খেলাধুলা

জাদুকর সামাদ- বিস্মৃত কিংবদন্তি

খেলাধুলা বুধবার, ২২ আগস্ট ২০১৮ ০৪:৫০:৪৬

জাদুকর সামাদ নামটা শুনলেই চোখের সামনে ফুটবলের কিছু শৈল্পিক দৃশ্য ভেসে উঠে। ফুটবলে শিল্প শব্দটার পরিচিতি যেন সামাদের হাত ধরেই। তিনি উপমহাদেশের ফুটবল ইতিহাসের কিংবদন্তি। পরিচিতি তার ফুটবলার জাদুকর সামাদ হিসেবে। জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের ভুরী গ্রামে। এই গ্রামেই ১৮৯৫ সালের ৬ ডিসেম্বর এক নিভৃত পরিবারে তাঁর জন্ম।

জাদুকর সামাদ নামেও পরিচিত হলেও তাঁর পুরো নাম সৈয়দ আবদুস সামাদ। সামাদ স্বাধীন বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে জন্ম না নিয়েও ১৯৪৭-এর দেশ-বিভাগের পর এই ভূ-খণ্ডকেই নিজের দেশ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন । ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে যখন পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি দেশ জন্ম নিল, তখন জাদুকর সামাদ চলে আসেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম বৃহৎ রেলওয়ে শহর পার্বতীপুরে। এরপর পুরো জীবনটাই কাটিয়েছেন এখানেই। বিভিন্ন সূত্র মতে তিনি ১৯৪১ সাল অর্থাৎ প্রায় ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত ফুটবল খেলেছেন এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৫৭ সালে তিনি পাকিস্তান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের বেতনভুক্ত ফুটবল কোচ হিসেবে চাকরি শুরু করেন। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সরকার তাঁকে রাষ্ট্রপতি পদক দিয়ে সম্মানিত করে।

কলকাতা এরিয়ান্স ক্লাবের দুঃখীরাম মজুমদারের কাছে তার ফুটবল শিক্ষা শুরু হয়। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে সামাদ কলকাতার ‘মেইন টাউন ক্লাবের’ পক্ষ হয়ে সর্বপ্রথম ফুটবল খেলা শুরু করেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। রংপুরের তাজহাটের প্রখ্যাত সেন্টার ফরওয়ার্ড রাজা গোপাল রায় ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত তাজহাট ফুটবল দল গঠন করেন। এ দলের বিখ্যাত খেলোয়াড় ছিলেন জাদুকর সামাদ। রংপুরের তাজহাটের রাজ দরবারের সিঁড়ি বেয়েই সর্বপ্রথম সামাদ কলকাতায় এসেছিলেন। ১৯১৫ সালে কলিকাতা দ্বিতীয় বিভাগের ক্লাব এরিয়ান্স সামাদকে দলভুক্ত করে। সেবার অনেকটা সামাদের অসাধারণ নৈপুন্যে এরিয়ান্স ক্লাব প্রথম বিভাগে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। ১৯২০ সালে সামাদ ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে ক্লাবে যোগ দেন। । ১৯২৪ সালে ভারতীয় জাতীয় দলের খেলোয়াড় হিসেবে তিনি বার্মা, যুক্তরাজ্য এবং চীন সফর করেন। বহু খেলায় তার ক্লাব হেরে গেলেও শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার পেয়েছেন ফুটবল জাদুকর সামাদ। ১৯২৭ সালে তিনি ঢাকার তৎকালীন শীর্ষ দল ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব এবং কলকাতার বিখ্যাত মোহনবাগান ক্লাবে খেলার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। ১৯৩৩ সালে মোহামেডান এ যোগদান করেন। সে সময় মোহামেডান পর পর পাঁচবার আইএফএ শিল্ড ও লিগ জয় করে। উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অপূর্ব ক্রীড়াশৈলীর প্রদর্শন করে ফুটবল জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেন।

১৯১৫ সাল থেকে ১৯৩৮ সাল থেকে মাত্র ২৩ বছর ছিল সামাদের খেলোয়াড়ী জীবন। তিনি ছিলেন একজন রেল কর্মচারী। সে সময় ইবিআর নামে যে রেলওয়ে ফুটবল টিম ছিল সামাদ তাতে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। সামাদের ২৩ বছর খেলোয়াড়ী জীবনে এমন সব বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে যা তার নামের সামনে জাদুকর শব্দটি বসাতে বাধ্য করেছে। জাদুকর সামাদের কালজয়ী ফুটবল প্রতিভা ও নেতৃত্বগুণ তৎকালীন সর্বভারতীয় ফুটবল দলকে গ্রেট বৃটেনের মতো বিশ্বসেরা ফুটবল দলের বিরুদ্ধে অবিস্মরণীয় জয় এনে দিয়েছিল।

১৯২৪ সালে সামাদ ভারতের জাতীয় ফুটবল দলে নির্বাচিত হন এবং ১৯২৬ সালে দলটির অধিনায়ক হন। তিনি সে সময় ভারতের হয়ে বার্মা (মিয়ানমার), সিলোন (শ্রীলঙ্কা), সুমাত্রা-জাভা-বোর্নিও (ইন্দোনেশিয়া), মালয় (মালয়েশিয়া), সিঙ্গাপুর, হংকং, চীন ও ইংল্যান্ড সফর করেন। চীনের বিপক্ষে একটি ম্যাচে ভারত ৩-০ গোলে পিছিয়ে থাকার পরেও তাঁর দেওয়া চারটি গোলে ৪-৩ গোলে অবিস্মরণীয় এক জয় পেয়েছিল। তাঁর খেলা দেখে ওই সময় স্কটিশ এক ফুটবলবোদ্ধার মন্তব্য ছিল, সামাদ ইউরোপে জন্ম গ্রহণ করলে সে বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার হিসেবে স্বীকৃতি পেত।

১৯৩৩ সালে সামাদের নেতৃত্বে সর্বভারতীয় দল গ্রেট বৃটেনকে ৪-১ গোলে এবং শক্তিশালী ইউরোপীয় টিমকে ২-১ গোলে পরাজিত করেছিল। ভারতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে জীবনের শেষ খেলা খেলেছিলেন ইংল্যান্ডের সার্ভিসেস একাদশের বিরুদ্ধে।

ফুটবলে যখন সিজন ব্রেক চলতো, তখন সামাদ করতেন এক মজার কাজ। তৎকালীন জমিদাররা তাকে ভাড়া করে নিয়ে যেত খেপ খেলতে। ম্যাচ শুরুর আগে তিনি তাদের জিজ্ঞেস করতেন কত গোল দিবো? জমিদাররা ৫-৬ গোলের কথা বলতো। পুরো ম্যাচে সামাদ বল নিয়ে নেচে বেড়াতেন, কেউ তার থেকে বল নিতে পারতো না, কিন্তু তিনি গোল দিতেন না। ৭০-৭৫ মিনিটের সময় উদ্বিগ্ন জমিদার তাকে গোল দেয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেতিনি তাদের শান্ত হতে বলতেন, এরপর ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে ৫-৬ গোল দিয়ে চুক্তির টাকা নিয়ে যেতেন।

ক্যারিয়ারের গোধূলি লগ্নে কলকাতা মোহামেডানে খেলে অবসর নেন সামাদ। অনেক ফুটবলপ্রেমি সামাদের অবসরের পর পর ফুটবল খেলা দেখাই ছেড়ে দেন। এতটাই প্রভাবশালী ছিলেন এই জাদুকর সামাদ।

সামাদের অসাধারণ ক্রীড়ানৈপুণ্য দেখে ইংল্যান্ডের তৎকালীন সেরা লেফট্ আউট কম্পটন চমকে উঠেছিলেন, ধারণা ছিল না এমন খেলোয়াড় এদেশে দেখতে পাবো!

ইংল্যান্ডের কৃতি ফুটবলার এলেক হোসি একবার বলেছিলেন, বিশ্বমানের যেকোনো ফুটবল দলে খেলবার যোগ্যতা সামাদের রয়েছে। এই মন্তব্য থেকেই সামাদের অবস্থান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

একবার আফ্রিকায় এক সফরের সময় ষড়যন্ত্র করে তাকে অধিনায়ক না করায়, সামাদ অভিমানে দল থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। সামাদবিহীন সর্বভারতীয় দলটি সেবার তেমন কোনো সাফল্যই দেখাতে পারেনি। ১৯৩৬ সালে খেলার সময় গুরুতর আহত হবার পর তিনি আর তেমন করে খেলতে পারেননি কোনোদিনই। তাঁর আহত হবার ঘটনা তীব্রভাবে নাড়া দিয়েছিল তৎকালীন অবিভক্ত উপমহাদেশের ফুটবল-জগতকে।

খেলার মাঠে প্রতিনিয়ত অবিশ্বাস্য ঘটনার জন্ম দিতেন সামাদ। তেমনি একটি ঘটনা ঘটেছিল একবার ইন্দোনেশিয়ায়। সর্বভারতীয় ফুটবল দল গিয়েছিল ইন্দোনেশিয়ার জাভায়। খেলা চলাকালে ইন্দোনেশিয়ার বেশ কজন খেলোয়াড়কে কাটিয়ে গোলপোস্ট লক্ষ্য করে তীব্র শট করলেন সামাদ। বল গোলপোস্টের ক্রসবারে লেগে ফিরে এলো মাঠে। বিস্মিত হলেন তিনি। গোল হলো না কেন? কিছুক্ষণ পর আবারো সামাদের তীব্র শটের বল ইন্দোনেশিয়ার গোলপোস্টের ক্রসবারে লেগে ফিরে এলো।

এবার সামাদ রেফারিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন, গোলপোস্টের উচ্চতা কম আছে। তা না-হলে, আমার দুটো শটেই গোল হতো ফিতে দিয়ে মেপে দেখা গেল সত্যিই গোলপোস্টের উচ্চতা স্ট্যান্ডার্ড মাপের চেয়ে চার ইঞ্চি কম রয়েছে! আরেকবার মাঠের মধ্যস্থল থেকে বল নিয়ে সব খেলোয়াড়কে বোকা বানিয়ে বল ড্রিবলিং করে নিক্ষেপ করলেন গোলে, বল গোলে প্রবেশ না করে গোলপোস্টের কয়েক ইঞ্চি উপর দিয়ে বাইরে চলে গেলে রেফারি বাঁশি বাজিয়ে বলকে আউট ঘোষণা করলে সাথে সাথে সামাদ তা গোল হয়েছে বলে চ্যালেঞ্জ করে বসলেন।

আমার শটে নিশ্চিত গোল হয়েছে। সামাদের শটের মেজারমেন্ট কোনোদিন ভুল হয়নি। গোলপোস্ট উচ্চতায় ছোট। মেপে দেখা গেল সত্যিই তাই।

ফুটবল নিয়ে সেই কিশোর বয়স থেকে অনুশীলন করতে করতে সামাদ পরিণত হয়েছিলেন ফুটবলের এক মহান শিল্পীতে। একবার খেলার আগ মুহূর্তে মাঠের চারদিকে পায়চারী করে এসে সামাদ ক্রীড়া কমিটির কাছে অভিযোগ করলেন এ মাঠ আন্তর্জাতিক মাপ হিসেবে ছোট বিধায় এ মাঠে আমাদের টিম খেলতে পারে না। পরে মাঠ মাপার পর তার অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হয়। তাঁর খেলোয়াড়ী জীবনের এমন বহু ঘটনা আজো দেশ-বিদেশের ক্রীড়াঙ্গনে অগণিত সামাদ ভক্তের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়।

বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকের কথা, একদিন বিকেলে কলকাতার ইডেন গার্ডেন-এর বিপরীত দিকের ফুটপাত ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন প্রায় ছয় ফুট লম্বা একজন লোক। হঠাৎ তাঁর পাশে গাড়ি থামিয়ে নেমে এলেন স্বয়ং তৎকালীন বাংলার গভর্নর এবং তাঁর কন্যা। গভর্নর সোজা এগিয়ে গিয়ে আঁকড়ে ধরলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় গভর্নরের সঙ্গী-সাথীদের সবাই হতভম্ভ। লম্বা লোকটির হাত ধরে কুশল বিনিময় করলেন। তারপর, নিজ কন্যাকে ডেকে বললেন, এসো, ফুটবলের জাদুকরের সঙ্গে পরিচিত হও (Meet the wizard of football)। কথিত আছে, ফুটবল জাদুকর সামাদের সোনার মূর্তি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে।

দারিদ্রের কষাঘাতে বিনাচিকিৎসায় ১৯৬৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি এই ফুটবলের জাদুকর মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে একবার তিনি বলেছিলেন, আমি তো নিঃশেষ হয়ে গেছি। আমার প্রাপ্য মর্যাদা আমি পেলাম না। আমি ধুঁকে ধুঁকে মরে যাব সেটাই ভালো। কারো করুণা এবং অনুগ্রহের প্রত্যাশী আমি নই।

পার্বতীপুর শহরের ইসলামপুর কবরস্থানে সমাহিত করার দীর্ঘ ২৫ বছর অবহেলিত ও অরক্ষিত থাকার পর ১৯৮৯ সালে ৫২ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয় স্মৃতিসৌধ। তাঁর স্মরণে একটি স্মারক ডাক টিকেট প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সরকার। পার্বতীপুরে রেলওয়ে নির্মিত সামাদ মিলনায়তন নামে একটি মিলনায়তন আছে।

সামাদকে বর্তমান প্রজন্ম চেনেনা, চিনবেই বা কি করে? বছরে কখনো কোন রাষ্ট্রীয় উপলক্ষ্যে তো তার নাম উচ্চারিত হয়না!   ফুটবলের জাদুকর সামাদকে এ প্রজন্মের সাথে কিঞ্চিৎ পরিচিত করে তোলার উদ্যেশ্যেই এ লেখা।

সূত্রঃ উইকিপিডিয়া, কালের কন্ঠ, দৈনিক সংগ্রাম
সংকলনেঃ বোরহান উদ্দিন