
নামিবিয়ার গণহত্যা : হিটলারের পূর্বেই জার্মানরা যে গণহত্যা চালিয়েছিল
গণহত্যা বা জাতিনিধনের কথা আসলেই প্রথমে যে বিষয়টি আমাদের চোখের সামনে চলে আসে সেটি হল জার্মানির হিটলার ও তার ইহুদী নিধনের কলঙ্কজনক অধ্যায়ের কথা। হিটলারের ইহুদী নিধন ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি গণহত্যার নজির রয়েছে যা ইতিহাসে নানাভাবে স্থান করে নিয়েছে। তবে হিটলার জার্মানির পক্ষে প্রথম গণহত্যা চালায়নি। হিটলার ক্ষমতায় আসার পূর্বেই জার্মানি একটি বড় গণহত্যা চালায়। তাই বলা যায় যে হিটলার যে ইহুদী নিধন চালিয়েছিল সেটি ছিল তার পূর্বপুরুষকে অনুসরণ মাত্র। ঐগণহত্যার ইতিহাসও আজ অনেকেই ভুলতে বসেছে। আফ্রিকার দেশ নামিবিয়ার দুইটি আদিবাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জার্মানি এই গণহত্যা পরিচালনা করে যাতে ঐ আদিবাসী গোষ্ঠীর প্রায় ৮০% লোকের প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে।
১৮৮৮ সালে জার্মানি আফ্রিকাতে তাদের উপনিবেশ স্থাপনের কাজ শুরু করে এর অংশ হিসেবে তারা নামিবিয়াতে কার্যক্রম চালাতে থাকে। প্রথমে তারা ধর্মকে ব্যাবহার করে সেখানে প্রবেশ করে। জার্মানি পাদ্রীরা সেখানে প্রথমে ধর্মের কথা বলে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে তারপর তারা এই অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে থাকে। এর অংশ হিসেবে প্রথমে জার্মানি বনিকদের সাথে নামিবিয়ার তৎকালিক শাসকদের একটি বানিজ্যিক চুক্তি করিয়ে নেয়। ফলে দ্বিতীয় ধাপের অংশ হিসেবে নামিবিয়াতে জার্মান বনিকরা প্রবেশ করে। প্রথমে তারা শুধু বানিজ্য দিয়ে তাদের যাত্রা শুরু করলেও ক্রমে তারা নামিবিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা শুরু করে। তারা নাম মাত্র মূল্যে নামিবিয়ার স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে জমি কিনে নিতে থাকে এবং সেখানে জার্মানিদের নিয়ে এসে বসতি গড়ে তোলে এভাবে ক্রমে নামিবিয়ায় জার্মানিদের ভিত মজবুত করে।
১৮৯৪ সালে থিওডর লিওতেইনকে দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকার গভর্নর করে পাঠান জার্মান সম্রাট। এতে নামিবিয়ায় জার্মানিদের নতুন যাত্রা শুরু হয়। তারা প্রায় সরাসরি নামিবিয়ায় শাসন কায়েম করে নেয়। একই সাথে স্থানীয় জনসাধারণের উপর চলতে থাকে অমানবিক অত্যাচার ও তাদের কৃষি ও গৃহপালিত পশু নিয়ে যাওয়াসহ শিশু/নারীদের উপরও নির্যাতন চালানো শুরু করে দেয়।
সেখানে সেসব আদিবাসী বসবাস করত তাদের মধ্যে "নামা ও হেরেরো " রা প্রধান ছিল। প্রথমে নামাদের উপর অত্যাচার শুরু হলেও পরবর্তীতে হেরেরোরাই তাদের অত্যাচারের প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত হয়। হেরেরো আদিবাসীরা তাদের পার্শ্ববর্তী খোয়েসেন গোত্রের লোকেদের দ্বারা অত্যাচারের স্বীকার হলে তারা বাধ্য হয়ে জার্মানিদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে এবং তাদের গভর্নরের সাথে একটি সামরিক চুক্তি করে। এই সুযোগে জার্মানিরা তাদের ভিতরে ঢুকে পড়ার সুযোগ পেয়ে যায়। ফলে তারা হেরেরো জাতিকে রক্ষা করার বদলে তাদের উপর অত্যাচার চালানো শুরু করে দেয়। তাদের নারীদের ধর্ষণ করে, কৃষি পন্য লুট করে ও গৃহপালিত পশু নিয়ে যায়। আর এসবের বিরুদ্ধে হেরেরো পুরুষরা প্রতিবাদ করলে তাদের শারীরিক নির্যাতন করা হত। অবস্থা চুড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেলে হত্যাও করা হত। হেরেরোরা জার্মানি সৈন্যদের এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে গভর্নরের কাছে বার বার অভিযোগ দিয়েও যখন কোন ফল পাচ্ছিল না, তখন তারা জার্মানিদের সাথে বিদ্যমান চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৮৮৮ সালে হেরেরোরা জার্মানির সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি বাতিল করে এবং তাদের থেকে পরিপুর্নভাবে মুক্তি পাবার প্রচেষ্টা করে। কিন্তু তারা তা করতে ব্যর্থ হয়। প্রথমে তারা জার্মানিদের সাথে সামরিক চুক্তি বাতিল করলেও ২ বছর পর আবার এই চুক্তি কার্যকর করার জন্য হেরেরোদের বাধ্য করা হয়। ফলে তারা চুড়ান্তভাবে জার্মানিদের অধীনে চলে যায়।
জার্মানিরা এই চুক্তির পর থেকে হেরেরোদের কে চড়া সুদে ঋন দেয়া শুরু করে একই সাথে ছলেবলে হেরেরোদের জমিও দখল করতে থাকে। কখনো নাম মাত্র মুল্যে এই জমি ক্রয় করত আবার কখনো ঋনের টাকা না দিতে পেরে হেরেরোরা জার্মানিদের জমি দিয়ে ঋন হতে মুক্তি পেত। আবার কখনো বা পেশী শক্তির বলে জার্মানিরা জমি দখল করে নিতো। ১৯০৩ সালের মধ্যে জার্মানিরা হেরেরোদের প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার বর্গ কিলোমিটার জমি দখল করে নেয়। স্থানীয়দের নানা প্রকার ঋনের জালে ফেলে তাদের উপর অত্যাচার চালানো শুরু করে অর্থাৎ উপনিবেশ কায়েমের ষোলকলা পুর্ন হয়। ১৯০৩ সালে জার্মানিরা নামিবিয়ায় শাসনকে সহজ করার জন্য রেলপথ নির্মাণ ও সম্পুর্ন নামিবিয়াকে দুইভাগ করার এক পরিকল্পনা গ্রহণ করে। একই সাথে স্থানীয়দের উৎখাত করার জন্যও ছোট ছোট নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এসব নীলনকশা যখন নামিবিয়ার সাধারন লোকের কাছে ফাঁস হয়ে যায় তখন তারা ক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং জার্মানিদের সমুলে নামিবিয়া হতে উৎখাতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
১৯০৪ সালের ১২ জানুয়ারিতে হেরেরো গোত্রপতি স্যামুয়েল তার গোত্রের সাধারন জনগণদের নিয়ে জার্মানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ঐদিনই জার্মানির বাহিনীর বিরুদ্ধে ১২৬ হেরেরো অধিবাসী প্রাণ দেন। এ খবর জার্মানিতে পৌঁছার পর সম্রাট কাইজার মেজর লিওতেইনকে সামরিক দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেন। তার স্থলাভিষিক্ত করা হয় লেফটেন্যান্ট জেনারেল লোথার ভন ত্রোথাকে। পশ্চিম আফ্রিকায় আসার সময় ভন ত্রোথা সঙ্গে নিয়ে আসেন ভারী অস্ত্রে সজ্জিত ১৪ হাজার যোদ্ধা আর হেরেরোদের সমূলে উৎখাতের পরিকল্পনা।
১১ জুন ত্রোথার সেনারা ওয়াটারবার্গে ৩ থেকে ৫ হাজার হেরেরো যোদ্ধাকে ঘিরে ফেলে। আধুনিক অস্ত্রের মুখে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারেনি হেরেরোরা। পলাতকদের মরুভূমির দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় । পলায়নরত হেরেরোদের কে যেখানে পাওয়া গেছে সেখানেই গুলি করে বা বেয়োনেট দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এমনকি তাদের এই অত্যাচার থেকে বাদ পড়েনি নারী /শিশুরাও। একইসাথে অসংখ্য হেরেরোকে বন্দিও করা হয়। এরপর শুরু হয় সাধারন /নিরীহ হেরেরোদের উপর অত্যাচার। তাদেরকেও ধাওয়া দিয়ে মরুভুমির দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। আর হাতের কাছে যাদের পাওয়া যায় তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করতে থাকে।
এদিকে যাদেরকে মরুভূমির দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, জার্মানি সৈন্যরা তাদেরকে আর মরু এলাকা থেকে ফিরতে দেয়নি। দিনের পর দিন খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে শুরু করে হেরেরোরা। অভিযোগ রয়েছে, মরু এলাকায় যে কয়টি কূপ ছিল জার্মান সেনারা কৌশলে সেগুলোতে বিষ প্রয়োগ করেছে। বলা হয়ে থাকে যে শুধু ওমাহেকে মরুভূমিতেই পানিশূণ্যতায় মারা গেছে ৫০ হাজারের অধিক হেরেরো। বেঁচে যাওয়া মাত্র এক হাজার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে হেরেরো নেতা স্যামুয়েল মরুভূমি পাড়ি দিয়ে ব্রিটিশ অধিভুক্ত এলাকা বেচুনাল্যান্ডে পৌঁছাতে সক্ষম হন।
এদিকে পেছনে পড়ে থাকা এবং বন্দি মিলিয়ে মোট ১৫ হাজারের মত হেরেরো নামিবিয়ায় বাকি থাকে। জার্মান সেনাপতি তাদেরকেও রেহাই দেয়নি, নারীদের কে সমানে হত্যা করা শুরু হয়। গণহারে নারীদের হত্যা করার পিছনে প্রধান কারন ছিল - বিভিন্ন সময়ে জার্মান সৈন্যরা যে নারীদের ধর্ষন করেছে এর ফলে অনেক নারীই গর্ভবতী হয়ে গিয়েছিলেন জার্মানিরা চাইতনা যে হেরেরোদের সাথে তাদের রক্ত মিশ্রিত হোক এবং তাদের রক্ত বর্বর আফ্রিকানদের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হোক। অপরদিকে বন্দি থাকা পুরুষদের হত্যা করার জন্য যাতে গুলি ব্যাবহার না করতে হয় সে জন্য তারা ফাসি দিয়ে হেরেরোদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
তাছাড়াও নির্যাতন শিবিরে বন্দি হেরেরোদেরকে গবেষণাগারের গিনিপিগের মতো ব্যবহার করেছেন জার্মান জিন বিজ্ঞানী ইউজেন ফিশার। তিনি দেখতে চেষ্টা করেন, সেনাদের ধর্ষণে হেরেরো নারীদের গর্ভে জন্ম নেয়া শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে জার্মান পিতার মতো উৎকৃষ্ট হয় কি না। সুস্থ সবল বন্দিদের দেহে আর্সেনিক ও আফিমের নির্যাসসহ বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ করতেন বোফিঙ্গার নামে এক চিকিৎসক। পরে তিনি অপারেশন করে তার ওষুধের প্রতিক্রিয়া দেখতেন। আরেক জার্মান প্রাণিবিজ্ঞানী লিওপার্ড সুলৎজ জানিয়েছেন, পরীক্ষা চালানোয় মৃত বন্দিদের দেহের বিভিন্ন অংশ স্তুপ হয়ে থাকতো। একে তিনি স্বাগতই জানাতেন। হেরেরোরা জাতিগতভাবে নিকৃষ্ট- এটা প্রমাণের জন্য নিহতদের তিনশ খুলি পাঠানো হয় বার্লিনে বিজ্ঞানীদের কাছে।
এদিকে ১৯০৫ সালে নামা উপজাতীরাও জার্মান উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে । নামাদের আত্মসমর্পণ করতে কঠোর ভাষায় চিঠি লেখেন ত্রোথা। তিনি এতে হেরেরোদের উদহারণ হিসেবে নিয়ে আসেন এবং আত্মসমর্পণ না করলে সমূলে নামাদের বিনাশের হুমকি দেন। ১৯০৭ সালে নামারা আত্মসমর্পণ করে। এরপরও তাদের ওপর নেমে আসে জার্মানদের অমানবিক নির্যাতন। বন্দিদের শার্ক আইল্যান্ডের বন্দি শিবিরে পাঠানো হয়। নির্যাতন আর মৃত্যু এখানে এতোই বেশি ছিল যে, পরবর্তী সময়ে এর নাম হয়ে যায় ডেড আইল্যান্ড। অনাহার, নির্যাতন, আর রোগে শোকে এক মাসে এখানে মারা যায় ২৫২ জন বন্দি। তাছাড়াও ১৯০৫- ০৭ সালের মধ্যে বহু সংখ্যক নামাকেও জার্মানি সৈন্যদের হাতে প্রাণ দিতে হয়।
জার্মানিদের এই হত্যাযোগ্য চালানোর পূর্বে হেরেরো ও নামা মিলিয়ে নামিবিয়ার মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১ লক্ষাধিক যা কয়েক বছরের মধ্যে কমে গিয়ে দাড়ায় ১৮-২০ হাজারের মধ্যে। অর্থাৎ এই সময়টিতে নামিবিয়ার প্রায় ৮০ হাজার জনগণকে হত্যা ও বাস্তুচ্যুত করা হয়।
২০১৭ সালে নামিবিয়া জার্মানির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটনের ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট নামক একটি আদালতে মামলা দায়ের করে। মামলায় জার্মানির উপনিবেশিক বাহিনীর হাতে প্রায় ১ লাখ নামিবিয়ান নিহত হয়েছিলেন বলে অভিযোগে দাবি করা হয়েছে। একইসাথে এই হত্যার জন্য জার্মানির কাছে ক্ষতিপূরণ হিসেবে অর্থও দাবী করা হয়। এই মামলার রায় এখনো দেয়া হয়নি। তবে জার্মানিরা অর্থ না দেয়ার ব্যাপারে আদালতে তাদের যুক্তি দিয়েছে।
তথ্যসূত্র
১.https://www.google.com/amp/s/www.bbc.co.uk/news/amp/world-africa-45342586
২.https://www.google.com/amp/s/qz.com/africa/1383931/germanys-namibia-genocide-is-still/amp/
৩.http://m.risingbd.com/international/news/211179/পানি-বন্ধ-করে-নামিবিয়ায়-গণহত্যা-চালিয়েছে-জার্মানি
লেখকঃ ফরিদ মোল্লা