সভ্যতা

ভারতের প্রাচীনতম ৪ জাতিগোষ্ঠীর ইতিহাস

সভ্যতা রবিবার, ১৪ এপ্রিল ২০১৯ ০৫:২৭:৪০

ভারতের প্রাচীন জাতিসমূহের একটি তালিকা করলে সেই তালিকা লম্বা থেকে লম্বাতর হবে৷ কেননা যুগ যুগ ধরে ভারতভূমিতে বিভিন্ন জাতিসত্তার আগমন ঘটেছে। ভিন্ন ভিন্ন জাতির মিশ্রণে ভারতে স্থাপিত হয়েছিল জাতিগত বৈচিত্র‍্য। ইতিহাসবিদরা ভারতের প্রাচীন জাতিদের অনেক দলেও ভাগ করলেও আধুনিক গবেষকগণ মোটামুটিভাবে এ তালিকা কমিয়ে বৈশিষ্ট্যের বিচারে চার জাতির কথা সামনে এনেছেন। এই চার জাতিসত্তাই ভারতের প্রাচীনতম জাতি হিসেবে পরিচিত। আদিম জঙ্গলবাসী উপজাতি, মঙ্গোলীয়, দ্রাবিড় এবং আর্যদের আগমনে ভারতভূমি হয়েছিল সাংস্কৃতিক দিক থেকে বৈচিত্র্যময়। ভারতের ইতিহাসের প্রাচীনতম এ জাতিসমূহের ইতিহাসই আজকের নিবেদন।

আদিম জঙ্গলবাসী উপজাতি

ভারতের বনভূমি বেষ্টিত অঞ্চলে প্রাচীনকাল হতেই এক শ্রেণীর মানুষ বসবাস করে আসত। এই উপজাতিরা কোল, ভীল, গোল্ড, ও সাঁওতাল নামে পরিচিত ছিল। এরা দেখতে বেঁটে, থ্যাবড়া নাক, ঘন চুল ও গায়ের রঙ কালো ছিল। ছোট নাগপুর এবং ওডিশাতে এখনো কোঁল ও সাঁওতালদের দেখতে পাওয়া যায়। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশের উত্তরে ভীলদের অস্তিত্ব রয়েছে। আর মধ্যপ্রদেশের দক্ষিণে গোল্ডদের অবস্থান। প্রাচীন ভারতের পাঞ্জাব থেকে তামিলনাড়ু পর্যন্ত এ জাতিসমূহের অবাধ বিচরণ ছিল। এদের ভাষা ছিল পলেনেশিয়া, মেলেনেশিয়া ভাষা গোত্রের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। এরা কখনোই ভারতের মূলধারায় আসতে পারেনি কিংবা আনা হয়নি। কোন কোন পণ্ডিতের মতে এরাই ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন জাতিগোষ্ঠী।

মঙ্গোলীয় জাতি

তিব্বত এবং মঙ্গোলিয়া থেকে উত্তর পূর্ব পাহাড়ি পথ ধরে সর্বপ্রথম এরা ভারতে প্রবেশ করে। এদের আদিভূমি হচ্ছে তিব্বত ও মঙ্গোলিয়া। মঙ্গোলীয় গোত্রের মানুষ আকারে বেঁটে, দেহ সুগঠিত, শক্ত চিবুক, দাঁড়ি-গোফ প্রায় নেই, গোলাকার মুখাবয়ব এবং চামড়া হলদেটে হয়। চীনা, জাপানী আর বার্মাদের সমগোত্রীয় এই শাখা বর্তমানে হিমালয়ের পাদদেশে সিকিম, আলমোরা, গারহওয়াল, ভুটান এবং আসামের পাহাড়ে বসবাস করছে। ভারতে মঙ্গোলীয়ানদের উত্তর পুরুষ হিসেবে গুর্খা, ভুটিয়াদের চিহ্নিত করা হয়।

দ্রাবিড় জাতি

ভারতের প্রাচীন জাতিসমূহের মধ্য দ্রাবিড়রা খুব গুরুত্বপূর্ণ। দ্রাবিড়দের আদিভূমি কোথায় তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়না। কারো কারো মতে দ্রাবিড়রা পুরোপুলীয় যুগে কোল এবং ভীলদের মত ভারতের আদিবাসী গোত্র ছিল। তবে দ্রাবিড়রা কোল ও ভীলদের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিসম্পন্ন জাতি ছিল। আধুনিক গবেষণায় উঠে এসেছে, দ্রাবিড়রা দক্ষিণে ইন্দো-আফ্রিকার পথ ধরে ভারতে এসেছিল। গবেষকদের মতে, এরা ছিল আফ্রিকার নিগ্রোদের অন্তর্ভুক্ত। তবে অন্য একটি গবেষণা বলছে,  সিন্ধু সভ্যতা আবিস্কারের পর হরপ্পা ও মহোঞ্জাদারোতে যে আদিবাসীদের অস্তিত্ব পাওয়া যায় তারাই দ্রাবিড় জাতি। দ্রাবিড়দের উৎস সম্পর্কে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য মতবাদ হচ্ছে, এরা মেকরান সমুদ্র উপকূল থেকে কিংবা উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের পাহাড়ি পথ ধরে ভারতে পা রেখেছিল। এক সময় দ্রাবিড় জাতি সমগ্র উত্তর ভারতে নিজেদের আধিপত্য কায়েম করেছিল। বর্তমানে দক্ষিণ ভারতে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু দ্রাবিড়দের সন্ধান পাওয়া যায়। ভারতের উত্তর প্রদেশ এবং বাংলাদেশের কিছু উপজাতীয় গোষ্ঠীর দেহবিন্যাসে দ্রাবিড় রক্তের প্রমাণ পাওয়া যায়। কৃষিকাজে পারদর্শী দ্রাবিড়রা ছিল বেশ শান্তিপ্রিয় জাতি। তারা সেচের প্রয়োজনে বাঁধ দেয়া জানত। দ্রাবিড়রাই সর্বপ্রথম ভারতে আদিম অবস্থাকে অতিক্রম করে নগরের সূচনা করে এবং রাষ্ট্র কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে। প্রাচীন মিশর, প্যালেস্টাইন, পারস্য, এশিয়া মাইনর, ব্যাবিলন, মেসোপোটেমিয়ার সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করে দ্রাবিড়রা বাণিজ্যিক খাতেও ভারতকে এনে দিয়েছিল সমৃদ্ধি। তাদের রপ্তানি পণ্য ছিল হাতির দাঁত, স্বর্ণ, মূল্যবান পাথর, ধান, ময়ূর। আর্য ও সংস্কৃত ভাষা থেকে ভিন্ন থাকা দ্রাবিড়দের ভাষা ছিল অনেকটা উন্নত। দ্রাবিড় ভাষার সঙ্গে এখনো তামিল, তেলেগু, মালায়লাম ইত্যাদি ভাষার মিল রয়েছে। দ্রাবিড়দের সমাজ কাঠামো ছিল মাতৃতান্ত্রিক। তারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে তারা গ্রামে বাস করত। দ্রাবিড়রা বিভিন্ন দেব দেবীর পূজা করত। তারা প্রাকৃতিক শক্তিকে ভয় পেত। আর্যদের আক্রমণে এক পর্যায়ে শান্তিপ্রিয় দ্রাবিড়রা পিছু হটতে থাকে। আর্যরা তাদেরকে দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত ঠেলে দিয়ে আসে। সময়ের বিবর্তনে এক পর্যায়ে আর্য সংস্কৃতির সাথে দ্রাবিড়দের মিলন ঘটে যায়।

আর্য জাতি

প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার বছর আগে পৃথিবীতে আর্যরা আফ্রিকা থেকে বের হয়ে ইউরোপ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া হয়ে পুরো এশিয়া মহাদেশে ছড়িয়ে পড়া শুরু করে। তারো পরে এরা আরব উপদ্বীপ থেকে শুরু করে ইউরোপের রাইন নদী থেকে তুরস্কে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয়। খ্রিষ্টপূর্ব ২৫ হাজার বছরে আর্যরা টাইগ্রিস-ইউফ্রেতিস নদী পার হয়ে মধ্য এশিয়ার বিস্তৃর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তারো পরে  এদের একটি শাখা  চলে যায় ইউরোপের দিকে, অপর দলটি ইরানে নিজেদের বাস খুঁজে নেয়। আর খ্রিষ্টপূর্ব ১৮০০ অব্দের দিকে ইরানের পশ্চিমাঞ্চলের অধিবাসীরা ভারতে প্রবেশ করে। ইরানে যারা থেকে গিয়েছিল তাদেরকে বলা হয় ইন্দো-ইরানীয়। আর ভারতে যারা প্রবেশ করেছিল তাদেরকে বলা হয় আর্য। আর্যরা প্রথম জীবনে যাযাবর হিসেবে পশুশিকার করে বেড়াত। ভারতের সিন্ধু অববাহিকায় শান্তিপ্রিয় দ্রাবিড়দের উৎখাত করে তারা ভারতে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের দিকে আর্যরা লোহার ব্যবহার শিখে। লোহার কুঠারের সাহায্যে জঙ্গল পরিস্কার করে তারা লোহার তৈরি লাঙলের ফণা দিয়ে কৃষিকাজ শুরু করে৷ অনার্যদের সাথে সংঘাত সংঘর্ষে জড়িয়ে আর্যরা একটা সময় পূর্ব ভারত পর্যন্ত এগিয়ে যায়। আজকের ভারতে আর্য নামে আলাদা কোন জাতিগোষ্ঠী না থাকলেও আর্যদের সাংস্কৃতিক উপাদান জীবন্ত হয়ে আছে ভারতবর্ষের অপরাপর জাতিদের মাঝে।

তথ্যসূত্র
ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস-প্রাচীন যুগ, এ কে এম শাহনেওয়াজ
http://www.onushilon.org/animal/human/rece/arza.htm
    

লেখকঃ উবায়দুর রহমান রাজু