সভ্যতা

যেভাবে ‘আমেরিকা’ আর ‘লাতিন আমেরিকা’

সভ্যতা রবিবার, ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৬:১২:৩৫

লাতিন আমেরিকা বলতে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের এমন অঞ্চলগুলোকে বোঝায় যেখানকার জনগণ লাতিন ভাষা থেকে উদ্ভূত রোমান্স বা রোমানিক ভাষাসমূহে কথা বলে। এ ধরণের ভাষা বলতে মূলত স্পেনীয় এবং পর্তুগিজ ভাষাকে বুঝায়। এই অঞ্চলটির একপাশে রয়েছে অ্যাংলো-আমেরিকা অঞ্চল যেখানকার মানুষ প্রধানত ইংরেজি ভাষায় কথা বলে।

এখানে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে স্পেনীয় ভাষার ছড়িয়ে পড়া প্রসঙ্গে একটু বলে নেওয়া যাক। ১৬শ শতকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে স্পেনীয় উপনিবেশ স্থাপনের মধ্য দিয়ে স্পেনীয় ভাষা দুই আমেরিকা মহাদেশ, ফিলিপিন্স ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

বর্তমানে এটি প্রায় ৩৯ কোটি লোকের মাতৃভাষা, এবং সব মিলিয়ে বিশ্বের প্রায় ৪১ কোটি লোক এই ভাষায় কথা বলেন। এদের অধিকাংশই স্পেন ও দক্ষিণ আমেরিকায় বাস করেন। স্পেনীয় ভাষাভাষীর সংখ্যা অনুযায়ী মেক্সিকো বৃহত্তম দেশ। তারপরেই আছে কলম্বিয়া, স্পেন, আর্জেন্টিনা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের ২১ টি দেশ লাতিন অঞ্চলের আওতায় পড়ে। এর মধ্যে দক্ষিণ আমেরিকার ১০টি, মধ্য আমেরিকার ৬টি, ক্যারিবীয় অঞ্চলের ৩টি ও উত্তর আমেরিকা মহাদেশের ১টি দেশ রয়েছে।

এক নজরে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশে পড়া লাতিন আমেরিকার দেশগুলো হচ্ছে: আর্জেন্টিনা (স্পেনিস), বলিভিয়া (স্পেনিস), ব্রাজিল (পর্তুগিজ), চিলি (স্পেনিস), কলম্বিয়া (স্পেনিস), ইকুয়েডর (স্পেনিস), প্যারাগুয়ে (স্পেনিস), পেরু (স্পেনিস), উরুগুয়ে (স্পেনিস) এবং ভেনেজুয়েলা (স্পেনিস)। মধ্য আমেরিকা: পানামা (স্পেনিস), এল সালভাদর (স্পেনিস), গুয়েতেমালা (স্পেনিস), হন্ডুরাস (স্পেনিস), নিকারাগুয়া (স্পেনিস) এবং কোস্টারিকা (স্পেনিস)।

ক্যারিবীয় অঞ্চল: কিউবা (কিউবান-স্পেনিস), হাইতি (ফ্রেঞ্চ অর্থাৎ ফরাসী) এবং ডমিনিকান প্রজাতন্ত্র (ফ্রেঞ্চ)। উত্তর আমেরিকা মহাদেশ: মেক্সিকো (স্পেনিস)। এছাড়াও এসব অঞ্চলের কিছু স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল লাতিন আমেরিকার আওতাভূক্ত।

উত্তর আমেরিকা আর দক্ষিণ আমেরিকা দুটি স্বতন্ত্র মহাদেশ হলেও আমেরিকা মহাদেশের আবিষ্কারক ক্রিস্টোফার কলম্বাস। কিন্তু কলম্বাসের নামে মহাদেশ দুটোর একটারও নাম হলো না কেন? এ নিয়ে কিছু জটিলতা আছে।

ওই সময়টা এমন ছিল যে, একসময়ের অন্ধকার ইউরোপ জেগে উঠছে। মহাদেশটির তুলনামূলক অগ্রসর দেশগুলোর শাসকশ্রেণি আর অভিজাতরা জেনেছে মোগলদের অধীনে ঐশ্বর্য্যশালী ভারতের কথা। একদিকে ইউরোপে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ, প্রভুত্বের দাম্ভিকতা অপরদিকে সোনা-হীরা তথা বিশাল ধনরত্নের ভাণ্ডার করায়ত্ব করার নেশায় তাদের দিনমান কাটতো বলা যায়। এর আগেই অবশ্য আফ্রিকায় তারা শোষণ-শাসন- ত্রাস শুরু করে দিয়েছে।
অন্য দেশের সম্পদ ছল-ছূতোয় আর বল প্রয়োগে আহরণ করা রাজাদের আদিমতম সংস্কৃতি। আর সেই মনোবৃত্তিতে ভর করে নতুন দেশ আবিষ্কার নয়, বরং সহজে দ্রুত ভারতবর্ষে পৌঁছানোর পথ খুঁজতে লাগলেন রাজশক্তির আনুকূল্যপ্রাপ্ত অনেক ইউরোপীয় নামিদামি নাবিক। এদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন ইতালীয় নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস। ভারতে পৌঁছানোর সহজতম জলপথ আবিষ্কারের নেশায় কলম্বাস রীতিমত অস্থির সময় পার করছিলেন।

স্পেনের রানী ইসাবেলার সহযোগিতায় ১৪৯২ সালে কলম্বাসের নেতৃত্বে তিনটি জাহাজ আটলান্টিকের বুকে ভাসে। উত্তাল আটলান্টিকের ঝড়-ঝঞ্ঝা-ঢেউ পার হয়ে, সুবিশাল প্রশান্ত মহাসাগরও পেরিয়ে যান তিনি। নানান সামুদ্রিক দুর্যোগ মোকালেলার পর, অনেক ক্ষতি স্বীকার শেষে দুই মাসেরও বেশি সময় পর জাহাজ স্থলভূমির দেখা পায় অভিযাত্রী দলটি।

কলম্বাস আনন্দে নেচে উঠলেন। যাক ভারতের উপকূলে এসে পৌঁছা গেছে তাহলে! কিন্তু ভুল বুঝেছিলেন তিনি। ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দের ১২ অক্টোবর যে দ্বীপে গিয়ে কলম্বাস পৌঁছান সেটা বাহামা দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত, আগে নাম ছিল সান সালভেদর। বর্তমান নাম ওয়াটলিং আইল্যান্ড।

কলম্বাস স্পেনের রাজা ফার্ডিনান্ড ও রানী ইসাবেলার সম্মানে এই দ্বীপের নাম রাখেন সান সালভেদর। আটলান্টিক মহাসাগরের এই তাবৎ দ্বীপপুঞ্জ এখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ নামে পরিচিত। এরপর কলম্বাস জাপানের পথে পাড়ি দিতে গিয়ে সান সালভেদরের দক্ষিণে হিসপানিয়োলা আর তারপর কিউবায় গিয়ে পৌঁছান।
ভারতবর্ষ আবিষ্কার করতে না পেরে ব্যর্থ মনোরথে কলম্বাস ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দের ১৩ মার্চ স্পেনে ফেরেন।

ভারতবর্ষের খোঁজে ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২৪  সেপ্টেম্বর ফের সমুদ্রযাত্রায় বের হন কলম্বাস। সেবারও তিনি ভারতবর্ষ খুঁজে পাননি, আবিষ্কার করেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জের পুয়ের্তো রিকো ও জ্যামাইকা। ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় সমুদ্রযাত্রায় তিনি প্রথমে ত্রিনিদাদ আর তারপর গিয়ে পৌঁছান দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের বর্তমান ভেনিজুয়েলায়।

অপরদিকে, সমুদ্রপথে ধনসম্পদে পূর্ণ ভারত আবিষ্কারে কলম্বাস ও অন্যদের একের পর এক ব্যর্থতার ডামাডোলে স্পেনীয় এক নাবিক জানালেন, যা কলম্বাস আবিষ্কারের দাবি করছেন সেটি ভারত নয় এবং ওই দেশটি তিনি আগেই আবিষ্কার করে এসেছেন। তার দাবিমতে, ১৪৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুন তিনি ওই মহাদেশটির মূলভূমি আবিষ্কার করে এসেছেন।

পরবর্তীতে আমেরিগো ভেসপুচ্চি নামের ওই নাবিকের নামানুসারেই দুটি মহাদেশেরই নারমকরণ হয় ‘আমেরিকা’ নামে। তবে একটি উত্তর আমেরিকা আর অপরটি দক্ষিণ আমেরিকা পরিচয় পায়। কলম্বাস যেমন স্পেনের রাজা ও রানির সাহায্যে সমুদ্রযাত্রা করেন, আমেরিগো ভেসপুচ্চিও তেমনি পর্তুগিজ সরকারি সহায়তায় অভিযানে নেমে সমুদ্রপথে বর্তমান দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলে গিয়ে উপস্থিত হন।

ভেসপুচ্চি বুঝেছিলেন কলম্বাস যাকে ভারতবর্ষ ঠাওরান সেটা আসলে একটা অনাবিষ্কৃত নতুন মহাদেশ। বাস্তবেই কলম্বাস ভুল করেছিলেন। আর তাই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং তুলনামূলক বিশ্লেষণী ক্ষমতার অধিকারী ভেসপুচ্চির নিজের সমুদ্রযাত্রার বিষয়ে লেখা পণ্ডিতদের কাছে বিশেষ কদর পায়। নয়া মহাদেশ আবিষ্কার নিয়ে তার লেখা এবং বক্তব্য এতটাই প্রসিদ্ধি লাভ করে যে, তাকেই নয়া দেশের আবিষ্কারক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

তবে প্রথমত আমেরিগো ভেসপুচ্চির সম্মানার্থে জার্মানির ভূগোলবিদ মুলার-ই নয়া আবিষ্কৃত ওই ভূখণ্ডটির (দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিল) নাম দেন আমেরিকা। ‘আমেরিগো’ না বলে ‘আমেরিকা’ বলার কারণ হলো, লাতিন ধাঁচে আমেরিগো ভেসপুচ্চি হয়ে যায় আমেরিকুস ভেসপুকিউস। আর আমেরিকুস থেকে রূপ পায় আমেরিকা।

আমেরিকা নামটা এতই প্রচলিত হয়ে পড়ে যে, দক্ষিণাংশের দেশ  ব্রাজিল থেকে সমগ্র মহাদেশেরটির নাম হয়ে যায় আমেরিকা এরপর উত্তরাংশের নামও হয়ে পড়ে আমেরিকা। অর্থাৎ শুধু নামের আগে উত্তর আর দক্ষিণ যোগ হয়ে দুই দুটি মহাদেশ একই নামে পরিচিত পায়। তবে আজকের বাস্তবতায় শুধু ‘আমেরিকা’ বলতে সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রকেই বোঝায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডটি পশ্চিমে প্রশান্ত ও পূর্বে আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝে অবস্থিত। এছাড়াও ক্যারিবীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অনেক এলাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিকারভুক্ত। দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী এই দেশটির উত্তর ও দক্ষিণ সীমান্তে অবস্থিত যথাক্রমে কানাডা ও মেক্সিকো। মহাদেশের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত আলাস্কা রাজ্যের পূর্ব সীমায় কানাডা ও পশ্চিমে বেরিং প্রণালী পেরিয়ে অবস্থান মার্কিনীদের চির প্রতিদ্বন্ধী রাশিয়ার।

সূত্র: উইকিপিডিয়া, আমেরিকান হিস্ট্রি

লেখকঃ আহসান হোসেন