যুদ্ধ
প্রতীকি ছবি

দাঊদ খান কররানী ও রাজমহলের যুদ্ধ

যুদ্ধ সোমবার, ০৪ নভেম্বর ২০১৯ ০২:২৬:১৯

১৫৩৮ সালে বাংলার স্বাধীন সালতানাতের সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহকে পরাজিত করেন আফগান শের শাহ সূরি। তখনো শের শাহ সূরি শাহ উপাধি গ্রহণ করেননি। শের শাহের বাংলা দখলের খবর পেয়ে দিল্লীর সম্রাট হুমায়ূন বাংলা অভিমুখে অভিযান প্রেরণ করলেন। শের শাহের সাথে তার মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় ১৫৩৯ সালে বক্সারের নিকট চৌসার প্রান্তরে। ঐতিহাসিক এই যুদ্ধে হুমায়ূন পরাজিত হন। বাংলা পুনরূদ্ধার করতে গিয়ে দিল্লীর মসনদই হারিয়ে বসলেন খামখেয়ালি সম্রাট হুমায়ূন। শের শাহ বনে যান দিল্লীর সম্রাট। সেই থেকে অর্থাৎ ১৫৩৮-১৫৬৩ পর্যন্ত বাংলায় চলে আফগান শাসক। তার পরের বছর শুরু হয় বাংলায় আরেক আফগান গোষ্ঠী কররানীদের শাসন। এই কররানী আমলে ফের বাংলা তার স্বাধীনতা ফিরে পায়। শেষ কররানী শাসক দাঊদ খান কররানী মুঘলদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নিরবচ্ছিন্নভাবে চালিয়ে যাচ্ছিলেন বাংলার স্বাধীন রাজবংশ। কিন্তু ১৫৭৬ সালে রাজমহলের যুদ্ধে দাঊদ খান কররানী মুঘলদের কাছে পরাজিত হলে বাংলা সরাসরি মুঘল অধীনে চলে যায়।

দাঊদ খানের পিতা সুলায়মান খান কররানী অধীনতা মেনে নিয়েছিলেন দিল্লীর সম্রাট আকবরের। আকবরও স্বস্তিতে ছিলেন। বিদ্রোহাত্মক বাংলায় যেন শান্তিই কাম্য ছিল মুঘলদের। কিন্তু দাঊদ খান সিংহাসনে আসন গ্রহণ করলে মুঘলদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। পিতার মত মুঘলদের অধীনতা মেনে নেননি তিনি। নিজের নামে মুদ্রা আর খুতবা পাঠের রীতি চালু করেন। স্বাভাবিকভাবেই মুঘলদের চক্ষুশূল হোন দাঊদ খান কররানী। দাঊদের অন্যান্য রীতিও মনপুত হয়নি সম্রাট আকবরের। দাউদ কররানী এক বিশাল সেনাবাহিনীর উত্তরাধিকারী হন। তাঁর অধীনে ১ লক্ষ ৪০ হাজার বিভিন্ন শ্রেণির পদাতিক সৈন্য, ৪০ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য বিভিন্ন আকারের ২০ হাজার কামান, ৩ হাজার ৬শত হাতি এবং কয়েকশত রণতরী মজুত ছিল।  শক্তির বিচারে তাই দাঊদ আকবরের চেয়ে কম যেতেন না। ফলে নিজের আত্মবিশ্বাসকে পুঁজি করে দাঊদ খান কররানী সরাসরি আকবরের বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন। গুজরাট ও রাজ-পুতানায় আকবরের ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে দাউদ খান কররানী গাজীপুরের নিকট যামানিয়া দুর্গ অবরোধ করেন। এবার সম্রাট আকবর তার সেনাপতি মুনিম খানকে প্রেরণ করেন দাঊদ খানকে সমুচিত শিক্ষা দিতে। ১৫৭৫ সালের তুকারই যুদ্ধে মুনিম খানের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হোন দাঊদ খান কররানী। এই যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত একটি সন্ধির মাধ্যমে  শেষ হয়। কটক চুক্তি নামে পরিচিত এই সন্ধিতে দাঊদ খানের রাজত্ব সংকুচিত হয়ে পড়ে।  বাংলা ও বিহার হারিয়ে শুধুমাত্র উড়িষ্যার শাসনভার অবশিষ্ট পান তিনি। মুনিম খান যতদিন জীবিত ছিলেন ততোদিন দাঊদ খান কররানী বিদ্রোহী হওয়ার সাহস পাননি। কিন্ত মুনিম খান মারা যাওয়ার পর আবারো হারানো অঞ্চল ফিরে পাওয়ার জন্য ব্রতী হোন তিনি। অভিযানে বের হয়েই তেলিয়াগড় পর্যন্ত নিজের অধিকারে নিয়ে আসেন। এভাবে মুঘলদের বিতাড়িত করে তিনি পশ্চিম ও উত্তর বাংলা দখল করেন। ওদিকে আবার বাংলার বারো ভূইয়াদের নেতা ঈসা খা মুঘল নৌ বাহিনীকে তাড়িয়ে বাংলায় আবারো স্বাধীনতার পরিবেশ ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। সম্রাট আকবর আবারো দাঊদ খান কররানীকে দমন করতে তার সেনাপতি খানজাহান হোসেন কুলিকে প্রেরণ করেন। হোসেন কুলির বিশাল বাহিনীর খবর পেয়ে দাঊদ খান কররানীও তার প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেন। তার সমৃদ্ধ সামরিক শক্তিকে নতুন করে ঢেলে সাজান তিনি। দাঊদ খানের ভাগ্য ভালো ছিল যে, তার অধীনে দক্ষ ও সুযোগ্য তিন সেনাপতি ছিলেন। এদের মধ্যে একজন ছিলেন কালাপাহাড় ওরফে রাজু যিনি কিনা হিন্দু ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়ে প্রচুর মন্দির ও দেবদেবীর মূর্তি ধ্বংস করেছিলেন। যাইহোক, দাঊদ খান প্রায় তিন হাজার সুদক্ষ আফগান সেনাদের তেলিয়াগড়ে নিয়োগ করেন এবং তিনি নিজে রাজমহল পাহাড় এবং গঙ্গার মধ্যবর্তী স্থানে সৈন্যসহ অবস্থান নেন। প্রথমেই হোসেন কুলি তেলিয়াগড়ে আফগান সৈন্যদের কাছে বাধাপ্রাপ্ত হয়। একদিকে সুপ্রশিক্ষিত মুঘল সৈন্য অন্যদিকে আফগান দৃঢ়চেতা সৈনিক দল। উভয়ের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই ছোট যুদ্ধে প্রচুর আফগান সৈন্য মারা পড়ে। অগ্রসর হতে থাকে মুঘল বাহিনী। এবার তারা রাজমহলে আফগানদের মুখোমুখি হয়। আফগান বাহিনীর ডানভাগে কালাপাহাড়, বামপাশে জুনায়েদ এবং সামনে নেতৃত্ব দেন কুতলু খান। এই তিন সমরনায়ক দাঊদ খানকে সাথে নিয়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। মুঘল শিবিরে নানান প্রতিকূলতা দেখা দিলে তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ফলে বিহার থেকে আরো সেনা যুক্ত করা হয় মুঘল বাহিনীতে। ১৫৭৬ সালের ১২ জুলাই ঐতিহাসিক রাজমহলের যুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধে নামে দুই দল। যুদ্ধে জুনায়েদ নিহত হলে বেকায়দায় পড়ে মুঘল বাহিনী।  মুঘল বাহিনীর ক্রমাগত আক্রমণে প্রায় দিশেহারা হয়ে পড়ে আফগান বাহিনী। কালাপাহাড় ও কুতলু খান পালিয়ে যান। দাঊদ খানের ঘোড়া কাদায় আটকে গেলে তিনি মুঘলদের হাতে বন্দি হোন। যুদ্ধে আফগানরা পরাজিত হয়। দাঊদ খানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এই যুদ্ধ্বের পর বাংলা মুঘল কর্তৃত্বে আসলেও নিরবচ্ছিন্ন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি তারা৷ ভাটি বাংলার বারো ভূইঁয়ারা মুঘলদের শান্তিতে ঘুমাতে দেয়নি  বেশ কয়েক দশক।

লেখকঃ উবায়দুর রহমান রাজু