
চীনের মহাপ্রাচীর : পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম নিদর্শন
পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের মধ্যে সবগুলো মানুষকে সমানভাবে অাকর্ষন করে না। যে কয়েকটি অাশ্চর্য যুগ যুগ ধরে মানুষের অাকর্ষন কে তিব্রভাবে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে চীনের মহাপ্রাচীর তার মধ্যে অন্যতম। এইপ্রাচীর সম্পর্কে মানুষের অাকর্ষন পূর্বে যেমন ছিল বর্তমানে চীনের পর্যটক বান্ধব নীতির জন্য তা অনেকাংশে অারও বৃদ্ধি পেয়েছে। তার উপরে এর বিশালতা ও স্থাপত্য কৌশল সহজেই যে কাউকে বিমোহিত করার সক্ষমতা রাখে। এই প্রাচীর একদিকে যেমন মানুষকে তার দিকে অাকর্ষন করে একইভাবে মানুষের মনে জন্মদেন নানা প্রশ্নেরও। এতকাল পূর্বে পর্বত ঘেরা বিশাল অঞ্চলজুড়ে কিভাবে তৈরি হয়েছিল এই বিশাল স্থাপনা? কেন তৈরি করা হয়েছিল এটি? কারা তৈরি করেছেন? এরকম অারো নানা প্রশ্ন। এসকল প্রশ্ন ও চীনের মহাপ্রচীর সম্পর্কে সকল অাদ্যপান্ত তুলে ধরার চেষ্টা করছি অাজকের লেখায়।
চীনের মহাপ্রাচীরের দৈর্ঘ্য প্রায় ২১,১৯৬ কি.মি, উচ্চতা ১৬-২৬ ফুট ও প্রশস্ততা ৩২ ফুট। কথিত অাছে চীনের মহাপ্রাচীরের উপর দিয়ে একসাথে ১২টি ঘোড়া পাশাপাশি দৌড়াতে পারে। এটি তৈরি হয়েছিল পাথর,মাটি,পোড়া ইট ও শুরকির সমন্বয়ে। এটি কখনো পাহাড় পর্বত অাবার কখনো সমতল ভূমি অাবার কখনো বা নদী নালার উপর দিয়ে গমন করে চলে গেছে। তাই এর নির্মাণকাজ ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও পরিশ্রমসাধ্য। বর্তমানে অামরা যে দৃশ্যমান প্রাচীর দেখছি তা একবারে তৈরি হয় নি। বেশ কয়েকবার নির্মাণ ধাপ পেরিয়ে অাজকের দৃশ্যমান অংশটুকু টিকে রয়েছে। ধারনা করা হয় খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতকে এই অঞ্চলের সম্রাট নিজেদের কে বহিশত্রুর হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য চীনের উত্তর অঞ্চলে একটি প্রাচীর নির্মাণ করেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এর বেশকিছু অংশ ধ্বংস হয়ে যায়। খ্রিষ্টপূর্ব ২২০-২০০ এই সময়ে চীনের তৎকালিন কিন রাজবংশ এই পুনরায় এই নির্মাণকাজ শুরু করেন। কিন রাজা ছিন শি হুয়াং ছিলেন একজন বীর যোদ্ধা ও রাজ্যবিজেতা। তিনি পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমুহ জয় করলে নিজ অধিগৃহীত অঞ্চল সুরক্ষা করাই প্রধান দ্বায়িত্ব হয়ে যায়। কেননা এই পরাজিত অঞ্চলের শাসকদের পুনরায় অাক্রমন তার উপরে যাযাবর মঙ্গলদের অাক্রমনের হাত থেকে বাচার জন্য প্রাচীরের নির্মাণ কাজে হাত দেন এবং এটি সম্পন্ন করে তার উদ্দ্যেশ্য সফল করেন।
মধ্যেযুগে যখন চীনের রাজ ক্ষমতায় মিং রাজবংশ তখন হুট করে সেপ্টেম্বর ১৫৫০ সালের কোন একদিন মঙ্গোলিয়ান যাযাবর জাতির নেতা চেঙ্গিস খান এর উত্তরসূরী দারাই সুং গুদেনখান। শান্ত চীনা ভূখন্ডে আক্রমন করে বসে অস্ত্রসজ্জিত ক্ষুধার্ত মঙ্গলিয়ানরা । রাজধানীর ৭০ মাইল দূরের জনপদে চলে গণহত্যা , লুণ্ঠন , আর যুদ্ধবন্দী করার নির্মমতা । এটি ছিল চীনের মাটিতে মঙ্গোলিয়ানদের সবথেকে ভয়াবহ আক্রমণ । তখন চীনের সম্রাটকে তারা একজন অন্ধ বন্দীর মাধ্যমে তাদের দাবি পেশ করে যে, মঙ্গোলিয়ানদের সাথে কুটণৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে ও ব্যবসাবাণিজ্য করতে হবে । তাহলে তারাও উন্নয়ন করতে পারবে নিজেদের ভূখন্ড । সম্রাট তার সভাসদ দের বুদ্ধিতে তাদের কাছে কিছুটা সময় চান এবং দির্ঘ একমাসের ধ্বংসযজ্ঞের পর মঙ্গলিয়রা নির্দিষ্ট সময়ের প্রতিশ্রুতি পেয়ে নিজ অঞ্চলে ফিরে যায়। এই সময়ের মধ্যে মিং সম্রাট তার রাজধানী বেইজিং কে সুরক্ষিত করার জন্য ধ্বংসপ্রায় প্রাচীরকে অাধুনিকরূপে নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এই নির্মাণ কাজের দ্বায়িত্ব দেয়া হয় তৎকালিন সবচাইতে চৌকশ সামরিক অফিসার ছি চি গুয়াং। তিনি বেইজিং কে সুরক্ষার জন্য উত্তর ও উত্তর পূর্বদিক দিয়ে সমগ্র চীনকে প্রাচীর বেষ্টিত করার নকশা করেন।কিন্তু ইতোমধ্যে সম্রাটের সভাসদগন এইরূপ বিশাল প্রাচীর নির্মাণের ব্যয় ও পরিশ্রশের কথা বিবেচনা করে তার বিরোধীতা শুরু করেন। তা সত্তেও সম্রাট ছি চি গুয়াং কে এর নির্মাণ শুরু করার নির্দেশ দান করেন। এরপরই ১৫৬৯ সালে শুরু হয় নির্মাণকাজ। প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক ৬বছর কঠোর পরিশ্রম করে ১৫৭৫ সালে এর প্রথম ধাপের কাজ সমাপ্ত করেন। গড়েতবে এই প্রাচীর নির্মাণের কাজ মোটেই সহজ ছিল না এটি তৈরি করতে গিয়ে এর নির্মাণ শ্রমিকদের উপর নেমে অাসে অমানুষিক নির্যাতন প্রাচীরের প্রতিটি পোরা ইটের ওজন ছিল ৭০কেজি যা পাহাড়ের উপর তুলে একটার সাথে আরেকটি গেঁথে তৈরি করা হতো প্রাচীরের দেয়াল। কয়েকশ ফুট দেয়াল তৈরির পর পর তৈরি করা হতো একটি করে টাওয়ার। প্রতি ২৫০জন মিলে একটি করে টাওয়ার তৈরি করার ৩/৪ দিন সময় বেধে দেয়া হতো এর হের ফের হলে শ্রমিকদের উপর নেমে অাসতো অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন। এমন করেই তৈরি হয়েছে সম্পুর্ন প্রাচীরের নির্মাণকাজ।
প্রাচীরটিতে তিন স্তর বিশিষ্ট প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা গড়ে তোলা হয়। প্রথম স্তরে ছিল পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, দ্বিতীয় স্তরে ছিল সিগনাল টাওয়ার যার কাজ ছিল প্রথম স্তর থেকে কোন শত্রুর অাগমনের খবর পাওয়ার সাথে সাথে তা পাঠানো হবে তৃতীয় স্তরে যেখানে গোলাবারুদ ও কামান সজ্জিত সৈন্যরা অপেক্ষা করছে। সেখান থেকে তারা তাদের অবস্থান অনুযায়ী অাক্রমন করে শত্রুদের বিনাশ করবে।
১৫৭৬ সালে যাযাবর মঙ্গলরা অাবার মিং সাম্রাজ্য অাক্রমন করল কিন্তু এই মহাপ্রাচীরের অকার্যকারিতার জন্য তারা মিংদের কোন ক্ষতিই করতে পারেনি বরং উল্টো নিজেরা পরাজিত হয়ে ফিরে যেতে হয়। এরপর চীন সাম্রাজ্যে যে শাসক বংশই অাসুক না কেন তারা এই প্রাচীরের কার্যকারিতা কে যথেষ্ট যত্নের সাথেই রক্ষা করেছে। বর্তমানে বিশ্ববাসী যে মহাপ্রচীর দর্শন করছে এটি এই মিংদের নির্মিত প্রাচীরটিই।
বর্তমানে চীন প্রশাসক এই প্রাচীরকে নিজেদের প্রতিরক্ষা হিসেবে সংরক্ষণ না করলেও গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন হিসেবে এর রক্ষণাবেক্ষণ ভালই করছে। যার ফলে এখানে দৈনিক গড়ে ৭০ হাজার পর্যটক ভীড় জমায় এটি দর্শন করার জন্য।
উৎস:
https://www.chinahighlights.com/greatwall
https://m.somewhereinblog.net/mobile/blog/sudipto007/29895230
https://www.hybridknowledge.info/2013/07/great-wall-of-china.html?m=1
লেখকঃ ফরিদ মোল্লা