঃ ফরিদ মোল্লা