
সতীদাহ প্রথাঃ অন্ধবিশ্বাসের সাথে মিশে যাওয়া এক বিলুপ্ত প্রথা।
একটা কিশোরী কিংবা যুবতী মেয়েকে স্বামীর চিতার দিকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে কিছু আফিমে আসক্ত ব্যাক্তি, মেয়েটি চিৎকার করেও কিছুতে ছাড়া পাচ্ছেনা, মৃত ব্যাক্তির চিতার আগুনের আশেপাশের কেউ মেয়েটির চিৎকারে ভ্রুক্ষেপ করছেনা। অথচ যে মেয়েটি হয়তো স্বামীর সংসার কি সেটাই বুঝে উঠতে পারেনি তখনো। অকালে স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রীকে সতী প্রমাণ করতে স্বামীর চিতায় স্বামীর সাথে মৃত্যুর দিকে হাটতে বাধ্য করা হয়েছে সেই নারীকে। এমন দৃশ্য একসময় বিশেষ করে হিন্দুসমাজে অহরহ দেখা যেতো। এর মধ্যে যে কিছু নারী স্বেচ্ছায় নিজেকে সতী প্রমাণ করতে স্বামীর সাথে সহমরণে গিয়েছেন তাও অস্বীকার করার উপায় নেই।
আধুনিক যুগে নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে নারীর অধিকার আদায়ে সবাই সচেষ্ট। তাই “সতীদাহ” প্রথা পদ্ধতিটি প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস থেকে সরিয়ে ফেলা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এই “সতীদাহ” প্রথার পেছনের ইতিহাসে রয়েছে বহু হিন্দু নারীর নিষ্ঠা, শ্রদ্ধা আর চোখের জল। ভারতবর্ষে হিন্দুধর্মের অন্যতম প্রথা হিসেবে সতীদাহকে চিহ্নিত করা হতো। স্বামীর চিতায় জীবন্ত স্ত্রীর সহমরণ প্রথাকেই সতীদাহ প্রথা বলা হয়। সাধারণত বিশ্বাস করা হয় “সতী” স্বেচ্ছায় তার প্রাণ বিসর্জন করে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা যায়, যাকে সতী বানানো হতো তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে রীতিমত জোর করে স্বামীর চিতায় উঠানো হতো। তাকে দেবী রূপে কল্পনা করে স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে মারা হতো।
মৃত স্বামীর সাথে চিতায় ওঠার এই প্রথার নাম সতী, লিখেছিলেন এংলো-ইন্ডিয়ান লেখকরা। আসলে একে বলা হত ‘সহগমন’, ‘সহমরণ’ বা ‘সতীদাহ’। ‘সতীব্রত’ বলে এক প্রথা চালু ছিল, যেখানে নারী তার স্বামীকে কথা দিত, স্বামী যদি আগে গত হয়, তবে সেও সহমরণে যাবে। সতীপ্রথা পালন করা হলে নারীকে বলা হত ‘সতীমাতা’।
সতীদাহ প্রথা কোত্থেকে এলোঃ
সতীদাহের কোনো আদেশ বেদে নেই বলে জানা যায়, বরং মরণোত্তর স্ত্রীকে স্বাভাবিক জীবন পার করতেও বলা হয়েছে। সনাতন ধর্মের পুরাণে বহু চরিত্র আছেন যারা স্বামীর মৃত্যুর পর বহাল তবিয়তে বেঁচে ছিলেন। কিন্তু সহমরণ কোনো নতুন বিষয় ছিল না, এমনও নয় যে ভারতে প্রথম এমন প্রথা চালু হয়েছিল, কিংবা ভারতকে দিয়েই শেষ হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দের সহমরণের বর্ণনাও পাওয়া গেছে। তাহলে কিভাবে সতীদাহ এত প্রচলিত হয়ে পড়লো?
কোনো পরিবার থেকে একজন নারী সতী হওয়া মানে বিরাট সম্মানের বিষয়। একজন নারীর তার স্বামীর প্রতি চূড়ান্ত অধীনতা, সতীত্ব ও ধর্মপরায়ণতার লক্ষণ ছিল এই প্রথা। ছেলের মৃত্যুর পর তার বউ বাড়িতে থাকা আলাদা একটা বোঝার মতো ছিল। স্বভাবতই সব পরিবার চাইত তাদের বউটিও সহমরণে গিয়ে তার এই স্বল্পদামী জীবনের বিনিময়ে পরিবারের সম্মান বাড়াক।
যদিও “সতীদাহ” প্রথাকে হিন্দুধর্মের রীতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। হিন্দু সাহিত্য অনুসারে যিনি সতী হিসেবে পরিচিত, তিনি কিন্তু স্বামী চিতায় আত্মাহুতি দেন নি। তিনি স্বয়ং শিবপত্নী সতী। যিনি রাজা দক্ষের কন্যা হিসেবে দাক্ষায়িনী নামেও পরিচিত। পিতা দক্ষের মুখে স্বামীর নিন্দা সইতে না পেরে সেখানেই অগ্নিতে প্রাণ বিসর্জন দেন সতী। অগ্নিতে প্রাণ বিসর্জনকালে সতী প্রার্থনা করেন যে, তিনি পুনরায় জন্মগ্রহণ করতে চান। তিনি পুনরায় শিবের সঙ্গী হতে চান। নবমূর্তিতে সতীই হিমালয় কন্যা পার্বতীরূপে পরিচিত হন এবং শিবের সাথে মিলিত হন।
এছাড়াও কথিত আছে হিন্দুধর্মের সাহিত্যে সতীরূপে সাবিত্রীও বেশ পরিচিত। যিনি কিনা স্বয়ং যমদূতের হাত থেকে তাঁর স্বামী সত্যবানের প্রাণ ফিরিয়ে আনেন। সাবিত্রী স্বামী সত্যবান মারা গেলে সাবিত্রী যমরাজের কাছে তার স্বামীর প্রাণভিক্ষা চান। কিন্তু যমরাজ তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তাই স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে আনার জন্য যমের পিছু পিছু চলতে থাকে সাবিত্রী। কিছু দূর যাওয়ার পর যম লক্ষ্য করলেন, সাবিত্রী দূর্বল হয়ে পড়েছে কিন্তু এখনো তার স্বামীকেই অনুসরণ করছে। তখন যমরাজ সাবিত্রীকে স্বামীর প্রাণের বিনিময়ে বর প্রার্থনা করতে বলেন। সাবিত্রী বর চান যে, তিনি তাঁর স্বামী সত্যবানের সন্তানের মা হতে চান। যমরাজ অন্য কোনো বর চাইতে বলেন কিন্তু সাবিত্রী তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। যমরাজ নিরুপায় হয়ে অবশেষে তাঁর স্বামীর প্রাণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। এভাবেই সাবিত্রী সতীরূপে তাঁর স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে আনেন।
হিন্দু পুরাণমতে এই দুই নারীকে ভারতীয় পতিব্রতা নারীদের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়, যারা তাদের স্বামীর জন্য সবকিছু করতে পারেন। “সতী” শব্দের অর্থ হচ্ছে ধার্মিক বা ন্যায়নিষ্ঠ। কিন্তু যে দুইজন নারী সতী হিসেবে পরিচিত, তারা কিন্তু স্বামীর চিতায় স্বেচ্ছায় আত্মাহুতি দেন নি। তাই বলাই যায় “সতীদাহ” প্রথায় ধর্মীয় পটভূমির দিক থেকে সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও সামাজিক দিক থেকে ব্যাপক সংস্পর্শতা আছে।
যদিও সতীর উৎপত্তি নিয়ে অনেক তত্ত্ব ও মতবাদের প্রচলন রয়েছে। একটি ধারণা অনুযায়ী, সতীর উদ্ভব ঘটেছিল কোনো স্ত্রী যাতে তাদের স্বামীকে বিষপ্রয়োগে হত্যা না করে পুরোনো প্রেমিকের সাথে পালিয়ে যেতে না পারে। আবার অপর একটি তত্ত্ব অনুযায়ী, সতীর উৎপত্তি হয়েছিল কোনো এক ঈর্ষান্বিত রানীর চিন্তাধারা থেকে। রানীর ধারণা রাজা যদি মারা যান তবে স্বর্গে রাজাকে অভ্যর্থনা করবে শত শত অপ্সরা। তারা রাজাকে ঘিরে রাখবেন এবং রানীর থেকে আলাদা করে দেবেন। তাই যখন স্বামীর মৃত্যু হতো তখন রানীও রাজার সাথে সহমরণে যাওয়ার জন্য দাবী করতো। যখন রাজা স্বর্গে যাবেন তখন রানীও রাজার সাথে একত্রে স্বর্গের দুয়ারে পা রাখবেন এবং রাজাকে সুন্দরী অপ্সরাদের হাত থেকে রক্ষা করবেন। এছাড়াও সতীর উদ্ভব নিয়ে আরো কিছু তত্ত্ব ও ধারণা আছে।
সতীদাহ প্রথা কারা পালন করতোঃ
যদিও সতী প্রথাকে ভারতীয় আচার প্রথা হিসেবে বিবেচিত করা হয়, তবে এটি গোটা ভারতবর্ষের সকল হিন্দুর মধ্যে চর্চিত ছিল না। গুটিকয়েক সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বিভিন্ন প্রভাবশালী সম্প্রদায় যেমন মিশরীয়, গ্রিক, গথ, সিদিআনদের মধ্যেই অধিক প্রচলিত ছিল। তাদের মধ্যে রাজার মৃত্যু ঘটলে রাজার সাথে স্ত্রী, দাসী ও অন্যান্য বিভিন্ন ধনসম্পদ কবর দেয়া হতো, যাতে তারা মৃত্যু পরবর্তী জগৎ সুন্দরভাবে কাটাতে পারে। একটি মতবাদ অনুযায়ী খুব সম্ভবত সিদিআনেরাই “সতী” প্রথা ভারতে নিয়ে আসেন।
সিদিআনেরা যখন ভারতবর্ষে উপস্থিত হয় তখন তারা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পদ্ধতিটি নিজেদের মধ্যে গ্রহণ করে, যেটি পরবর্তী সময়ে শবদাহ হিসেবে পরিচিত হয়। সিদিআনেরা হচ্ছে উপজাতীয় যোদ্ধা। তারা নিজেদের হিন্দুধর্মের যাজকতন্ত্রের প্রধান হিসেবে পরিচয় দিত। অনেক রাজপুত সৈন্য বিশ্বাস করতো তাদের উৎপত্তিও সিদিআনদের থেকেই ঘটেছে। এই রীতিটি উত্তর ভারতের রাজস্থানের যোদ্ধা সম্প্রদায় ও পূর্বভারতের হিন্দুদের মধ্যে অধিক প্রভাব বিস্তার করেছিল। রাজপুতেরা যুদ্ধে শহীদ হলে তাদের পত্নী ও উপপত্নীরা স্বেচ্ছায় অগ্নিতে প্রাণ বিসর্জন দিত। এটি তাদের স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের একটি পদ্ধতি ছিল। তবে ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থানে এই পদ্ধতিটি তুলনামূলক কম প্রচলিত ছিল।
নিষিদ্ধকরণের পথে সতীদাহঃ
ভারতবর্ষের অনেক শাসক সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল। বিশেষ করে মুঘলরাও এই পদ্ধতি বন্ধ করার প্রচেষ্টা চালায়। পরবর্তীসময়ে ব্রিটিশদের সহযোগিতায় হিন্দুধর্মের সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় ১৮২৯ সালে “সতীদাহ”প্রথা নিষিদ্ধ করেন। সতীদাহ প্রথায় কতজন সতী হয়েছিল তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। এই প্রথাটি নিষিদ্ধ করার পূর্বে অর্থাৎ ১৮২৯ সালের পূর্বে প্রতিবছর প্রায় শতাধিক সতীকে দাহ করা হয়। বিশেষ করে প্রথাটি নিষিদ্ধ করার পরেও সমাজ থেকে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব হয়নি। প্রথাটি বিলুপ্ত হতে প্রায় কয়েক দশক সময় নেয়। তবে এখনো কিছু বিরল ঘটনা আছে যেখানে অনেক বিধবা নিজেকে সতী দাবী করে এবং অগ্নিতে নিজের প্রাণত্যাগ করেন।
১৯৮৭ সালে রাজস্থানের একটি গ্রামে ১৮ বছরের একজন বিধবা পরিবারের সকলের আশির্বাদ নিয়ে সতীরূপে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় এবং স্বামীর সাথে সহমরণে যান। ১৯৯৯ সালে অক্টোবর মাসে একজন বিধবা সবাইকে অবাক করে দিয়ে স্বামীর চিতায় ঝাঁপ দেন। পরবর্তীকালে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কারণ বিধবাটিকে সতী হওয়ার জন্য কোনো জবরদস্তি বা অনুরোধ কোনোটিই করা হয়নি।
ভারতবর্ষের বিভিন্ন দিক থেকে সতীকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হতো। যেসকল সমাজে পুরুষ একজন নারীকেই বিবাহ করতো, সে সকল সমাজে স্বামীর চিতাতে প্রাণ বিসর্জন করাই স্ত্রীর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল। যেসকল বিধবা সতীরূপে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতো, তারা সমাজে উচ্চমর্যাদায় আসীন হতো। তাদের পরিবারও সমাজে অধিক মর্যাদা পেত। তবে যেসকল পুরুষ বহুবিবাহ করতো, সেখানে একজন স্ত্রী সতী হওয়ার জন্য অনুমতি পেত। সেই স্ত্রী তার স্বামীর অপেক্ষাকৃত প্রিয় স্ত্রী হতো। তবে অনেকসময় বহুবিবাহ করলে সকল স্ত্রী অগ্নিতে প্রাণ বিসর্জন করতে পারতো। অনেকসময় দাসীরাও তাদের মনিবের চিতায় আত্মহননের পথ বেছে নিত।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে মজার কিছু ব্যপার লক্ষ্য করা যায়। অনেকসময় মা তার সন্তানের চিতায় ঝাঁপ দিত। এর চেয়েও বিরল ঘটনা লক্ষ্য করা যায় অনেক সময় স্বামী তার স্ত্রীর চিতায় ঝাঁপ দিত। সে যাই হোক, সেসব দিন পেরিয়ে আমরা এখন অনেক উন্নত প্রযুক্তির সাথে ডিজিটাল দুনিয়ায় পা রেখেছি, কিন্তু তাই বলে আমাদের ঐতিহ্য কিংবা সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা এই অধ্যায়গুলো কখনো ভোলা যাবে না।
লেখকঃ এস এম সজীব