যুদ্ধ

মুসলমানদের সিন্ধু বিজয়ের ইতিহাস

যুদ্ধ বৃহস্পতিবার, ০৭ ফেব্রুয়ারী ২০১৯ ০১:১৯:০১

হযরত উমর (রা) এর আমলে যখন মুসলিম সাম্রাজ্যের বিস্তার হতে থাকল তখন স্বাভাবিকভাবেই ভারতের প্রতি নজর চলে যায় মুসলমানদের। ভারতের ঐশ্বর্য সম্পর্কে আরব বণিকদের দেয়া তথ্য বরাবরই মুসলমানদের তথা বহিরাগতদের প্রলুব্ধ করেছিল এ অঞ্চল বিজয়ে৷ মূলত পশ্চিম ভারতের বন্দরগুলোর প্রতিই ছিল মুসলমানদের লোলুপ দৃষ্টি৷ হযরত উমরের শাসনামলে পারস্য জয় হলে ভারতের দিকে চোখ ফেরায় মুসলিমরা। ৬৩৭ সালে উমরের খিলাফতে জলপথে একদল সৈন্য মুম্বাইয়ের থানা নামক জায়গায় প্রেরণ করা হয়৷ কিন্তু দূরবর্তী স্থানে অভিযানের পক্ষপাতী ছিলেন না বলে খলিফা এ মিশন বাতিল করে দেন। হযরত উমর (রা) এর মৃত্যুর পর সিন্ধুর দেবল এবং আল কিকান নামক জায়গায় একটি অভিযান প্রেরণ করা হয় মুসলমানদের পক্ষ হতে৷ জলপথের এ অভিযানগুলো ব্যর্থ হয়। সপ্তম শতকের মাঝামাঝিতে দক্ষিণ আফগানিস্তান মুসলনানদের অধীনে চলে আসে৷ স্থলপথে একইসাথে বেলুচিস্তানের মাকরানও বিজিত হয়। এর পরই ভারতের দিকে সকল অভিযান আপাতত স্থগিত করে দেয়া হয়৷

উমাইয়া খলিফাদের আক্রমণ এবং সিন্ধু বিজয়

উমাইয়া খলিফাদের আমলে সিন্ধুর রাজার বেশ কিছু কাজ মুসলিম বিজয়ের পথ সুগম করে দেয়। চাচ্চ নামের এক ব্রাহ্মণ রাজার নেতৃত্বে সিন্ধুতে তখন চলছিল হিন্দু রাজত্ব৷ উমাইয়া খলিফা প্রথম ওয়ালিদের শাসনকালে চাচ্চের পুত্র রাজা দাহির ছিলেন সিন্ধুর মসনদে৷ বিপরীতে প্রথম ওয়ালিদের অধীনে ইরাকের গভর্নর  ছিলেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফ। এই হাজ্জাজই সিন্ধু আক্রমণের পেছনে ভূমিকা রেখেছিলেন। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের গভর্নর থাকাকালে কিছু আরব বিদ্রোহী সীমান্ত অতিক্রম করে রাজা দাহিরের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করে। দাহিরের এমন কাজে হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে উস্কে দেয়া হয়৷ এমনিতেই হাজ্জাজ ছিলেন কিছুটা ক্ষ্যাপাটে, রাজ্যলিপ্সু। তাই এর একটা বিহিত করতে তিনি খলিফার নিকট সিন্ধু আক্রমণের অনুমতিপত্র পেশ করেন। এছাড়া সিংহলে মৃত্যুবরণ করা কিছু আরব ব্যবসায়ীর পরিবারকে উপঢৌকন সহ যখন জাহাজে করে ফেরত দেয়া হচ্ছিল তখন দেবল বন্দরে এসে এই জাহাজগুলো জলদস্যুর কবলে পড়ে যায়। ক্ষুব্ধ হাজ্জাজ রাজা দাহিরের কাছে এর ক্ষতিপূরণ চাইলে দাহির তা দিতে অস্বীকার করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় হাজ্জাজ সিন্ধু দখলে দুইটি অভিযান প্রেরণ করেন এবং রাজা দাহির তা সফলতার সাথে প্রতিহত করেন। এবার হাজ্জাজ দাহিরকে সমুচিত শিক্ষা দিতে তার ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা মুহাম্মদ বিন কাসিমকে সেনাপতি বানিয়ে সিন্ধু অভিযানের জন্য প্রস্তুত করা হয়৷

মুহাম্মদ বিন কাসিমের অভিযান

৭১২ খ্রিস্টাব্দে ৬ হাজার সুসংগঠিত সিরিয় ও ইরাকী সৈন্য নিয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিম মাকরান হয়ে দেবল পৌঁছেন এবং দেবল বন্দর অধিকার করেন। কাশিম যেকোনভাবে জানতে পারেন যে, দেবলের কেন্দ্রীয় মন্দিরের উপর এক বিশেষ লাল পতাকা আছে; যে পতাকা সম্পর্কে কথিত আছে যে, যতক্ষণ এই পতাকা উড়তে থাকবে ততদিন দেবল সুরক্ষিত আর এর ব্যত্যয় ঘটলে দেবলকে রক্ষা করতে হবে। চতুর কাশিম প্রথমেই কৌশলে লাল পতাকাটির পতন ঘটান। এ দৃশ্য দেখে দেবলের প্রতিরক্ষা বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। সুযোগ বুঝে দেবল নগরীর নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরিভাবে মুসলমানরা নিয়ে নেয়। দেবলে অল্পকিছু সৈন্যদল রেখে কাশিম সিন্ধু নদের পশ্চিম তীরে নীরন নগরীর দিকে যাত্রা শুরু করেন। নীরনের নগর দুয়ারে আসলে একদল বৌদ্ধ পুরোহিত এসে কাশিমের কাছে নীরনের দখল দিয়ে আত্মসমর্পণ করে। এরপর শেওয়ান নামের আরো এক ছোট শহর কাশিমের হস্তগত হয়। শেওয়ান হতে সিসামের দিকে এগিয়ে যান কাশিম এবং সেখানকার জাঠ বিদ্রোহীদের দমন করেন।

মুখোমুখি রাজা দাহির অতঃপর

ইতিমধ্যে রাজা দাহির প্রায় ৫০ হাজার অশ্বারোহী বিশিষ্ট এক শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে দুর্ভেদ্য রাওয়ার দুর্গে আশ্রয় নেন। তৎক্ষনাৎ মুহাম্মদ বিন কাশিম নীরনে পৌঁছান এবং প্রবল প্রতিরোধের মুখে সিন্ধু নদ অতিক্রম করেন। এ পর্যন্ত যত সিন্ধু অভিযানে এসে যেসব যুদ্ধ করতে হয়েছে মুসলিন বাহিনীকে এখানে এসে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে এসে পড়তে হয়। টানা চারদিন যুদ্ধ করেও কোন কূলকিনারা পাওয়া যায়না। পঞ্চম দিনের মাথায় রাজা দাহির স্বয়ং হস্তী পরিবেষ্টিত হয়ে আক্রমণ পরিচালনা করেন। প্রাণপণ যুদ্ধ করেও রাজা দাহির নিজেকে রক্ষা করতে পারলেন না। তার হাতি পলায়ন করল৷ তবু তিনি নিজেকে সরিয়ে না নিয়ে যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন। অতঃপর রণে ভঙ্গ দিয়ে নিহত হোন৷ রাজা দাহিরের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই রাওয়ার দুর্গ চূড়ান্তভাবে মুসলমানদের দখলে আসে। একে একে ব্রাহ্মণাবাদ, মুলতান মুসলমানের কব্জায় এসে যায়। ইতিমধ্যে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মৃত্যু ঘটলে নতুন কোন অভিযান আর পরিচালনা করা হয়নি। আরবদের সিন্ধু বিজয় ভারতের ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। অনেক ঐতিহাসিকই এ অভিযানকে খাটো করে দেখলেও এই পদক্ষেপই মুসলমানদের ভারতে প্রবেশের এক প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল।

তথ্যসূত্র
ভারতে মুসলিম শাসনের ইতিহাস- ড. মুহাম্মদ ইনাম উল হক
উইকিপিডিয়া

লেখকঃ উবায়দুর রহমান রাজু