ইতিহাস

ঢাকায় প্রাচীণ মোঘল স্থাপত্য শিয়া মতাবলাম্বীদের হোসেনী দালান।

ইতিহাস শনিবার, ০২ ফেব্রুয়ারী ২০১৯ ০৫:৪১:২৮

হোসেনী দালান বা ইমামবাড়া রাজধানী ঢাকার পুরাণ ঢাকায় অবস্থিত মোঘল  আমলের একটি স্থাপত্য, যদিও এ স্থাপত্যের সেই আদি রূপ না থাকলেও প্রত্যেকবারই সংস্কারের সময় পূর্বববর্তী রূপ ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়। হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর দোহিত্র ইমাম হোসেন(রা:)এর কারবালার প্রান্তরে শাহাদাত হওয়ার ঘটনার কথা স্মরণ করে শিয়া মতাবলম্বী ব্যাক্তিদের চাহিদায় সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার পৃষ্ঠপোষকতায় এ ভবন নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে ইমাম হোসাইনকে স্মরণ করে প্রতিবছর মুহররম মাসে যে তাজিয়া মিছিল বের হয় তা এই হোসেনী দালানকে কেন্দ্র করেই অনুষ্ঠিত হয়।

মোঘল আমলেরে নিদর্শন এই হোসেনী দালানের নির্মাণকাল নিয়ে মতবেদ থাকলেও অধিকাংশের মতানুযায়ী ১৭ শতকে সম্রাট শাহজাহানের সময় এ দালান নির্মাণ করা হয় বলে অধিকাংশই ধারণা করেন। যদিও এর স্বপক্ষে একটি প্রমাণও রয়েছে। হোসেনী দালান একবার ভুমিকম্পে ভেঙ্গে পড়লে সেখানে একটি শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়, প্রত্নতাত্ত্বিকরা পরীক্ষার পর দেখেছেন ওই শিলালিপিটি নকল নয়। ঐ শিলালিপি থেকে সুবাদার শাহ সুজা এর একজন নৌ সেনাপতি মীর মুরাদের নাম পাওয়া যায়। এই মীর মুরাদই এই হোসেনী দালান নির্মাণ করেন। হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর দৌহিত্র ইমাম হোসাইনকে স্মরণ করে এ মসজিদ নির্মানের পেছনে আরেকটি তথ্য প্রচলিত আছে, একদিন নাকি নৌ সেনাপতি সৈয়দ মুরাদ স্বপ্নে ইমাম হোসেনকে দেখেছিলেন, এবং স্বপ্নে ইমাম হোসাইন একটি তাজিয়াখান নির্মাণ করছেন। তা দেখে অনুপ্রেরণা নিয়ে শাহ সুজার সাহচর্যে এ দালান নির্মান করেন। অথচ শাহ সুজা একজন সুন্নী মুসলিম ছিলেন, তবুও তিনি শিয়াদের মধ্যে প্রচলিত রীতিনীতির পৃষ্ঠপোষকতা করতে আগ্রহী ছিলেন। ৬১ হিজরির ১০ মুহররম (৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর) তারিখে ইরাকের কারবালার যুদ্ধে আল হোসাইনের শহীদত্বকে স্মরণ করার জন্য ইমারত নির্মাণ করা ছিল শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত একটি সাধারণ রীতি। এই সাধারণ শিয়া রীতির প্রতি সম্মান রেখেই এ দালান নির্মান করেন।

ঐতিহাসিক এম হাসান দানীও বলেছেন, 'মীর মুরাদই এখানে প্রথম ছোট আকারের একটি ইমামবাড়া স্থাপন করেছিলেন। পরে ভুমিকম্পে এটি ভেঙে গেলে নায়েব নাজিমরা নতুন করে তা নির্মাণ করেন। ইতিহাসবিদ জেমস টেলর তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেন, ১৮৩২ সালেও এ আদি ইমামবাড়া টিকে ছিল। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে দুই দফায় ইমামবাড়ার সংস্কার হয়। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ভবনটি প্রায় বিধ্বস্ত হয়। পরে ব্রিটিশ ভারতের ঢাকার নবাব  খাজা আহসানউল্লাহ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে তা পুনঃনির্মাণ ও সংস্কার করেন। দালানের দক্ষিণ পাশে থাকা পুকরটি  ১৯৯৫-এ একবার এবং পরবর্তীতে ২০১১ তে পুনর্বার সংস্কার করা হয়।  ২০১১ খ্রিস্টাব্দে হোসেনী দালান বা এই ইমামবাড়ার সংস্কারসাধন ও সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়। এবার ইরান সরকার কর্তৃক অনুদান পেয়ে ইরানের প্রকৌশলীর দ্বারা এ দালানের সৌন্দর্যবর্ধন সহ কাঠামোগত কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়।পূর্বদিকের ফটকে এবং উত্তর দিকের চৌকোনা থামগুলোয় আয়াত ও সুরা লিখিত নীল রঙের টাইলস লাগানো হয়েছে। টাইলসগুলো ইরান থেকে আমদানি করা এবং এতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ইরানের ধর্মীয় শিল্পকলা ক্যালিগ্রাফি। যদিও মূল ভবন কাঠামো প্রাচীন নিয়মানুযীই রয়েছে।

হোসেনী দালানে প্রবেশ করলে ভেতরের সুসজ্জিত বাগান চোখে পড়ে সবার প্রথমে। দালানের একপাশে নির্দিষ্ট জায়গা জুড়ে শিয়া সম্প্রদায়ের ব্যাক্তিদের জন্য কবরস্থান নির্মাণ করা হয়েছে। এ জায়গায় জেয়ারাত করতে অধিকাংশ লোক প্রতিদিন যাতায়াত করে। হোসেনী দালানটি দেখতে অনেকটাই মনে হয় মঞ্চের উপরে নির্মাণ করা হয়েছে, সিঁড়ির সাহায্যে এ মঞ্চে উঠতে হয়। মূলত দালানটি পাশাপাশি স্থাপিত দুটি হল কক্ষ নিয়ে গঠিত। দালানটি সাদা বর্ণের এবং এর বহিরাংশে নীল বর্ণের ক্যালিওগ্রাফি বা লিপিচিত্রের কারূকাজ রয়েছে।মসজিদের অভ্যন্তরেও সুদৃশ্য নকশা দ্বারা সুসজ্জিত করে তৈরি করা হয়েছে। দালানের অভ্যন্তরের দক্ষিণমুখী ‘শিরনি’ হলটিতে ইমাম হোসেনের মৃত্যুর জন্য দুঃখ ও শোক প্রকাশের উদ্দেশ্যে কালো রঙ করা হয়েছিল। এ স্থানটি অনেকটা ইমাম হোসেনের কবরস্থানের আদলে তৈরি করা হয়েছে যাতে এখানকার শিয়া মতাবলম্বীরা এখান থেকেই ইমাম হোসেনকে স্মরণ করতে পারে।

এই হোসনী দালানকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের শিয়া মতাবলম্বীরা পবিত্র আশুরার সময় ইমাম হোসাইনকে স্মরণ করে মুহররমের প্রথম দশ দিন শোক পালন করে। মুহররমের দশম দিন তারা এই হোসেনী দালান থেকে ‘হায় সোসাইন হায় হোসাইন’ করে মাতম করতে করতে তাজিয়া মিছিল বের করে। এই তাজিয়া মিছিলে হোসাইনের অনুসারী অনেকেই নিজদের শেকল দিয়ে নিজেদের প্রহার করতে করতে তার জন্য আফসোস করতে থাকে। এছাড়াও মোহাম্মদপুরের বিহার থেকে ও মিরপুর থেকেও এই তাজিয়া মিছিল বের হলেও এই হোসেনী দালানকে কেন্দ্র করেই মূলত শিয়া সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করা হয়।

মোঘল  আমলের এই স্থাপত্য শিল্প মূলত শিয়া মতাবলম্বীদের জন্যই তৈরি। সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজা বাংলার সুবাদার হয়ে আসার সময় সাথে করে অনেকগুলো শিয়া পরিবার আসেন। সেই শিয়া পরিবারদের চাহিদা অনুযায়ী এ হোসেনী দালান নির্মাণ করে দেন। আজো শিয়া মতবলম্বী অনুসারীরা ইমাম হোসাইনকে স্মরণ করার জন্য এ হোসেনী দালানে একত্রিত হন।  

লেখকঃ এস এম সজীব