
ধর্মান্ধ আন্দোলনঃ স্পেনে মুসলিমদের বিরুদ্ধে খ্রিস্টানদের বিদ্রোহ
স্পেনের মাটিতে মুসলমানদের শাসন মুসলিম ইতিহাসের এক স্মৃতিময় অধ্যায়। সপ্তম শতকে শুরু হওয়া ইসলামের অপ্রতিরোধ্য বিস্তারের ঢেউ আঘাত হেনেছিল ইউরোপ মহাদেশেও, স্পেনে। সেই স্পেনে আজো মুসলিমদের স্মৃতি তরতাজা। খ্রিস্টান অধ্যুষিত স্পেনে মুসলমানদের শাসন এনে দিয়েছিল সে অঞ্চলে ব্যাপক পরিবর্তন। ধর্মীয় ক্ষেত্রেও এই পরিবর্তন দৃশ্যমান ছিল। মুসলিম নৃপতিদের উদার আচরণে খ্রিস্টানগণ ইসলাম ধর্মের দিকে ঝুঁকতে থাকে। ইউরোপের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে এই পরিবর্তন অনেক গোঁড়া খ্রিস্টানগণ মানতে চায়নি। নবম শতকে স্পেনের খলিফা দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের সময়ে ধর্মীয় এমন পরিবর্তনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে গোঁড়া খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা। ইতিহাসে এই আন্দোলন পরিচিত ধর্মান্ধ আন্দোলন নামে।
স্পেনে মুসলিম বিজয়ের পর মুসলমান শাসকরা সেখানে বলপূর্বকভাবে নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাস চাপিয়ে দেননি৷ অথচ চাইলেই মুসলিমরা স্পেনের খ্রিস্টানদের জোর করে ধর্মান্তরিত করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে মুসলমানরা সেখানে সহনশীলতার পরিচয় দেন। বিশেষ করে খলিফা হিশামের উদার আচরণ খ্রিস্টানদের আকর্ষণ করে। এসময় খ্রিস্টানরা সব ধরণের নাগরিক অধিকার ভোগের পাশাপাশি ধর্মীয় স্বাধীনতায়ও সব ধরণের অধিকার ভোগ করে। অনেক খ্রিস্টান নিজেদের যোগ্যতা অনুসারে রাজকীয় পদেও নিয়োগ লাভ করে। খলিফা হিশামের সহনশীলতায় প্রভাবিত হয়ে অনেক খ্রিস্টান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করে। আর অপরাপর খ্রিস্টানরাও আরবীয় সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকতে থাকে। স্পেনে এদেরকে মোজারব নামে ডাকা হত। ধীরে ধীরে মোজারবদের সংখ্যা বাড়তে থাকলে স্পেনের গোঁড়া খ্রিস্টানরা চিন্তিত হয়ে পড়ে। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে তারা প্রকাশ্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে নিন্দা ছড়াতে থাকে। শেষপর্যন্ত তারা সরাসরি মুসলমানদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে। উদার খ্রিস্টানরা এই আন্দোলনে অংশ নেয়নি।
মুসলিম তথা আরবী সংস্কৃতিতে খ্রিস্টানদের এই আসক্তি ভালভাবে নিতে পারেনি স্পেনের গোঁড়া খ্রিস্টানরা। ধীরে ধীরে স্পেনে আরবীকরণ হতে থাকলে এই শ্রেণীর নেতৃবৃন্দ শংকিত হয়ে পড়ে। এজন্য এরা প্রচার করতে থাকে যারা মুসলমানদের হাতে যেকোনভাবে লাঞ্চিত বা অপমানিত হবে তারাই স্বর্গে চলে যাবে। স্পেনে মুসলমানদের আগমনের ফলে খ্রিস্টান যাজকদের স্বার্থে আঘাত লাগে। তাদের নিজেদের প্রভাব কায়েম করতে সাধারণ খ্রিস্টানদের আবেগকে কাজে লাগায়। আবার অনেক খ্রিস্টান আরবদের অবৈধ দখলদার ভাবত। ফলে খ্রিস্টানরা জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলনের ডাক দেয়। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন সেন্ট জুলিয়াস গির্জার যাজক ইউলোজিয়াস ও এলভোরো। এরা প্রকাশ্যে রাস্তাঘাটে মুসলমান এবং হযরত মুহাম্মদ স কে নিয়ে নিন্দা ছড়াতে থাকে৷ কখনো কখনো মসজিদে প্রবেশ করে তারা হিংসা প্রচার করত। যাজক ইউলোজিয়াস এবং ফ্লোরা ছিলেন এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় ত্রাস। ফ্লোরা নামের এই নারীর মা ছিলেন খ্রিস্টান এবং বাবা ছিলেন মুসলমান। ফ্লোরা গোপনে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করলে তার বাবা তাকে কাজির কাছে নিয়ে যায়। কাজি ফ্লোরাকে শাস্তির আদেশ দিলে খ্রিস্টানরা ক্ষেপে যায়। ফলে এই আন্দোলন আরো প্রাণ পায়৷ খলিফা দ্বিতীয় আব্দুর রহমান আন্দোলন থামানোর আহ্বান জানালে তারা এতে কর্ণপাত না করে দ্বিগুণ উৎসাহে আন্দোলনে মেতে উঠে। এমন অস্থির সময়ে মহানবী স কে নিয়ে অপমানজনক কথা বলার অপরাধে এক খ্রিস্টানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। ফলে এই আন্দোলন আবারো জমে উঠে। স্পেনের শহরে শহরে খ্রিস্টানরা স্বেচ্ছায় আত্মাহুতি দিতে থাকে। ফলে আবদুর রহমান চাপে পড়ে যান। আব্দুর রহমান এবার উদার খ্রিস্টান পণ্ডিতদের নিয়ে একটি সভা আহ্বান করেন। সভায় পণ্ডিতরা মত দেন হিংসাত্মক কাজ খ্রিস্ট ধর্মের আদর্শের পরিপন্থী। যারা এসব কাজ করে বেড়াচ্ছে তারা প্রকৃত খ্রিস্টান নয়। তা সত্ত্বেও আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। দ্বিতীয় আব্দুর রহমান ফ্লোরা ও মেরি নামের দুই আন্দোলনকারীকে মৃত্যুদণ্ড দিলে আন্দোলন কিছুটা স্থিমিত হয়ে পড়ে। খলিফার মৃত্যুর পর তার পুত্র মুহাম্মদ এর সময়েও এই আন্দোলন আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। মুহাম্মদ নেতৃস্থানীয় ৪৪ জনকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করলে এই আন্দোলন পুরোপুরিভাবে সমাপ্ত হয়৷ খ্রিস্টানদের এই আন্দোলন আপাতদৃষ্টিতে শেষ হলেও এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় পঞ্চদশ শতকে স্পেন থেকে মুসলমানদের বিতাড়ন ঘটে।
লেখকঃ উবায়দুর রাজু