খেলাধুলা

পেলে : একজন সেলেসাও সুপারস্টারের গল্প

খেলাধুলা মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই ২০১৯ ০৯:৩৫:৩১

এদসোঁ আরাঁচ দু নাসিমেঁতু (Edson Arantes do Nascimento) তাঁর আসল নাম হলেও ফুটবল বিশ্বে পেলে নামেই পরিচিত এই সেলাসাও সুপারস্টার।  ১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর ব্রাজিলের ট্রেজ কোরাকুজ নামক জায়গায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি।  একজন ফরোয়ার্ড কিংবা এটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে ডানপায়ে ব্রাজিলের হয়ে  মাঠ মাতিয়েছেন এই খেলোয়াড়।  তাঁকে ফুটবলের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে অভিহিত করা হয়। তিনবারের ফিফা বিশ্বকাপ জয়ী এই খেলোয়াড়কে ১৯৯৯ সালে ফিফা কো- প্লেয়ার অব দ্য সেঞ্চুরিতে ভূষিত করা হয়।

ফুটবলে হাতেখড়ি : কৈশোরে যুব দলে যোগদেন পেলে সেখানে  তাঁর প্রশিক্ষক হিসেবে ছিলেন ওয়ালডেমার ডি ব্রিটো। ডি ব্রিটো হলেন ব্রাজিল ফুটবল দলের সাবেক খেলোয়াড়। মাত্র ১৫ বছর বয়সে পেলের পরিবারকে রাজী করিয়ে সান্তোস ক্লাবে নিয়ে যান ডি ব্রিটো !  সেখানে ট্রায়াল দেওয়ার সময় পেলের অসাধারণ ফুটবল শৈলীতে মুগ্ধ হন সান্তোস ফুটবল ক্লাব কর্তৃপক্ষ। ফলে সান্তোস ফুটবল ক্লাবে খেলার সুযোগ পান তিনি। উক্ত ক্লাবের নিয়মিত ফুটবলারদের সাথে তিনি অনুশীলন করতে শুরু করেন।

 ১৬ বছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই পেশাদার ফুটবলার হিসেবে প্রথম গোলের দেখা পান তিনি ।  ঘরোয়া লিগে চমৎকার পারফরমেন্সের মাধ্যমে ব্রাজিল জাতীয় ফুটবল দলে জায়গা করে নেন কালো মানিক খ্যাত এই ফুটবলার।

আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক : ১৯৫৭ সালে বিখ্যাত মারাকানা স্টেডিয়ামে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক হয় তাঁর। সেইম্যাচে সফরকারী আর্জেন্টিনাকে ২-১ গোলে হারায় ব্রাজিল।  মাত্র ১৬ বছর ৯মাস বয়সে সর্বকনিষ্ট ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার হিসেবে উক্ত ম্যাচে গোল করে অনন্য রেকর্ড গড়েন তিনি।

খ্যাতি অর্জন  : ১৯৫৮ সালের ফিফা বিশ্বকাপে ব্রাজিলিয়ান এই সাবেক ফুটবলার বিশ্ব দরবারে তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। উক্ত বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে হ্যাট্রিক গোল করার পাশাপাশি  ফাইনালে তাঁর জোড়া গোলে স্বাগতিক সুইডেনকে ৫-২ গোলের ব্যাবধানে হারিয়ে বিশ্বকাপের শিরোপা জিতে ব্রাজিল।  ৪বছর পর অনুষ্ঠিত হওয়া ১৯৬২ সালের ফিফা বিশ্বকাপেরও শিরোপা জিতে ব্রাজিল। কিন্তু উক্ত বিশ্বকাপে পেলেকে ইঞ্জুরি হানা দিলে, প্রথম ২টি ম্যাচ ছাড়া আর কোন ম্যাচ খেলতে পারেননি তিনি ।

১৯৬৬ সালের ফিফা বিশ্বকাপ ব্রাজিল ও পেলের জন্য সুখকর ছিল না।  উক্ত বিশ্বকাপে ব্রাজিলিয়ান এই মহাতারকা অসংখ্য  কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিলেন যার প্রধান ও একমাত্র কারণ ছিল  ইঞ্জুরি।  ফলে গ্রুপ পর্ব খেলে তাঁদেরকে বিদায় নিতে হয়েছে ।  ১৯৭০ সালের ফিফা বিশ্বকাপে ব্রাজিল দলে উঠে আসে কিছু তরুন ফুটবলার।  তাদের মধ্যে জাইরজিনহো ও রিবালিনো ছিলেন অন্যতম। অভিজ্ঞ পেলে আর তারুন্যে উজ্জীবিত ফুটবলারদের অসাধারণ ফুটবল নৈপুণ্যে তৃতীয়বারের মতো ফিফা বিশ্বকাপের শিরোপা জিতে ব্রাজিল।  উক্ত বিশ্বকাপটিই  ছিল এই কিংবদন্তির শেষ বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপ ক্যারিয়ারে ৩টি আসর মিলিয়ে ১৪ ম্যাচ খেলে ১২টি গোল করতে সক্ষম হন তিনি।
মূলত ১৯৬০ সালে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে পেলের তারকাখ্যাতি । কারণ ঐ সময়ে নাইজেরিয়ায় চলছিলো গৃহযুদ্ধ।  পেলের একটি ফুটবল ম্যাচ দেখার জন্য নাইজেরিয়ার ঐ বিবাদমান দুই পক্ষ ৪৮ ঘন্টার জন্য  গৃহযুদ্ধ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখে। আর তারপর থেকেই এই কিংবদন্তির সুনাম আকাশচুম্বী হয়ে উঠে। তাঁর পুরো ফুটবল ক্যারিয়ারে শুধু ১৯৬২ সালের বিশ্বকাপটি  হতাশাজনক ছিল বলে মনে করেন তিনি । উক্ত বিশ্বকাপে প্রথম দু'টি ম্যাচ খেললেও ঊরুর ইনজুরির কারণে বাকী ম্যাচগুলি  সাইডলাইনে বসে দেখতে হয়েছে।

ক্লাব ক্যারিয়ার : সান্তোস ক্লাবে যোগদানের পর  অত্র ক্লাবের হয়ে ব্রাজিলের ঘরোয়া লিগে অধিকসংখ্যক গোল করেন তিনি,  যা ব্রাজিলের ক্লাব ইতিহাসে বিরল। তাঁর চমৎকার ফুটবলীয় দক্ষতায় ১৯৬২ ও ১৯৬৩ সালে কোপা লিবার্তোদোরেসের শিরোপা জিতে উক্ত ক্লাব। ব্রাজিলিয়ান সাবেক এই সুপারস্টার ইউরোপের অনেক নামিদামী ক্লাবে খেলার প্রস্তাব পেয়েছিলেন।  কিন্তু তৎকালীন সময়ে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জানিও কোয়াদরোস পেলেকে জাতীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষনা করার পাশাপাশি এই সম্পদের যাতে সুষ্ঠু ব্যবহার করা হয় ও অন্যদেশে গিয়ে যাতে তাঁর অবমূল্যায়ন না হয় সেজন্য দেশে থেকেই খেলার আহবান জানান তিনি । অবশ্য ১৯৭৫ সালে ৭বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে ১ বছরের জন্য নিউইয়র্ক কসমস ক্লাবে খেলার চুক্তি করেন পেলে।

রেকর্ডসমুহ :  মাত্র সতেরো বছর বয়সে বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠতম ফুটবলার হিসেবে ফিফা বিশ্বকাপ জিতেন এই মহারথী।  তিনি গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে দুইবার তাঁর নাম লিখান। প্রথম রেকর্ড হচ্ছে তিনিই বিশ্বের একমাত্র ফুটবলার যিনি তিনটি ফিফা বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেন। দ্বিতীয় রেকর্ডটি  হচ্ছে বিশ্বের একমাত্র ফুটবলার হিসেবে সমস্ত ক্যারিয়ার মিলিয়ে  সর্বাধিকসংখক গোল করেন তিনি।  ১৩৬৩টি ফুটবল ম্যাচ খেলে ১২৮৩টি গোল করার পাশাপাশি ৯২টি হ্যাট্রিক করেন ফুটবলের এই রাজা।

অবসর :  ১৯৭৪ সালে ফুটবল থেকে অবসরের ঘোষনা দিলেও ১৯৭৫ সালে নিউইয়র্ক কসমসের হয়ে খেলার জন্য ফুটবলে আবার প্রত্যাবর্তন করেন তিনি।  ১৯৭৭ সালের অক্টোবরে  প্রায় ২০ বছরের বর্ণিল ফুটবল ক্যারিয়ারকে বিদায় জানান ফুটবলের এই রাজপুত্র।  ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পর ১৯৯৫ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত  ব্রাজিলের ক্রীড়ামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এরপর থেকে খেলাধুলা ও বিভিন্ন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানে বৈশ্বিক দূত হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।

তথ্যসূত্র : www.sportskeeda. com

লেখকঃ আরিফুল ইসলাম সোহান