
প্রাচীন চীনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কাহিনী
এক সাম্রাজ্য থেকে আরেক সাম্রাজ্য, এক সাম্রাজ্যের কবর থেকে রচিত হয় আরেক নতুন সাম্রাজ্য। রচনা হয় নতুন ইতিহাস, চাপা পড়ে যায় পুরনো কাহিনী। প্রাচীন ও মধ্যযুগে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার রীতি ছিল এমনই। এক সাম্রাজ্যের বিনাশ করতে দরকার পড়ত লাখ লাখ সৈন্য, তাজা প্রাণ। রক্তক্ষয়ী এসব যুদ্ধ ইতিহাসে আজো আলোচিত। আজ আমরা প্রাচীন চীনের এমন কয়েকটি যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করব যেসব যুদ্ধের ফলাফল হিসেবে এক সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তুপের ওপর প্রতিষ্ঠা পায় ভিন্ন আরেক নতুন সাম্রাজ্য।
মুয়ের যুদ্ধ, ১০৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
চীনের নিয়ন্ত্রণ নিতে উপজাতি গোত্র ঝু এর সাথে শেং সাম্রাজ্যের এই যুদ্ধ ইতিহাসে পরিচিত ব্যাটল অফ মুয়ে নামে। ৫০ হাজার সুদক্ষ উপজাতি সৈন্য নিয়ে শেং সাম্রাজ্যের ৫ লক্ষ ৩০ হাজার নিয়মিত সৈন্য এবং ১ লক্ষ ৭০ হাজার সশস্ত্র দাস নিয়ে গঠিত বিশাল বাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করে ঝু আদিবাসীরা। শেং সৈন্যরা সংখ্যায় বেশি হলেও তারা তেমন প্রশিক্ষিত ছিল না। বিপরীতে উপজাতি ঝু সৈন্যরা ছিল ক্ষীপ্র এবং আগ্রাসী। যুদ্ধ শুরু হলে শেং সাম্রাজ্যের দাস সৈন্যরা শেং দের পক্ষ ত্যাগ করে ঝু দের সাথে যোগ দেয়। অবশিষ্ট থাকা শেং সৈন্যদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। ফলে ঝু দের ব্যাপক আক্রমণের মুখে শেং সৈন্যরা মারা পড়তে থাকে৷ চূড়ান্তভাবে শেং সাম্রাজ্যের পতন হয়। শেং সম্রাট নিজেকে দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেন। এই ঝু সাম্রাজ্য ছিল চীনের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি সময় শাসন করা সাম্রাজ্য।
চ্যাংপিং এর যুদ্ধ, ২৬২-২৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
চীনের সামরিক ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এই চ্যাংপিং এর যুদ্ধ৷ এই যুদ্ধে যুধ্যমান দুই পক্ষেরই অনেক সৈন্য মারা যায়। কিন এবং ঝাও রাজ্য দুটির চীনের কর্তৃত্ব নিয়ে এই যুদ্ধ দু পক্ষই সমানে সমান সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ ময়দানে হাজির হয়। কিন রাজ্যের ৫ লক্ষ ৫০ হাজার সৈন্যের বিপরীতে ঝাও রাজ্যের সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ৪ লক্ষ। যুদ্ধে কিন সৈন্যরা নিজেদের রুদ্রমূর্তি প্রদর্শন করে৷ আগ্রাসী কিন সৈন্যরা সাক্ষাত কচুকাটা করে ছাড়ে ঝাও সৈন্যদের। ৫০ হাজার ঝাও সৈন্য নিহত হয় এবং ৪ লক্ষ সৈন্যদের আটক এবং জীবন্ত কবর দেয়া হয়। এই যুদ্ধের পরাজয়ে আর দাঁড়াতে পারেনি ঝাও রাজ্য। তারপরেও প্রায় ৩ দশক ধরে উভয় রাজ্য বিক্ষিপ্তভাবে সংঘর্ষে লিপ্ত থাকে। শেষ পর্যন্ত চীনে কিন রাজ্যের নিরংকুশ প্রভাব কায়েম হয়। ২২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কিন সাম্রাজ্য সমগ্র চীনকে একত্র করে নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে।
জুলুর যুদ্ধ, ২০৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
চীনের বিদ্রোহী সাম্রাজ্য চু এবং কিন সাম্রাজ্যের মাঝে ফের যুদ্ধের দামামা বাজে। কয়েক বছর আগে চীনে নিজেদের প্রভাব কায়েম করলেও কিন সাম্রাজ্যকে এবার চু'দের হুমকির মুখে পড়তে হয়। ফলে প্রাচীন চীনের আরেক রক্তক্ষয়ী সংঘাতের জন্য মঞ্চ তৈরি হতে থাকে। ইতিহাসে এই যুদ্ধ পরিচিত জুলুর যুদ্ধ নামে। কিন সাম্রাজ্যের ২ লক্ষ সৈন্যের বিপরীতে চু'রা ৫০-৬০ হাজার সৈন্য যোগাড় করতে সমর্থ হয়। চু'দের কমান্ডার ছিলেন চিয়ান ইয়ু যিনি তার সৈন্যদের পীত নদীর তীরে সমবেত হওয়ার আদেশ দেন। চু'দের অধীনে মাত্র ৩ দিন যুদ্ধ করার মত রসদ মজুদ ছিল। এতদসত্ত্বেও চু'দের কাছে পরাজিত হয় কিন সাম্রাজ্য। নিহত হয় ১ লক্ষ কিন সৈন্য।
মবেইর যুদ্ধ, ১১৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ
প্রাচীন চীনের হান সাম্রাজ্য এবং যাযাবর গোত্র শিওংনুর মধ্যকার এক রক্তক্ষয়ী সংঘাতের নাম মবেইর যুদ্ধ বা ব্যাটল অফ নর্দান ডেজার্ট। হান সাম্রাজ্যের উত্তর সীমান্তে শিওংনু গোত্রের যাযাবররা দস্যুপনা করে হান সাম্রাজ্যকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে একটি উত্তপ্ত সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। কিন সাম্রাজ্যের পতনের পর শিওংনু গোত্রের শক্তি বাড়তে থাকে। সামরিক দিক থেকেও তারা হয়ে উঠে বেশ প্রভাবশালী। হান সাম্রাজ্য এদের লাগাম টেনে ধরতে উদ্যোগী হয়। ৩ লক্ষ সৈন্যের পদাতিক বাহিনী এবং প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজার অশ্বারোহী নিয়ে হান সাম্রাজ্য অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিওংনুদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। স্বাভাবিকভাবেই হান সাম্রাজ্য নিরংকুশ বিজয় লাভ করে। তবে এই যুদ্ধে হানদের অনেক ঘোড়া মারা যায়।
লেখকঃ উবায়দুর রাজু