ডন ব্রাডম্যান- ক্রিকেটের রূপকথার একমাত্র নায়ক
১৯৪৮ সালে ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট ইনিংসে শূন্য রানে আউট হয়ে যাওয়ার হতাশা জীবিত থাকতে যথেষ্ট পুড়িয়েছে ডন ব্রাডম্যানকে। জীবনের ইনিংস শেষে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন অনেকদিন হলো। তারপরও ক্রিকেটীয় অতিমানবীয় কীর্তির কারণে বারবারই আলোচনায় আসেন সর্বকালের সেরা টেস্ট ক্রিকেটার ব্রাডম্যান।
১৯৪৮ সালে ক্যারিয়ারের ২৯ ও শেষতম সেঞ্চুরিটি করেছিলেন ব্রাডম্যান। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে অসংখ্য রেকর্ড গড়েছেন এই কিংবদন্তি ক্রিকেটার। সেখান থেকে উল্লেখযোগ্য কিছু তুলে ধরা হলো-
ডোনাল্ড ব্রাডম্যান ঈর্ষণীয় ৯৯.৯৪ গড়ে টেস্ট ক্যারিয়ার শেষ করেছেন। ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসে মাত্র ৪ রান করতে পারলেই তার গড়টা ১০০ ছুঁতে পারত। যেকোনো খেলোয়াড়ের কাছেই গড়টা অস্পর্শনীয়!
এক সিরিজে সর্বোচ্চ রান করেছেন তিনি। ১৯৩০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুটি ডাবল সেঞ্চুরি ও একটি করে সেঞ্চুরি ও ট্রিপল সেঞ্চুরির সাহায্যে ৯৭৪ রান করেন ডন।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের রেকর্ড-সর্বোচ্চ ১২টি ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন ডন।
ব্রায়ান লারা ও বীরেন্দর শেবাগের সমান দুটি ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছেন ব্রাডম্যান।
অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের মধ্যে দ্রুততম সময়ে ১ হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন এই কিংবদন্তি ক্রিকেটার।
১০০ বা ততোধিক গড়ে সাতবার মৌসুম শেষ করেন সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার।
রেকর্ড-সর্বোচ্চ ছয়বার এক সেশনে সেঞ্চুরি করার কীর্তি গড়েন তিনি।
একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ৫ হাজার রান করার কীর্তি গড়েন ব্রাডম্যান। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৫০২৮ রান করেন তিনি। অবশ্য তখন টেস্ট খেলুড়ে দেশের সংখ্য ছিল হাতে গোনা।
একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে টানা ছয়টি টেস্টে সেঞ্চুরি করার কীর্তি গড়েন ব্রাডম্যান।
একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে এক সিরিজেই তিনটি ডাবল সেঞ্চুরি করার অতিমাবনবীয় কীর্তি গড়েন ব্রাডম্যান। ১৯৩০ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে অ্যাশেজ সিরিজে ২৫৪, ৩৩৩ ও ২৩২ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি।
তাঁর বোলিং গড় ৩৬ এবং মোট ক্যাচ সংখ্যা ৩২ টি।
২০০০ সালে উইজডেন ক্রিকেট অ্যালমানাক কর্তৃক বিংশ শতাব্দীর সেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হন তিনি। ক্রিকেটজীবনে বহু সেঞ্চুরি হাঁকালেও আয়ুর সেঞ্চুরি করা হয়নি তার। ৯২ বছর বয়সে জীবনের সেঞ্চুরি পূরণের আগেই ব্র্যাডম্যান দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার কিংস্টন পার্কে মারা গেলেন ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০১। তার আগে ১৯৪৯ সালে অর্জন করলেন সম্মানসূচক ‘নাইটহুড’।
শৈশব
ক্রিকেটের এই রুপকথার নায়কের জন্ম ১৯০৮ সালে। জর্জ ও এমিলি দম্পতির তিন মেয়ে দুই ছেলের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ব্র্যাডম্যানের জন্ম হয় অস্ট্রেলিয়ার কুটামুন্ড্রায় (নিউসাউথ ওয়েলস) সে বছরের ২৭ আগস্ট। তার দাদার দাদা ইতালিয়ান নাগরিক ছিলেন, যিনি মাইগ্রেট করে অস্ট্রেলিয়ায় বসতি গড়েন। ব্র্যাডম্যানের বাবা-মা বাস করতেন স্টকিনবিঙ্গালের কাছে ইও ইও শহরের হ্যামলেটে। মা তাকে জন্ম দেন কুটামুন্ড্রা হোম অব গ্র্যানি স্কুলজে। এটি এখন জাদুঘরের মর্যাদা পেয়েছে এ কারণেই। ইও ইওতে তাদের সমস্যা হওয়ায় ১৯১১ সালে জর্জ-এমিলি দম্পতি চলে যান ব্র্যাডম্যানের নানাবাড়ি মিটাগঙ্গের কাছেই- বাওরালে, যখন ব্র্যাডম্যানের বয়স মাত্র আড়াই বছর।
সেই শৈশব হতেই ক্রিকেটের প্রতি ছিল তাঁর অমোঘ আকর্ষণ। মাত্র ৫ বছর বয়সে তিনি স্কুলে ভর্তি হন ১৯১৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। এটির নাম বাওরাল পাবলিক স্কুল। গণিতে খুব ভালো ছিলেন তিনি। ১৯২২ সালে স্কুল জীবনের ইতি টানেন ব্র্যাডম্যান। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটে অনুরক্ত ডন ব্র্যাডম্যান দুর্দান্ত খেলতেন স্কুলজীবনেই। এখানে পড়াকালীনই তিনি ক্রিকেট সম্পর্কে যাবতীয় জ্ঞান অর্জন করতে শুরু করেন। তবে কিভাবে ক্রিকেট খেলতে হয়- এ রকম কোনো শিক্ষা পাননি তিনি। ১২ বছর বয়সে স্কুলের পক্ষে খেলতে নেমে তিনি করেছেন প্রথম সেঞ্চুরি- ১১৫, যেখানে তার দলের মোট স্কোর ছিল ১৫৬।
ব্র্যাডম্যান যুগ
১৯ বছর বয়েসে ফার্স্টক্লাস অভিষেকের পর নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে ব্যাট হাতে ম্যাচের পর ম্যাচ পারফর্ম করে যাচ্ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার বিস্ময়-বালক ডন ব্র্যাডম্যান। একসময় সুযোগ এলো জাতীয় দলের হয়ে মাঠে নামার।
ডাক পেলেন ১৯২৮-২৯ মৌসুমে সফরকারী ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টের দলে।
ব্রিসবেনের সেই টেস্টে অস্ট্রেলিয়া হেরে গেল ৬৭৫ রানে। ডন করলেন দুই ইনিংসে ১৮ এবং ১। বাদ পড়লেন দ্বিতীয় টেস্টের দল থেকে। জাতীয় দল থেকে বাদ পড়া সেই প্রথম এবং সেই শেষ।
তৃতীয় টেস্টের দলে ডাক পেয়ে জাত চেনালেন- করলেন ৭৯ এবং ১১২। শুরু হল ব্র্যাডম্যান যুগ। তখন থেকেই তিনি ব্যাটিংয়ে হয়ে ওঠেন নিষ্ঠুর, নির্দয়, এমনকি খুনিও।
ক্লান্তিহীন ব্র্যাডম্যান
ডনের যেন তখন ক্যারিয়ারে ক্লান্তি বলে কিছু নেই, যেন নেই আবেগও। অন্য ‘ভালো’ ব্যাটসম্যানেরা যেখানে ৫০ রান করলেই আত্মতুষ্টিতে ভুগতেন- সেখানে স্যার ডন ১৫০-এর আগে নাকি ব্যাটই তুলতেন না। প্রতি ৩ ইনিংসে ১টি করে সেঞ্চুরি, ১২টি ডবল সেঞ্চুরি, ২টি ট্রিপল সেঞ্চুরি- এই পরিসংখ্যানই যথেষ্ট স্যার ডনের গ্রেটনেস বোঝাতে।
সেই বিখ্যাত শূন্য
অন্য অনেক কিছুর মতোই টেস্ট ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত শূন্যটিও স্যার ডনের। ১৯৪৮-এ ওভালে শেষ টেস্টে নরম্যান ইয়ার্ডলির নেতৃত্বাধীন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ব্যাট করতে নামার সময় ব্যাটিং গড় ১০০ করতে স্যার ডনের প্রয়োজন ছিল মাত্র ৪ রানের, এরিক হলিস নামের অখ্যাত এক লেগ স্পিনার তাকে পোড়ালেন হতাশায়। জীবনে একবার মাত্র হিট আউট হয়েছিলেন স্যার ডন, যা হয়েছিলেন লালা অমরনাথের বলে। ডন জীবনে একবার-ই স্টাম্পড হয়েছিলেন। আর সেই উইকেট ভেঙেছিলেন এক বাঙালি- প্রবীর মিত্র।
অসুখী পারিবারিক জীবন
১৯২০ সাল থেকেই জেসি মারথা মেঞ্জিসের সঙ্গে পরিচয়, জানাশোনা, ভালোবাসা ব্র্যাডম্যানের। ১৯৩২ সালের ৩০ এপ্রিল সিডনির একটি চার্চে তাদের বিয়ে হয়। তাদের প্রথম সন্তান ১৯৩৬ সালে জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই মারা যায়। দ্বিতীয় ছেলে জন ১৯৩৯ সালে জন্মের পরপর পোলিওতে আক্রান্ত হয়। মেয়ে শার্লির জন্ম হয় ১৯৪১ সালে সেও জন্মগতভাবেই মস্তিষ্কজনিত সমস্যায় আক্রান্ত। এ কারণে ব্র্যাডম্যানের পারিবারিক জীবন ছিল ভীষণ অসুখী। কিন্তু পারিবারিক সমস্যাগুলোকে সুযোগ দেননি ক্যারিয়ারে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে। বলতে গেলে ৬৫ বছরের পারিবারিক জীবনটা উপভোগের সুযোগ সেভাবে পাননি তিনি। তিনিই বলেছেন, ‘সন্তানসুখ কী- এটা আমার বোধগম্য নয়’।
ক্রিকেট বিষয়ক ব্র্যাডম্যানের কয়েকটি উক্তি
আমার কোনো কোচ ছিল না, এমনকি কীভাবে ব্যাট ধরতে হয় তাও কেউ আমাকে শেখাননি।
আমি বলকে আমি যেখানে চাইতাম সেখানে পৌঁছাতে পারতাম, যদি আমি আউট না-হতাম।
আমার চেয়ে সামর্থ্যবান অনেক ক্রিকেটারই আমার সময়ে ছিলেন। কিন্তু তারা কেন যে আমাকে ছাড়িয়ে যেতে পারলেন না, তা আমার বোধগম্য নয়।
কবিতা পড়া আর ক্রিকেট খেলা দেখা- দুটোই ছিল আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
টেস্ট ক্রিকেট কোনো দুর্বল চিত্তের জন্য নয়। বিশেষ করে ইংল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার খেলার ক্ষেত্রে।
সূত্রঃ উইকিপিডিয়া, দৈনিক যুগান্তর এবং পরিবর্তন ডট কম