ইতিহাস

কর্নেল নিজামুদ্দিনঃ যিনি নেতাজিকে বাঁচানোর জন্য তিনটি বুলেট নিজের গায়ে নিয়েছিলেন।

ইতিহাস বুধবার, ৩০ জানুয়ারী ২০১৯ ০২:৪৬:১৩

" আমরা যখন বনের মধ্যে ছিলাম তখন হঠাৎ দেখতে পেলাম বৃটিশ আর্মির একটি বন্দুকের নল নেতাজীকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখনই আমি নেতাজীর সামনে ঝাপিয়ে পড়ে গুলিবিদ্ধ হই। ক্যাপ্টেন লাক্সমি সেগাল আমার শরীর থেকে তিনটি বুলেট বের করে ফেলার পরে আমার চেতনা ফিরলে দেখি নেতাজী আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন"। এভাবে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য প্রতিটি যোদ্ধা নিজের জীবনের বিনিময়ে এগিয়ে এসেছিলো বৃটিশদের বিরুদ্ধে। যে কোন স্বাধীনতা আন্দোলনে অসংখ্য মানুষের প্রচূর আত্মত্যাগ থাকে, অসংখ্য মানুষের লড়াইকে মানুষ ভুলে যায়  অথবা তাদের অনেককে মনে রাখা সম্ভবও হয়নি। অথচ তাদের প্রত্যেকের অবদান ছোট আকারের হলেও ভারতের স্বাধীনতায় রয়েছে তাদের বিশাল অবদান। ভারতের  স্বাধীনতা সংগ্রামের অস্বীকৃত নায়ক ছিলেন কর্নেল নিজামুদ্দিন, যাকে ভারতবর্ষের খুব কম মানুষই চিনতো, খুব কম মানুষই স্বাধীনতা সংগ্রামে তার অবদানের কথা স্মরণ করতো।

কর্ণেল নিজামুদ্দিন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর অত্যন্ত বিশ্বস্ত একজন সঙ্গী ছিলেন তার দীর্ঘসময় জুড়ে। একসময় নেতাজীর ব্যক্তিগত ড্রাইভার হিসেবে নেতাজীর পাশে থেকে লড়াই করে তিন তিনটে বুলেট নিজের বুকে নিয়ে প্রাণে বাচিয়েছিলেন নেতাজীকে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য দেশছেড়ে যাওয়া এই সৈনিককে নেতাজী নিজেই করর্নেল উপাদি প্রদান করেন। তার অজানা গল্পই বলছি আজ।

কর্ণেল নিজামুদ্দিন, যার নাম মূলত সাইফুদ্দিন। উত্তর প্রদেশের ধাক্কান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ১৯০১ সালে। গ্রামটি বর্তমানে উত্তর প্রদেশের আজমগড় নামে পরিচিত। পিতা রাঙ্গুনে একটি ক্যান্টিনের ব্যাবসা করতেন। পিতা মাতার সাথে গ্রামেই বড় হয়েছেন সাইফুদ্দিন। তরুন সাইফুদ্দিন ২০ বছর বয়সে বৃটিশ আর্মিতে যোগদানের স্বপ্ন নিয়ে জাহাড়ে চড়ে পাড়ি দেন কলকাতায়। সেই তার জীবনের পথচলা শুরু। কলকাতায় এসে যোগদেন তৎকালীন বৃটিশ আর্মিতে।  

বৃটিশ আর্মিতে যোগদানের পর তার সামনে ভেসে উঠে বৃটিশ আর্মির অন্য রূপ। ভারতের স্বাধীনতাকামী মানুষদের উপর বৃটিশ আর্মির নানানভাবে চড়াও হওয়া নিতে পারেন নি সাইফুদ্দিন। বৃটিশ আর্মির কাছে নির্যাতনের শিকার হতো ভারতীয় সিপাহীও। ভারতীয় সাধারণ সিপাহীদের যাচ্ছে তাই ভাবে গালিগালাজ করতো দাম্ভিক বৃটিশ আর্মির সদস্যরা।  একদিন এমন এক ঘটনায় তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বৃটিশ আর্মির এক অফিসারকে গুলি করে দেন। তারপর নিজের জীবন রক্ষার্থে  দ্রুত সিঙ্গাপুর পালিয়ে যান। তখন ভারত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম নেতা নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু গিয়েছিলেন সিঙ্গাপুরে। তিনি সেখানে নেতাজীর সাথে সাক্ষাত করেন।নেতাজীর সাথে সাক্ষাত করে সাইফুদিন আজাদ হিন্দ ফৌজ বা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মিতে যোগদান করেন। সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট হিসাবে তিনি কাজ করতেন বলে নিজের নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম রাখেন নিজামুদ্দিন।

ধীরে ধীরে নিজামুদ্দিন নেতাজীর বিশ্বস্ত সহকারীতে পরিণত হন। ভারী বন্দুক চালানো এবং গাড়ি চালানোর দক্ষতাই নিজামউদ্দিনকে খুব দ্রুত নেতাজির কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল। নেতাজী সবসময় তাকে কাছাকাছি রাখতে চাইতেন, এমনকি নেতাজীর গাড়িও চালাতেন নিজামুদ্দিন। নেতাজীকে উপহার হিসেবে দেয়া মালায়ার রাজার ১২ সিলিন্ডারের গাড়িটি নিয়ে নেতাজীকে নিয়ে সর্বত্র চলাফেরা করতেন তিনি।নেতজীর ব্যাক্তিগত সহকারী হওয়ার সাথে সাথে নেতাজীর সকল কাজে তার অংশগ্রহণ ও সহযোগীতা সর্বত্র ছিলো।  ১৯৪৩ ও ১৯৪৪ সালে বার্মা তথা বর্তমান মায়ানমার থেকে নেতাজীর সাথে বৃটিশ আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন নিজামুদ্দিন।

১৯৪৩ সালে বার্মা সীমান্তে বৃটিশ আর্মির সাথে এক ভয়াবহ যুদ্ধ বাঁধে আজাদ হিন্দ ফৌজের সাথে। নেতাজী তখন আজাদ হিন্দ ফৌজের সেই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। নেতাজীর সাথে উপস্থিত ছিলেন নিজামুদ্দিন। যুদ্ধ ভয়াবহ আকার ধারণ করে।বৃটিশ আর্মি আজাদ হিন্দ ফোউজের দিকে আগাতে থাকে।  যুদ্ধের এক পর্যায়ে নিজামুদ্দিন দেখতে পান বৃটিশ আর্মি নেতাজীর খুব কাছাকাছি চলে এসে তাকে গুলি করার জন্য টার্গেট ঠিক করছেন। দেখা মাত্রই নিজামুদ্দিন কোন কিছু না ভেবেই নেতাজীর সামনে ঝাপিয়ে পড়ে নেতাজীকে সরিয়ে দেন, এবং নিজে গুলিবিদ্ধ হন। তিনটি বুলেট তার শরীরে প্রবেশ করলে সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে পড়েন তিনি। নিজামুদ্দিন তার স্মৃতিচারণে বলেছেন- " আমরা যখন বনের মধ্যে ছিলাম তখন হঠাৎ দেখতে পেলাম বৃটিশ আর্মির একটি বন্দুকের নল নেতাজীকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখনই আমি নেতাজীর সামনে ঝাপিয়ে পড়ে গুলিবিদ্ধ হই। ক্যাপ্টেন লাক্সমি সেগাল আমার শরীর থেকে তিনটি বুলেট বের করে ফেলার পরে আমার চেতনা ফিরলে দেখি নেতাজী আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন"।

নিজামুদ্দিনের এমন ত্যাগে অভিভূত হয়ে নেতাজী তাকে কর্নেল উপাধীতে ভূষিত করেন। তারপর আরো চার বছর নেতাজীর সাথে নেতাজীর ব্যক্তিগত দেহরক্ষী ও গাড়ি চালক হিসেবে কাজ করেছেন এই নিজামুদ্দিন। দেহরক্ষী হিসেবে নেতাজী যেখানেই ভ্রমণ করতেন, তার সাথে সবসময় সঙ্গী হিসেবে থাকতেন নিজামুদ্দিন। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে নেতাজীর সাথে জাপান, ভিয়েতনাম, থাইংল্যান্ড, কম্বোডিয়া, মালোয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরে সফর সঙ্গী হিসেবে ছিলেন তিনি।

২য় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের পর নিজামুদ্দিন রাঙ্গুনে থাকা অবস্থায় আজবুন নিসাকে বিয়ে করে সেখানে বসবাস করতে শুরু করেন। রাঙ্গুনের একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকে গাড়ি চালক হিসেবে তার আরেকটি কর্মজীবন শুরু করেন। তখন ভারতের আজাদ হিন্দ ফৌজের নানান কারনে ভাঙ্গন দেখা দেয়, যার ফলে নেতাজীর সাথে তার আর দেখা হয়েছে বলে জানা যায় না। যদিও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু যে ১৯৪৫ সালে বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান সেই তথ্য খারিজ করে নিজামউদ্দিন দাবি করেন স্বাধীনতার সময় পর্যন্ত জীবিত ছিলেন নেতাজি। বিমান দুর্ঘটনার ৩-৪ মাস পরে তিনি নেতাজিকে বর্মা-থাইল্যান্ড সীমান্তে সিতাংপুর নদীর তীরে গাড়ি করে ছেড়ে এসেছিলেন বলে তিনি দাবি করেছিলেন। যদিও এ নিয়ে পরবর্তীতে আর বেশি কিছু জানা সম্ভব হয়নি তার কাছ থেকে।

১৯৬৯ সালে নিজামুদ্দিন তার পুত্র ও কন্যা সন্তানকে সাথে নিয়ে তার শৈশবের সেই গ্রামে ফিরে আসেন। সেই গ্রামে ঘর তৈরি করে তার নাম দেন ‘হিন্দ ভবন’। ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যে তেজোদ্দীপ্ত আত্মত্যাগী ছিলেন তা তার পরবর্তী জীবনেও দেখা যায়। ‘জয় হিন্দ’ স্লোগানে তিনি সকলকে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করতেন। তারপর থেকে নিজ গ্রামে পরিবারের সাথে সাধারণভাবে বসবাস করেছেন নিজামুদ্দিন। জীবনের শেষ সময়ে এসে ১১৬ বছর বয়সে নিজামুদ্দিন তার স্ত্রীকে নিয়ে একটি ব্যাংক একাউন্ট চালু করতে গেলেই সারাবিশ্বের শিরোনাম হয়ে উঠেন। পৃথিবীতে বেচে থাকা সবচেয়ে বেশি বয়ষ্ক ব্যাক্তি হিসেবে নাম লেখান। নিজ গ্রামেই ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ সালে ১১৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। যখন তার স্ত্রীর বয়স ১০৭।

সুত্রঃ thebetterindia.com
লেখকঃ এস এম সজীব