যুদ্ধ

মুসলমানদের স্পেন বিজয়

যুদ্ধ রবিবার, ০১ মার্চ ২০২০ ০৯:৪১:১৩

খোলাফায়ে রাশেদীনের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমরের শাসনকাল থেকে শুরু হওয়া মুসলমানদের জয়রথ উমাইয়া আমলে এসে আরো বিকশিত হয়ে পড়ে। সাম্রাজ্যবাদী উমাইয়া শাসকরা একে একে আরব ভূখণ্ড পেরিয়ে ইসলামকে নিয়ে গেলেন এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপেও। উত্তর আফ্রিকায় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সময় এই অঞ্চল পেরিয়ে মুসলমানদের দৃষ্টি গেল আন্দালুসিয়ায়, বর্তমান স্পেনে। স্পেনের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল তখন শোচনীয়। রাজা ও সামন্তের দ্বন্দ্বের সুযোগ কাজে লাগায় মুসলিমরা। মুসলিম সেনাপতি তারেক বিন জিয়াদের নেতৃত্বে স্পেন বিজিত হয় অষ্টম শতকের প্রথম ভাগে। পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত স্পেনে বাতিঘর হয়ে জ্বলেছিল মুসলিম এই সাম্রাজ্য।


প্রাক কথন

উমাইয়া খলিফা প্রথম ওয়ালিদ ৬৯৮ সালে তার সুযোগ্য সেনাপতি মুসা বিন নুসাইরকে ইফরিকিয়ার গভর্ণর পদে পদায়ন করেন। বর্তমান লিবিয়া,আলজেরিয়া অঞ্চলকে বলা হত ইফরিকিয়া। উত্তর আফ্রিকায় মুসলিম শাসন বলবৎ করা ছিল তার দায়িত্ব। আর এ কাজের জন্য তিনি নিজের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করেন। গড়ে তুলেন সুদক্ষ নৌবাহিনী। উত্তর আফ্রিকা নিয়ে ব্যস্ত থাকা মুসার কানে হঠাৎ স্পেন ও পর্তুগাল তথা হিস্পানিয়া অঞ্চলের এক সামন্ত কিছু সংবাদ দিয়ে যান। সেই সামন্তের ভাষ্যমতে, হিস্পানিয়া প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর একটা দেশ,সেখানকার রাজা রডারিক একজন দুর্বল প্রকৃতির মানুষ, সৈন্যরা তার আদেশ মান্য করে না, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সেখানে নিত্যসঙ্গী। কাউন্ট জুলিয়ান নামের রাজা রডারিকের এই সামন্ত অবশ্য শত্রুতার বশেই মুসা বিন নুসায়েরের কান ভারী করেছিলেন। কথিত আছে, রাজ রেওয়াজ অনুযায়ী কাউন্ট জুলিয়ান তার কন্যার পড়াশোনার জন্য রাজা রডারিকের দরবারে পাঠালে রাজা তার শ্লীলতাহানি করেন। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ পিতা কাউন্ট জুলিয়ান প্রতিশোধের চেষ্টা চালান। তিনি নিজে সামান্য সামন্ত হওয়ায় প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারবেন না ভেবে তিনি মুসলিমদের সাহায্য চান এবং জুলিয়ান মুসার কাছে এও প্রস্তাব দেন যে, তিনি গোপনে মুসলমানদের জিব্রাল্টার প্রণালী পার হবার ব্যবস্থা করে দেবেন। মুসা তার সুযোগ্য সেনাপতি তারেক বিন জিয়াদকে স্পেন আক্রমণের দায়িত্ব অর্পণ করেন।


স্পেন অভিযান ও বিজয়

যে তারিক বিন জিয়াদকে মুসা স্পেন অভিযানের জন্য নির্বাচিত করেন তিনি একসময় মুসার দাস ছিলেন। তার কর্মদক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে তিনি তাকে মুক্ত করে এক পর্যায়ে সেনাপতি পদে আনয়ন করেন। যাইহোক, তারিক বিন জিয়াদকে চারটি যুদ্ধজাহাজ, ৪০০ পদাতিক সৈন্য এবং কিছু বার্বার সৈনিক দিয়ে ৭১০ সালে মুসা স্পেনে প্রেরণ করেন। এই বাহিনী প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিল, স্পেনের রাজনৈতিক এবং প্রতিরক্ষার সালতামামি পর্যবেক্ষণ করা। ক্ষুদ্র এই বাহিনীটি সার্বিক দিক পর্যবেক্ষণ করে অভিযানের অনূকূল পরিবেশ বজায় আছে বলে মত দেয়। ফলে মুসা বিন নুসায়ের সংকল্পবদ্ধ হোন স্পেনে একটি বিশেষায়িত বাহিনী পাঠানোর জন্য। অবশেষে সাত হাজার বার্বার সৈন্য এবং ৩০০ আরব সৈন্যের একটি বাহিনী চূড়ান্ত অভিযানে নামে হিস্পানিয়ার শাসক কিং রডারিকের বিরুদ্ধে। অভিযানের মাঝপথে মুসা বিন নুসাইর আরো ৫ হাজার সৈন্য প্রেরণ করলে মোট ১২ হাজার সৈন্য নিয়ে তারিক বিন জিয়াদ অগ্রসর হোন। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাউন্ট জুলিয়ানের জাহাজে করে তারিকের বাহিনী জিব্রাল্টার পার হয়ে স্পেনের পার্বত্য অঞ্চলে অবতরণ করে। তারিক যেখানে অবতরণ করেন সেই জায়গার নাম দেয়া হয় জাবাল আত তারিখ বা তারিকের পাহাড়। যাইহোক অপেক্ষমাণ গথিক রাজা রডারিকের বাহিনীর সাথে এবার চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয় মুসলিম বাহিনী। ৭১১ সালের ১৯ জুলাই সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক ওয়াদী লাস্কের যুদ্ধ। মুসলিম বাহিনীর স্বল্প সংখ্যক সৈন্য থাকা সত্ত্বেও তারা স্পেনিয়ার্ড বাহিনীর সাথে বাঘের মত যুদ্ধ করে। অপরপক্ষে রডারিকের অপেশাদার সৈন্যরা নিজ শহরের বাইরে এসে যুদ্ধ করতে কিছুটা বিরক্ত বোধ করছিল। মনোবলহীন এই বাহিনী মুসলিম বাহিনীর কাছে বাজেভাবে পরাজিত হয়। কর্ডোভা ও টলোডা মুসলিমদের হাতে পদানত হয়। কিছুদিন পর মুসা নিজে উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের খ্রিস্টান শহরগুলোতে অভিযান প্রেরণ করেন। মুসা ও তারিকের সম্মিলিত এই শক্তি দুই বছরের মধ্যে পুরো স্পেনে মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।  


ইউরোপে মুসলমানদের আগমনের এই ঐতিহাসিক ধারার উপর ভিত্তি করে ধীরে ধীরে ইউরোপের আনাচে কানাচে ইসলামের বিস্তার হতে থাকে। স্পেনে মুসলিমদের এই বিজয় এবং তার পতন আজো মুসলিম ইতিহাসে গৌরবময় এবং স্মৃতিময় একটি অধ্যায়।
লেখকঃ উবায়দুর রহমান রাজু